শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
অসুস্থ সারদার জন্য বিশেষ ওষুধ পথ্যের ব্যবস্থা করা হল। ঠাকুরের মা চন্দ্রমণিদেবী তাঁর জীবনের শেষ বার বছর ছেলের কাছে থাকার জন্য দক্ষিণেশ্বরে গঙ্গাবাস করেন। তিনি তখন ওখানেই নহবতের ঘরে থাকতেন। এ বার সারদা নহবতে যাওয়ার চেষ্টা করতেই ঠাকুর বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘না, না ওখানে ডাক্তার দেখাতে অসুবিধে হবে, এখানেই থাক’।
এই নহবত ঘরটি ছিল ভীষণ ছোট, সেখানে একজনেরই ভালোভাবে থাকতে অসুবিধে হয়। তাই ঠাকুরের ইচ্ছায় তাঁর ঘরেই সারদার জন্য আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করা হল। একটি সঙ্গিনী মেয়েও তাঁর দেখাশোনার জন্য সঙ্গে থাকে। সারদা যখন এখানে আসেন, কালীমন্দিরের সকলের খাওয়া তখন হয়ে গিয়েছে। তাই হৃদয় দু’তিন ধামা মুড়ি নিয়ে আসে। পরদিন ডাক্তার আসে দেখতে। ঠাকুর নিজে ওষুধ থেকে সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধান করায় তিন-চার দিনের মধ্যে সারদা সুস্থ হয়ে উঠলেন। সারদার বাবা রামচন্দ্রও জামাইয়ের বন্দোবস্ত দেখে খুশি মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ক’দিন সেখানে থেকে জয়রামবাটি ফিরে গেলেন।
এই নহবত ঘরটি ছিল ভীষণ ছোট, সেখানে একজনেরই ভালোভাবে থাকতে অসুবিধে হয়। তাই ঠাকুরের ইচ্ছায় তাঁর ঘরেই সারদার জন্য আলাদা শয্যার ব্যবস্থা করা হল। একটি সঙ্গিনী মেয়েও তাঁর দেখাশোনার জন্য সঙ্গে থাকে। সারদা যখন এখানে আসেন, কালীমন্দিরের সকলের খাওয়া তখন হয়ে গিয়েছে। তাই হৃদয় দু’তিন ধামা মুড়ি নিয়ে আসে। পরদিন ডাক্তার আসে দেখতে। ঠাকুর নিজে ওষুধ থেকে সকল বিষয়ের তত্ত্বাবধান করায় তিন-চার দিনের মধ্যে সারদা সুস্থ হয়ে উঠলেন। সারদার বাবা রামচন্দ্রও জামাইয়ের বন্দোবস্ত দেখে খুশি মনে নিশ্চিন্ত হয়ে ক’দিন সেখানে থেকে জয়রামবাটি ফিরে গেলেন।
পরে সারদা সুস্থ হলে ঠাকুর তাঁর থাকার ব্যবস্থা নহবতে করে দেন। সেই নহবতের ছোট ঘরটি ছিল সারদার বাড়ি। এ বার থেকে সারদা আনন্দিত মনে স্বামী এবং শাশুড়ির সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ঠাকুরও নানাপ্রকার উপদেশের মধ্য দিয়ে তাঁকে মানবজীবনের উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্তব্য বিষয়ে শিক্ষাদান করতেন। ঠাকুরের উপদেশগুলো ছিল সহজ ও সুন্দর। তিনি আকর্ষণীয় সব উপমার দ্বারা পরম সত্যগুলিকে একেবারে হৃদয়ে গেঁথে দিতেন।
সারদা স্মৃতিচারণা করেছেন যে, ঠাকুর একদিন তাঁকে বললেন, চাঁদমামা যেমন সব শিশুর মামা, তেমনি ঈশ্বরও সকলের আপনার। তাঁকে ডাকার অধিকার উচ্চ, নীচ, ধনবান-ধনহীন সকলেরই আছে। যে ডাকবে, তিনি তাকেই দেখা দিয়ে ধন্য করবেন। ‘তুমি ডাক তো তুমিও তাঁর দেখা পাবে’। সারদাও ঠাকুরের উপদেশ শুনে নিজের জীবনকে গঠন করার সঙ্কল্প নিলেন।
সারদা স্মৃতিচারণা করেছেন যে, ঠাকুর একদিন তাঁকে বললেন, চাঁদমামা যেমন সব শিশুর মামা, তেমনি ঈশ্বরও সকলের আপনার। তাঁকে ডাকার অধিকার উচ্চ, নীচ, ধনবান-ধনহীন সকলেরই আছে। যে ডাকবে, তিনি তাকেই দেখা দিয়ে ধন্য করবেন। ‘তুমি ডাক তো তুমিও তাঁর দেখা পাবে’। সারদাও ঠাকুরের উপদেশ শুনে নিজের জীবনকে গঠন করার সঙ্কল্প নিলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?
কলকাতার পথ-হেঁশেল: উত্তর কলকাতার বেলগাছিয়া: প্রাণের আশ-প্যান্থেরাস
মা সারদার তখন আঠারো-উনিশ বছর বয়স। তাঁরা এক জায়গায় থাকতেন বটে, তবু এমন হত যে, দিনান্তে একবারের জন্যও তিনি ঠাকুরের দর্শন পেতেন না। এর কারণ, ঠাকুরের ঘরে সবসময় লোকের আসা-যাওয়া লেগে থাকত। আর সারদাও ছিলেন লজ্জাশীলা। ফলে তাঁকে দেখা না হওয়ার দুঃখ সহ্য করতে হত। তিনি নিজেই এ বিষয়ে বলেছেন, ‘অনেকক্ষণ ঠাকুরের দর্শন না পেলে মনে কষ্ট হত। তবু চুপ করে থাকতুম, কিন্তু মন মানত না।…তাঁকে একটিবার দেখাই দুর্ঘট হয়ে উঠত। অনেকদিন দেখাই পেতুম না। একবার দেখা হয়ে গেলে ভাবতুম, আহা, আবার দর্শন পাব তো’?
মা সারদার আকুলতা প্রকাশ যত করুণ, ততই মধুর। এ যেন যুগ যুগান্তরের বিরহ। তাঁর মন পড়ে থাকত সর্বদা ঠাকুরের কাছেই। নিজেই বলেছেন, ‘আমি থাকতুম বটে নহবতে, কিন্তু আমার প্রাণমন সর্বদা ঠাকুরের ঘরেই পড়ে থাকত’। এও বলেন, নহবতের ঘরের সামনের দিকের বারান্দায় দরমার বেড়া দেওয়া থাকত। তাঁর কথায়, ‘তার জায়গায় জায়গায় ফাঁক করে রেখেছিলুম, তার মধ্যে দিয়ে ঠাকুরকে এবং তাঁর সব কাণ্ডকারখানা দেখতুম’।
এই নিয়ে ঠাকুরও সহাস্যে বলেন তাঁর ভাইপো রামলালকে, ‘ও রামলাল, তোর খুড়ির বাড়ির বেড়ার ফাঁক যে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত আবরু থাকবে তো রে’। ঠাকুরের মন্তব্য শুনে সারদা লজ্জা পেতেন। তবু না দেখে যে থাকতে পারতেন না। যদিও ঠাকুর কখনও মুখে কিছু বলেননি। তবে একথাও ঠিক যে, তাঁরা ছিলেন অভিন্ন হৃদয়। সারদামা ছিলেন তাঁর শক্তি। তাঁদের অন্তরঙ্গভাব তো পরমার্থে চিরকালীন।
মা সারদার আকুলতা প্রকাশ যত করুণ, ততই মধুর। এ যেন যুগ যুগান্তরের বিরহ। তাঁর মন পড়ে থাকত সর্বদা ঠাকুরের কাছেই। নিজেই বলেছেন, ‘আমি থাকতুম বটে নহবতে, কিন্তু আমার প্রাণমন সর্বদা ঠাকুরের ঘরেই পড়ে থাকত’। এও বলেন, নহবতের ঘরের সামনের দিকের বারান্দায় দরমার বেড়া দেওয়া থাকত। তাঁর কথায়, ‘তার জায়গায় জায়গায় ফাঁক করে রেখেছিলুম, তার মধ্যে দিয়ে ঠাকুরকে এবং তাঁর সব কাণ্ডকারখানা দেখতুম’।
এই নিয়ে ঠাকুরও সহাস্যে বলেন তাঁর ভাইপো রামলালকে, ‘ও রামলাল, তোর খুড়ির বাড়ির বেড়ার ফাঁক যে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। শেষ পর্যন্ত আবরু থাকবে তো রে’। ঠাকুরের মন্তব্য শুনে সারদা লজ্জা পেতেন। তবু না দেখে যে থাকতে পারতেন না। যদিও ঠাকুর কখনও মুখে কিছু বলেননি। তবে একথাও ঠিক যে, তাঁরা ছিলেন অভিন্ন হৃদয়। সারদামা ছিলেন তাঁর শক্তি। তাঁদের অন্তরঙ্গভাব তো পরমার্থে চিরকালীন।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭২: রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনে কঠোর হতেও পারতেন
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১১: মশ্যা রে তুঁহু মম শ্যাম-সমান
এ প্রসঙ্গে একদিনের ঘটনা বলা যেতে পারে, যার থেকে বোঝা যায় যে, তাঁদের দাম্পত্য কত মহনীয় ছিল। একদিন ঠাকুর মন্দিরে সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর চোখ বুজে শুয়ে আছেন তাঁর ঘরে। সেখানে কোনও লোকজন ছিল না। সারদা কোনও প্রয়োজনে তাঁর ঘরে গিয়েছিলেন। ঠাকুর ভেবেছিলেন যে, তাঁর ভাইজি লক্ষ্মীমণি ঘরে ঢুকেছেন। তাই তিনি বলেছিলেন, ‘তুই যাবার সময়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাস’। শুনে সারদা বলেছিলেন, ‘আচ্ছা’। তারপর তিনি দরজা বন্ধ করে চলে যান।
কিন্তু সারদার গলা শুনে ঠাকুরের তন্দ্রা কেটে যায়। তিনি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে নহবতের ঘরে এসে খুবই কাতরভাবে বলতে লাগলেন, ‘দেখো গো, আমি মনে করেছিলুম লক্ষ্মী, তাই ‘তুই’ বলে ফেলেছি। তুমি কিছু মনে করোনি তো’? সারদা তো অবাক, কী এমন হয়েছে যে তাঁর এমন ব্যাকুল ভাব। এ হল আসলে পারস্পরিক পরম প্রেমের অলৌকিক ব্যবহার।
কিন্তু সারদার গলা শুনে ঠাকুরের তন্দ্রা কেটে যায়। তিনি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে নহবতের ঘরে এসে খুবই কাতরভাবে বলতে লাগলেন, ‘দেখো গো, আমি মনে করেছিলুম লক্ষ্মী, তাই ‘তুই’ বলে ফেলেছি। তুমি কিছু মনে করোনি তো’? সারদা তো অবাক, কী এমন হয়েছে যে তাঁর এমন ব্যাকুল ভাব। এ হল আসলে পারস্পরিক পরম প্রেমের অলৌকিক ব্যবহার।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৫: কোন আলো লাগলো ‘পুত্রবধূ’-র চোখে
শুধু তাই নয়, পরের দিন সকালেও ঠাকুর নহবতের ঘরে এসে সারদা মাকে বলতে লাগলেন, ‘দেখো গো, আমি ইচ্ছে করে ‘তুই’ বলিনি’। তাঁর এইরকম আকুলতা দেখে সারদাও লজ্জিত হয়ে পড়েন। তিনি ঠাকুরকে বলেন, ‘আমাকে আর অপরাধি কোরো না’। তাঁদের এই যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসা তা ইহজীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসেবের বহু উর্ধ্বে ছিল, যা সাধারণ দৃষ্টিতে মিলবে না। শুধু তাই নয়, মেলাতে পারাও যাবে না।
মা সারদার কত ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ছিল। যখন ঠাকুরের দেখা পেতেন না, তখন মনে মনে ভাবতেন যে তার মন এমন কী ভাগ্য করে এসেছে যে নিত্য তাঁর দর্শন পাবে। মানবজীবনের কল্যাণে নিঃস্বার্থ ভাবে কত কষ্ট না সহ্য করেছেন সারা জীবন। তাঁরা দু’ জন যে এসেছিলেন সকলকে ভালোবাসতে ও তাঁদের ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে শেখাতে।—চলবে।
মা সারদার কত ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ছিল। যখন ঠাকুরের দেখা পেতেন না, তখন মনে মনে ভাবতেন যে তার মন এমন কী ভাগ্য করে এসেছে যে নিত্য তাঁর দর্শন পাবে। মানবজীবনের কল্যাণে নিঃস্বার্থ ভাবে কত কষ্ট না সহ্য করেছেন সারা জীবন। তাঁরা দু’ জন যে এসেছিলেন সকলকে ভালোবাসতে ও তাঁদের ভালোবাসা দিয়ে সবাইকে শেখাতে।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।