রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


গিরীশচন্দ্র ও মা সারদা।

ঘুষুড়িতে শ্রীমায়ের রক্তামাশয় রোগ হলে তিনি ভাদ্রমাস অবধি সেখানে থাকার পর চিকিৎসার জন্য বরানগরে আসেন। ভক্তরা তাঁকে এখানে সৌরীন্দ্র ঠাকুরের ভাড়াবাড়িতে নিয়ে আসেন। এই বাড়িতেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিরীশচন্দ্র ঘোষ এসে মা সারদার শ্রীচরণ দর্শন করে যান। জন্ম থেকে মাতৃহীন, অতি যত্নে লালিত দু’বছরের বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে গিরীশ যখন এই বাড়িতে আসেন, তখন পুত্রটিও সারদা মাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। ‘উ-উ’ শব্দ করে ওপরে যেখানে শ্রীমা আছেন, সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করতে থাকে। ওপরে নিয়ে গেলে সে সারদা মার পায়ে পড়ে প্রণাম করে আর নিচে নেমে এসে নিজের বাবাকে ওপরে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করতে থাকে।

ছেলেকে কোলে নিয়ে চোখের জলে কাঁপতে কাঁপতে গিরীশ ওপরে এসে শ্রীমাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন ও বলেন, ‘মা, এই ছেলে হতেই তোমার শ্রীচরণ দর্শন হল আমার’। স্বামী তুরীয়ানন্দ ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যকে বলেছিলেন, কোনও এক সময় বরানগর মঠে গিরীশ একদিন শ্রীমাকে রেঁধে খাইয়েছিলেন। মা সারদা সেই রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করেন। যদিও রান্নার পদ ছিল ভাত, ডাল, চচ্চড়িমাত্র।
১২৯৭ সালের দুর্গাপুজোর পর মা সারদা দেশে ফিরে আসেন। এখানে কিছু বেশি সময় থাকেন। জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় তিনি জয়রামবাড়িতে থাকতেন। এই সময় ঠাকুরের ভক্ত ও পার্ষদগণের অনেকে কামাপুকুর ও জয়রামবাটি দর্শনে এসে মা সারদার কাছে অহেতুক স্নেহ পেয়ে ধন্য হয়েছেন। বরানগরে সারদা মাকে দর্শন করার কিছু পরে গিরীশচন্দ্রের দেবতুল্য পুত্রটি মারা যায়। পত্নী ও পুত্রহারা গিরীশকে সঙ্গে নিয়ে স্বামি নিরঞ্জনানন্দ জয়রামবাটিতে আসেন।

শ্রীমা চিরদিনই পুরুষভক্তদের কাছে অবগুণ্ঠবতী, তাই তারা শ্রীমার চরণ ছাড়া তাঁর শ্রীমুখ কখনই দেখতে পেতেন না। একমাত্র গিরীশচন্দ্র শ্রীমার মুখদর্শন করার পরম সৌভাগ্য লাভ করেন। স্নান সেরে আর্দ্রবস্ত্রে তিনি মাকে প্রণাম করে মুখ তুলতেই তাঁর শ্রীমুখ দেখে চমকে ওঠেন। গিরীশের মনে হয়, এই শ্রীমুখ তিনি আগেই দেখেছেন। স্মৃতির গভীরে এক ছবি আঁকা ছিল, আজ যেন তা পরম সৌভাগ্য হয়ে তাকে আনন্দে ভরিয়ে তুলেছে।

দ্বিতীয় বিবাহের ছমাস পর গিরীশ কলেরায় ভীষণভাবে আক্রান্ত হন। ডাক্তাররাও জবাব দিয়ে যান। কিন্তু রাতে গিরীশ স্বপ্নে দেখেন, এক মাতৃমূর্তি তার কাছে এসে প্রসাদ খাইয়ে ছিলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হল যে তার মৃতপ্রায় জীবনে তখনই প্রাণের সঞ্চার হল। সকলেই এই অবিশ্বাস্য ঘটনায় অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। ক্ষুরধারবুদ্ধি গিরীশের বুঝতে দেরি হল না যে, ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস, গুরুলাভের জন্য তার ব্যাকুলতা ও ঠাকুরের পরমাশ্রয়প্রাপ্তি, এ সবই শ্রীমায়ের করুণা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

দেশের ও দশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সুভাষ

এতকাল শ্রীমাকে জেনেও চিনতে পারেননি বলে ক্ষুব্ধ মনে গিরীশ বলেছিলেন, ঠাকুর হয়েছেন ছবি, আর তুমি হয়েছ বৌমা, স্বেচ্ছায় ধরা না দিলে, কার সাধ্য তোমাদের ধরে। পরের বছরও বৈশাখ থেকে চারমাস গিরীশচন্দ্র জয়রামবাটি ও কামারপুকুরে সারদা মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় পরম শান্তিতে বাস করেন। নিরঞ্জন মহারাজ শ্রীমার স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখতেন। তাঁরই পরামর্শে পাচক ও ভৃত্য সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামি সুবোধানন্দ, স্বামী বোধানন্দ ও নির্ভয়ানন্দও তাঁদের সহগামী হয়েছিলেন। নিরঞ্জন মহারাজ ও গিরীশচন্দ্র ছাড়া বাকি সকলে দু’ সপ্তাহবাদে কলকাতায় ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন:

সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

কার্তিক মাসের শেষে জগদ্ধাত্রীপুজোর প্রয়োজনীয় পুজোসামগ্রী নিয়ে শরৎ মহারাজ জয়রামবাটিতে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন, সান্যালমহাশয়, হরমোহন মিত্র, যোগীনমা, গোলাপমা ও স্বামী বিরজানন্দ। পুজো সুসম্পন্ন হল, কিন্তু এক-এক করে সকলেই ম্যালেরিয়া জ্বরে শয্যাশায়ী হলেন। তখন সারদা মার চিন্তা ও পরিশ্রমের অন্ত ছিল না। তবে কিছুদিনের মধ্যে অন্নপথ্য করে তাঁরা কলকাতায় ফিরে যান। ১২৯৯ সালের বৈশাখমাসের শুরুতে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ, স্বামি সারদানন্দ, ও আরও অনেকে কামারপুকুর দেখতে যান। সেখান থেকে তাঁরা যে জয়রামবাটি যান, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যের লেখা থেকে তা অনুমান করা যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

এই সালেরই কোনও এক সময় দেশ থেকে ফিরে শ্রীমা কিছুকাল বেলুড়ে ছিলেন মনে করা হয়। কারণ, ঠাকুরের জন্মোৎসবের পর কাশীর প্রমদাদাস মিত্রকে টাকার প্রাপ্তিস্থান ও উৎসবের বিবরণ দিয়ে স্বামি সারদানন্দ যে চিঠি লেখেন, তাতে কোন ঠিকানা না থাকলেও বেলুড় ডাকঘরের ছাপ ছিল। আর সারদানন্দ এই সময় বেলুড়ে শ্রীমার কাছে ছিলেন। সে সময় মায়ের খবর বাইরে কাউকে দেওয়া হত না।

১৩০০ সালের আষাঢ় মাসে শ্রীমা বেলুড়ে এসে নীলাম্বরবাবুর বাড়িতে কয়েক মাস ছিলেন। এই বাড়িতেই শ্রীদুর্গাচরণ নাগ তাঁকে দর্শন করতে আসেন, যা শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা ‘সাধু নাগ-মহাশয়’ গ্রন্থে পাওয়া যায়। শ্রীমাকে দেখতে এসে ভাবের আবেগে তাঁর সারা শরীর কাঁপছিল। তাঁদের আনা সন্দেশ স্বয়ং শ্রীমা নিজহাতে নিয়ে সামান্য অংশ খেয়ে প্রসাদ করে সকলকে খাইয়ে দেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content