সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

কামারপুকুরে ফেরার আগে সারদা বলরামবাবুর বাড়িতে পক্ষকাল অবস্থান করে দক্ষিণেশ্বরের বিগ্রহদের প্রণাম করে শ্বশুরের ভিটেতে যান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বীয় শিষ্য স্বামী যোগানন্দ আর গোলাপমা। অর্থের অনটনের জন্য বর্ধমান অবধি রেলে গিয়ে উচালন পর্যন্ত আটক্রোশ পথ হাঁটতে হল। সারদার বাতের ব্যথা নহবতে থাকাকালীন শুরু হলেও প্রবলাকার ধারণ করেনি। তিনি বৃন্দাবন পরিক্রমা করেছেন, কাশীতে বেণীমাধবের ধ্বজায় আরোহণ করেন, পুষ্করের সাবিত্রী পাহাড়ে ও হরিদ্বারের উঁচু চণ্ডী পাহাড়েও ওঠেন। এখন হেঁটে যেতে গিয়ে মা সারদা পায়ের ব্যথা ও খিদেয় কাতর হয়ে পড়েন। খিদের মুখে গোলাপমায়ের রাঁধা খিচুড়ি তাঁর কাছে মনে হয়েছে যেন অমৃত।

লক্ষ্মীর কথা থেকে জানা যায় যে, মা সারদার ভবিষ্যতের কথা ভেবে ঠাকুর বলরাম বসুর কাছে তাঁর মাসোহারার কয়েক শত টাকা গচ্ছিত রেখে যান, যাতে তাঁর অবর্তমানে সারদার কষ্ট না হয়। ভক্ত বলরাম সেই ধন নিজ জমিদারিতে খাটিয়ে ছয়মাস অন্তর মা সারদাকে তিরিশ টাকা করে সুদ দিতেন। পরে শ্রীমা সেইসব গচ্ছিত ধন দিয়ে জগদ্ধাত্রীপুজোর জন্য জমি কিনে দেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সেবার জন্য যে টাকা নির্দিষ্ট ছিল, সে নিয়ে ঠাকুর খাজাঞ্চিকে বলেন, ‘যদি ওকে দাও তো দাও, নাহলে গঙ্গার জলে ফেলে দাও কি অতিথিসেবায় দাও, যা ইচ্ছা কর’। তখন থেকে শ্রীমাকে প্রতিমাসে সাতটাকা দেওয়া হত। তবে ঠাকুরের মহাসমাধির পর দীনু খাজাঞ্চি ও আরও সকলে সেই টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এমনকি, স্বামিজীর অনুরোধও রক্ষা করেনি।
বৃন্দাবনে থাকার সময় মা সারদা এই খবর শুনে বলেন যে, ঠাকুরই যখন চলে গেলেন, তিনি টাকা নিয়ে কী করবেন। কামারপুকুরে মা সারদাকে রেখে স্বামী যোগানন্দ কলকাতায় গুরুভাইদের কাছে ফিরে আসেন। মা সারদার নিঃসঙ্গ জীবনের যাত্রা শুরু হল। এখানে সবাই জানতে পারল যে তাদের গদাইয়ের বিধবা সহধর্মিণী বসবাস করতে এসেছেন। জমিদার লাহাবাবুর মেয়ে প্রসন্নময়ী দেখা করতে এলেন। তিনি ঠাকুরকে ছোট থেকেই স্নেহ করতেন। তাই ঠাকুরের অল্পবয়সী বিধবা বউকে গ্রামে একা থাকতে যাতে অসুবিধা না হয়, তার জন্য একটি মেয়েকে রাতে সারদার কাছে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামের মহিলারাও এসে সারদাকে সান্ত্বনা দিয়ে যান। কিন্তু তারা ব্রাহ্মণবিধবার হাতের সোনার বালা নিয়ে কথা বলাবলি করতে লাগলেন।

মা সারদার কানেও সেকথা গেল। তিনি লোকের কথাকে মান্যতা দিয়ে বালা খুলে রাখতে গেলে প্রসন্নদিদি বাধা দেন। কারণ, তিনি জানতেন তাঁর গদাই আর তার বউ সামান্য মানুষ নন। তাই ঠাকুরের নিষেধ লঙ্ঘন করা উচিত নয়। পরে অবশ্য মা সারদার তপস্যাপূত জীবনচর্যা লক্ষ্য করে এই গ্রামীণ গুঞ্জন থেমে যায়। ঠাকুরের নির্দেশমতন সারদা শুধু শাকভাত খেয়ে নিজের বাড়িতে একাকী কাটাতেন। নিদারুণ অনটনের জন্য নুন কেনার সামর্থ্যও ছিল না। অনেক সময় কেবল ভাত খেয়ে দিন যাপন করেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৭: তীর্থদর্শন

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩০: সুন্দরবনে লৌকিক দেবতা ছাওয়াল পীর ও রাখাল ঠাকুর

এদিকে তাঁর এত অভাবের কথা ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানগণ জানতেই পারেননি। কারণ, সেকথা শ্রীমা কাউকে জানাননি। তাঁর যে কিছু গয়না ও প্রাপ্য ধন গচ্ছিত ছিল, তাও তিনি নিজে থেকে কখনও চাননি। অল্পে সন্তুষ্ট সারদার কাছে ঠাকুরের অভাবজনিত কষ্টই অধিক ছিল। যখন এই অভাব বোধ অসহ্য হয়ে উঠত,তখন ঠাকুর দেখা দিয়ে উপদেশ দিতেন। কখনও সারদা মার কাছে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াতে বলতেন। ঠাকুরের শেষবেলাতেও তিনি খিচুড়ি খেতে চেয়েছিলেন। মা সারদার ভাই প্রসন্ন কার্যোপলক্ষে কলকাতায় থাকতেন। তাঁর মুখে এবং পরে রামলালের থেকে মায়ের করুণ দিনাতিপাতের কথা কলকাতায় সকলে জানতে পারলেন। ঠাকুরের শিষ্যরা একথা জেনে অস্থির হয়ে উঠলেন। তাঁরা শ্রীমাকে কলকাতাতে আনার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
আরও পড়ুন:

সেদিন ‘খণ্ডরে’র পুনঃপ্রদর্শন আনন্দ দিয়েছিল বিশ্বের তাবড় সিনেমাপ্রেমী থেকে বরেণ্য সেই পরিচালককে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৯: হারিয়ে যাওয়ার ‘জীবন তৃষ্ণা’

শ্রী’মর স্ত্রী নিস্তারিণী একজন ভক্তিমতী মহিলাকে নিয়ে মা সারদাকে নিয়ে আসার জন্য কামারপুকুরে যান। কিন্তু মা সারদা যেতে পারেননি। তিনি গ্রামের মানুষের এবিষয়ে মতামত জানতে আগ্রহী ছিলেন। গৌরীপুরী মাতাজী সেইসময় তীর্থ থেকে কলকাতায় ফিরলে ভক্তশিষ্যরা তাঁকে পাঠান শ্রীমাকে নিয়ে আসার জন্য। গ্রামের মোড়লস্থানীয় লোকেরা তখন বলেন যে, অনাত্মীয়ের কাছে মা সারদার থাকা ঠিক হবে না। এবারেও প্রসন্নময়ী এগিয়ে এসে বলেন যে, গদাইয়ের শিষ্যরা সবাই সন্তানের মতন। তাঁদের কাছে থাকা কোনও অন্যায় নয়। আর কোনও বাধাই রইল না। গৌরীমায়ের সঙ্গে মা সারদা কলকাতায় চলে এলেন। যাওয়ার সময় তিনি জয়রামবাটিতে গিয়ে নিজের মায়ের সঙ্গেও দেখা করে যান এবং কথা দিয়ে যান যে তিনি আবার আসবেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৭: আশাপূর্ণা দেবী—স্বপ্ন আর সত্যির লেখক!

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৭: কী করে তোকে বলব!

কলকাতায় কিছুদিন বলরাম বসুর বাড়িতে থাকার পর ১২৯৫ সালের শুরুতে বেলুড়ে নীলাম্বর মুখুজ্যের ভাড়া বাড়িতে শ্রীমা গোলাপমাকে নিয়ে উঠে আসেন। এখানে তিনি ছয়মাস বাস করেন। গৌরীমা ও যোগীনমাও এখানে এসে থাকতেন। আরও মহিলা ভক্তদের কাছে শ্রীমা তখন আধ্যাত্মিক আশ্রয় হয়েছিলেন। শ্রী’ম এখানে এসে তাঁকে কথামৃতের পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাতেন। স্বামী অভেদানন্দ তাঁকে নিজের লেখা মাতৃস্তোত্র আবৃত্তি করে শোনান। মা সারদা শুনে খুব খুশি হয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘তোমার কণ্ঠে সরস্বতী বসবেন’।

এখানে বাসকালে গোলাপমা ও যোগীনমার সঙ্গে তিনি কঠোর তপস্যারত জীবন যাপন করতেন। একদিন রাতে ছাদে উঠে ধ্যান করার সময় শ্রীমায়ের নির্বিকল্প সমাধি হয় যা সিদ্ধ যোগিদের হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে সমাধি ভঙ্গ হবার পরেও কিছুদিন ধরে মা সারদার মধ্যে এই ভাবাবেশ ছিল। আর তিনি অন্তরে লাল-নীল জ্যোতিতে আত্মস্থ হয়ে থাকতেন। স্বামী বিশ্বেশ্বরানন্দকে মা স্বয়ং বলেছেন যে, আরও কিছুদিন এভাবে থাকলে তাঁর মনকে স্থুলদেহে ফিরিয়ে আনা কঠিন হত।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content