বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

বেলুড়ের ভাড়াবাড়ি থেকে শ্রীমা সারদা স্বামী ব্রহ্মানন্দ, যোগানন্দ, সারদানন্দ, যোগীনমা ও তাঁর মা, গোলাপমা আর লক্ষ্মীকে নিয়ে আবার পুরীধামে যান। কলকাতা থেকে চাঁদবালি অবধি বড় জাহাজে এবং সেখান থেকে কটক পর্যন্ত ক্যানেল স্টিমারে গিয়ে কটক থেকে গরুর গাড়িতে পুরী যেতে হয়েছিল। পুরীতে শীঘ্র পৌঁছনোর জন্য স্বয়ং শরৎ মহারাজ সারা রাত গরুর গাড়ি হাঁকিয়েছিলেন।

সকালে পুরীতে পৌঁছিয়েই সবাই জগন্নাথদর্শনে যান। মা সারদা পুরীতে বলরামবাবুর ‘ক্ষেত্রবাসী’ বাড়িতে ২৫ কার্তিক থেকে দু’মাস বাস করেন। ফিরে এসে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসেন। শ্রী’ম তাঁর দিনলিপিতে বলেছেন, ‘‘Ma’s pilgrimage to Jagannath 5th November, 1888. Returns to our house Saturday at 12 noon.” পঞ্জিকানুসারে ২৫ কার্তিক ছয় দণ্ড আটতিরিশ পলের পর থেকে ২৫ পৌষ ছাপান্ন দণ্ড দুই পল অবধি অশুদ্ধকাল ছিল। ঠাকুর জগন্নাথদর্শনে যাননি বলে একদিন সারদা মা ঠাকুরের ছবি তাঁর বস্ত্রের আঁচলে লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁকে জগন্নাথদর্শন করান। মা সারদার কথায় ‘ছায়া, কায়া, ঘট, পট সব সমান’।

পুরীর পাণ্ডা গোবিন্দ শিঙ্গারী শ্রীমাকে শিবিকায় করে জগন্নাথমন্দিরে নিয়ে যেতে চাইলে মা সারদা বলেছিলেন, ‘না গোবিন্দ, তুমি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলবে, আমি তোমার পেছনে পেছনে দীনহীন কাঙালিনীর মতো যাব’। জগন্নাথকে দর্শন করে সারদা মা তাঁর অনুভূতির কথা বলেছিলেন, ‘জগন্নাথকে দেখলুম যেন পুরুষসিংহ, রত্নবেদিতে বসে আছেন, আমি দাসী হয়ে তাঁর সেবা কচ্চি’। শ্রীমা জগন্নাথদেবকে স্বপ্নে শিবমূর্তিরূপেও দর্শন করেছিলেন। পুরীতে যে সতী পীঠ মাতা বিমলার ভৈরব হলেন স্বয়ং জগন্নাথ। তাই জগন্নাথদেব একাধারে বৈষ্ণব এবং শৈবসম্প্রদায়েরও পূজনীয়। শ্রীমার আত্যন্তিক ভক্তি তাঁকে জগন্নাথের দুই স্বরূপই দেখিয়েছে।
এখানে মাস দু’ থাকার পর তিনি কলকাতায় ফেরেন। এখানে তিন-চার সপ্তাহ থেকে শ্রীমা স্বামী যোগানন্দ, সারদানন্দ, অভেদানন্দ, অদ্ভুতানন্দ, নির্মলানন্দ এবং মাষ্টারমশাই ও লক্ষ্মীমণিকে সঙ্গে নিয়ে বাবুরাম মহারাজের জন্মভূমি আঁটপুরে যান। স্বামিজি, স্বামিপ্রেমানন্দ ও বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল আগে থেকেই তখন সেখানে ছিলেন। শ্রীমাকে পেয়ে স্বামীজি তো খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। আঁটপুরে এক সপ্তাহ থেকে শ্রীমা তারকেশ্বর হয়ে কামারপুকুরে ফিরে আসেন।
ঠাকুরের তিরোভাবের পর যখন শ্বশুরবাড়িতে মা সারদা প্রথম থাকতে আসেন, তখন এমন একটি ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটে যে, তাঁর শক্তিস্বরূপা রূপের প্রকাশ হয়ে যায়। একটি ছেলে, ভক্তমহল যাকে পাগলা হরিশ বলত, একদিন কলকাতা থেকে শ্রীমায়ের বাড়িতে এসে হাজির হল। এরপর একদিন তার মস্তিষ্ক বিকৃতির ফলে এমন অবস্থা হল যে সে শ্রীমাকে ধরতে এল। এমন অভাবনীয় ঘটনায় তিনি অবাক হয়ে গেলেন। প্রথমে তিনি হরিশকে এড়িয়ে যাবার জন্যে ধানের মরায়ের পাশ দিয়ে সাতবার দৌড়লেন। কিন্তু হরিশ তাতেও দমল না দেখে মা সারদা তার দুর্বুদ্ধির উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত হলেন। এ বার তিনি সিংহিনীর মতো অমিত সাহসে হরিশকে টেনে মাটিতে ফেলে কালী-করালিনীর মতো ভয়ংকরীরূপে তার বুকে চেপে বসলেন। তারপর মহাবিদ্যা বগলামুখীর মতো তাঁর জিহ্বা টেনে ধরলেন, ‘নিমগ্নারক্তনয়না নাদাপূরিতদিঙ্মুখা। সা বেগেনাভিপতিতা ঘাতয়ন্তী মহাসুরান্’।।

দেবী এখানে দুষ্কৃতদের বধ করেন বলা হয়েছে। মা সারদা যেহেতু মাতৃত্বের সুধারসে পরিপ্লাবিত, তাই তিনি বিনাশ করতে পারলেন না। তবে হরিশের পাগলামির আবরণে ঢাকা তার পাপবুদ্ধির বিনাশ করলেন। যার ফলে ছাড়া পেয়ে সে শ্রীমায়ের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। আঁটপুর থেকে কামারপুকুরে কিছুসময় বাস করে তিনি জয়রামবাটিতে চলে আসেন। প্রতিবার তিনি অন্তত জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়টা বাপের বাড়িতে কাটাতেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৮: শুরু হল কঠিন জীবনচর্যা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

তবে শ্রীমা বেশিরভাগ সময় কামারপুকুরেই থাকতেন। পরবর্তি সময়ে তিনি জয়রামবাটিতেই থাকতেন, কামারপুকুরে বড় একটা যেতেন না। বর্ধমান হয়ে কলকাতা থেকে যাতায়াতের পথে কামারপুকুরে যেতেই হত। কিন্তু ১৩১২ সনের পর থেকে তাঁকে আর ওইপথে যেতে হয়নি। সারদা মায়ের এই পিত্রালয়প্রীতির জন্য কেউ রহস্য করে তাঁকে বলেছেন,’আপনি তো ঠাকুরের বাড়ি একবারও যান না। কলকাতা থেকে দেশে এলেই বাপের বাড়িতে এসে থাকেন, এটি বোধ হয় আপনাদের পূর্ব পূর্ব ধারা’? উত্তরে শ্রীমা হেসে বলেন, ‘তা নয় বাবা, ঠাকুরের বাড়ি কি ভুলতে পারি? শিবু আমার ভিক্ষেপুত্র, (শিবরাম রামলালের ছোট ভাই)। তবে ঠাকুর এখন স্থূলদেহ ত্যাগ করেচেন, গেলে বড়ই কষ্ট বোধ হয়, এজন্য যাই না’। এছাড়া ঠাকুরের শরীর চলে যাওয়ার পর কামারপুকুরের পারিবারিক পরিস্থিতিও তাঁর সেখানে আজীবন বাসের অনুকূল ছিল না। এই কারণে দুঃখ করেই শ্রীমা বলেছিলেন, ‘ঠাকুরের এই একটি কথা আমি রাখতে পারিনি’।

১২৯৬ সালে দোলের আগে শ্রীমা আবার কলকাতায় আসেন এখানে মাস্টারমশাইয়ের কম্বুলিটোলার বাড়িতে তিন সপ্তাহ থেকে তিনি চৈত্রের মাঝামাঝি স্বামী অদ্বৈতানন্দের সঙ্গে গয়ায় যান। গয়ায় যাবার আগে তিনি আবার বৈদ্যনাথধাম দর্শন করেন। ধর্মপ্রসঙ্গে স্বামী ব্রহ্মানন্দ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে বৃন্দাবন থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দ ১৮৯০ সালের ২৯ মার্চ বলরামবাবুকে লিখে পাঠান, ‘মাতাঠাকুরাণী গয়াধামে সত্বর যাইবেন লিখিয়াছেন এবং গয়াধাম হইতে আসিয়া বেলুড়ে থাকিবেন’। ঠাকুর মাকে তাঁর নিজের গর্ভধারিণীর উদ্দেশ্যে শ্রীগদাধরের পাদপদ্মে পিণ্ডদান করতে বলে গিয়েছিলেন। সেই কাজ সুসম্পন্ন করে শ্রীমা বোধগয়া দেখতে যান। বৌদ্ধগয়ার মঠের ঐশ্বর্য দেখে তাঁকে গৃহত্যাগী অর্ধাশনে থাকা নিরাশ্রয় সন্তানদের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি তখন ঠাকুরের কাছে কেঁদে কেঁদে তাঁর সন্তানদের জন্য এই রূপ একটি স্থান করে দেবার প্রার্থনা জানান। গয়া থেকে কলকাতায় তিনি শ্রী’মর বাড়িতে ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৮: শান্তা দেবী— এক মহীয়সী!

মুভি রিভিউ: বারো ক্লাস ফেল ছেলের প্রায় জগৎ জয়ের কাহিনি মন ছুঁয়েছে সবার

কয়েকদিন থাকার পর তিনি বসুভবনে চলে আসেন। এইসময় বলরামবাবু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণভামিনীর আহ্বানে শ্রীমা শীঘ্র সেখানে যান। ১২৯৭ সালের পয়লা বৈশাখ ঠাকুর তাঁর প্রিয় ভক্তকে নিজের কাছে টেনে নেন। অন্তিমকালে বলরাম বসু গুরুপত্নীর চরণ দর্শন করে অতিশয় আনন্দ পান। তাঁর চলে যাওয়াতে শ্রীমা অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। তিনি গৃহীভক্তদের মধ্যে বলরামবাবুকে সকলের থেকে বড় বলে নির্দেশ করেন। তিনি ঠাকুরের কতখানি পরমাত্মীয় ছিলেন তা মা সারদা নিজমুখে বলেছেন। ‘রামের মার (বলরাম বসুর স্ত্রী) অসুখ হয়েছিল। ঠাকুর আমাকে বললেন, যাও দেখে এস গে। আমি বললুম, যাব কিসে? গাড়ি টাড়ি নেই।

ঠাকুর বলেন, আমার বলরামের সংসার ভেসে যাচ্চে, আর তুমি যাবে না? হেঁটে যাবে হেঁটে যাও। শেষে পালকি পাওয়া গেল, দক্ষিণেশ্বর থেকে গেলুম। আর একবার যখন তাঁর স্ত্রীর অসুখ হয়, তখন আমি শ্যামপুকুরে, রাত্রে হেঁটে দেখতে গেলুম’। পরে জৈষ্ঠ্যমাসে বেলুড়ের কাছে ঘুষুড়িতে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। সেই সময় মা সারদাও এই বাড়িতে এসে বাস করেন। এখানেই স্বামীজি এসেছিলেন শ্রীমায়ের কাছে তাঁর প্রব্রজ্যার সঙ্কল্প প্রকাশ করতে। তিনি এখানে শ্রীমায়ের কাছে তাঁর একান্ত অন্তরঙ্গ ইচ্ছার কথাও নিবেদন করেন। তিনি মা সারদাকে গান শোনান ও আশীর্বাদ চান।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩৪: রাজসহায়ে সুবিধা পাওয়া ব্যক্তিদের, রাজারই প্রয়োজনে বিপদের মুখে পড়তে হয়

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

স্বামীজির মনোবাসনা ছিল, ‘ঠাকুরের নাম যেন সারা পৃথিবীতে প্রকাশ করতে পারি’। শ্রীমাও তাঁর স্নেহের নরেনকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন,’তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হোক’। যাত্রাকালে স্বামিজীর সঙ্গী গঙ্গাধর মহারাজকে মা বলেছিলেন, ‘বাবা তোমার হাতে আমাদের সর্বস্ব দিলুম। তুমি পাহাড়ের সকল অবস্থা জান, দেখো যেন নরেনের খাওয়ার কষ্ট না হ্য়’। একথা স্বামী অখণ্ডানন্দের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়। স্বামীজি কখনও শ্রীমায়ের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করতেন না। তিনি সবসময় তাঁকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতেন। একবার কুমুদবন্ধু সেন সহ কয়েকজনকে নিয়ে স্বামীজি শ্রীমায়ের কাছে এসেছেন। তিনি যথারীতি মায়ের পা না ছুঁয়ে তাঁকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। পরে তাঁর সঙ্গে যারা এসেছিলেন, তাদেরও শ্রীমায়ের পা না ছুঁয়ে প্রণাম করতে বলেন।

স্বামীজি তাদের পেছন থেকে বলেন, ‘যাও, কেউ চরণ স্পর্শ না করে মাকে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম কর। তাঁর এতই করুণা, এতই কোমল প্রকৃতি, এতই স্নেহময়ী তিনি যে যখন কেউ তাঁর পাদস্পর্শ করে তিনি তাঁর সর্বগ্রাসী করুণা ও সীমাহীন ভালবাসা দিয়ে তৎক্ষণাৎ তাঁর সকল দুঃখকষ্ট নিজের মধ্যে টেনে নেন’। ঠাকুর সকলকে কৃপা দিতেন না বিশেষ বিশেষ ভক্তকে কৃপা করেছিলেন। কিন্তু মায়ের কাছে যারাই এসেছে, সকলে তাঁর কৃপা পেয়েছে। শ্রীমাকে যে স্বামীজি কতটা শ্রদ্ধা-ভক্তির চোখে দেখতেন, তা তাঁর এই কথা থেকেই বোঝা যায়।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content