শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

ঠাকুর বাংলার ঘরোয়া সুস্বাদু খাবার খেতে ভালোবাসতেন। শুধু তাই নয়, সুস্বাদু রন্ধন প্রণালীও জানতেন। এর কারণ কামারপুকুর গ্রামের অন্দরমহলে তাঁর ছেলেবেলা থেকে অবাধ যাতায়াত ছিল। বিশেষ করে লাহাবাবুদের ঘরে। জমিদারের মেয়ে প্রসন্নময়ী তাঁকে খুব স্নেহ করতেন, ঠাকুরও তাঁকে দিদি ডাকতেন। গ্রামের মহিলারা যাত্রাপালায় ঠাকুরের শিবসেজে ভাবাবিষ্ট অভিনয় বার বার দেখতে আর তাঁর স্বকণ্ঠে পালাগান শুনতে চাইত। ঠাকুরও তাদের ইচ্ছাপূরণ করতেন, বিনিময়ে লাহাবাবুর অন্দর থেকে হাতে তৈরি নানা মিষ্টি খেতেন। শুধু খেতেন না, পিতার মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ পুত্ররূপে তিনি মায়ের কাছে সবসময় থাকতেন। মায়ের রান্না করা দেখে ছোট থেকেই অনেক কিছু শিখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যখন তিনি ভৈরবীকে নিয়ে গৃহে আসেন। তখন নতুন বউ সারদাকে কি ফোড়ন দিলে রান্নার স্বাদ ভালো হবে, তা নিজে শিখিয়েছেন। কথার ছলে তাঁর বৌদি ও সারদার সঙ্গে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গ আর রসিকতাও করতেন।
ঠাকুর নানা ভাবের রসিক ছিলেন। সারদা মা স্মৃতিচারণ করেছেন যে, রামেশ্বরদাদা তাঁকে যখন শুতে যেতে বলতেন, ঠাকুর হাসতেন। ‘সেই সময় একসঙ্গে শুতুম আর সারারাত গল্পেই কেটে যেত’। মা বলেছেন যে, তখন তারা এক শয্যাই শুতেন। স্বামীসঙ্গ লাভের সেই তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা। স্বামী সারদানন্দ লীলাপ্রসঙ্গে জানিয়েছেন সেসময়ের কথা। ‘শ্রীরামকৃষ্ণের সাহচর্যে নিজের হৃদয়ে সারদা যে অপার আনন্দ উপলব্ধি করেন তার ফলে তাঁর চলন-বলন, আচরণ এবং সকল চেষ্টার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছিল, অপরে হয়তো তা দেখতে পেত না। কারণ উহা তাঁহাকে চপলা না করিয়া শান্তস্বভাবা করিয়াছিল..’। সারদামাও বলেছেন, ‘হৃদয়ের মধ্যে আনন্দের পূর্ণঘট যেন স্থাপিত রহিয়াছে, ওইকাল হইতে সর্বদা এইরূপ অনুভব করিতাম’।

জয়রামবাটির শান্ত পরিবেশে বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল। এবারের স্বামী সান্নিধ্যের মাধুর্য মার হৃদয়ে সদা ভরে থাকত। কতদিনে আবার ডাক আসবে দক্ষিণেশ্বর থেকে তার উন্মুখ প্রতীক্ষা। সারদামা একটা কথা প্রায় বলতেন, ‘যে যার সে তার, যুগে যুগে অবতার’ ভগবানও ভক্তের অদর্শনে বিহ্বল হন, যেমন হন ভক্ত।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

যত মত, তত পথ, পর্ব-১: শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দ-পাঠশালা

এ দিকে দক্ষিণেশ্বরে এসে সবকিছু ভুলে ঠাকুর ধর্মসাধনায় ডুবে গেলেন। তাঁর মধ্যে নারায়ণের অবতারের দিব্য ভাব ফুটে উঠল। যে আনন্দে তাঁর মন পূর্ণ তার হদিস সাধারণ মানুষ পেল না। অনেকেই ভাবল যে তিনি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছেন। এই সব খবর হাওয়ায় ভেসে আশি-নব্বই মাইল দূরবর্তী কামারপুকুর আর জয়রামবাটি গ্রামে পৌঁছতে দেরি হল না। সারদার প্রতিবেশিরা তাঁকে দেখে বলাবলি করে, আহা, ‘পাগলের বউ’। তাঁর মাকে শুনিয়েও বলে, শ্যামার মেয়ের ক্ষ্যাপা জামাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।

যদিও সারদার কোনও অভিযোগ নেই। কেউ তাকে জোর করে বিয়ে দেয়নি। নিজের স্বামীকে নিয়ে প্রতিবেশিদের কথায় তাই দুঃখ পান। মেয়ে ও মা এখন ঘর থেকে কম বেরোন, সকলকে এড়িয়ে চলেন। সারদার মন জানে তার স্বামী সকলের মতো নন। তাই বলে তিনি পাগল, একথা মেনে নিতে পারেন না। কামারপুকুরের অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা তাঁর মনে স্বামী সম্বন্ধে গভীর প্রত্যয় সৃষ্টি করে। তাঁর স্বামী যে অন্য জাতের, তা সকলে বুঝবে না। তাঁদের মধ্যে যে অলিখিত গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সারদা ঠাকুরকে তাঁর গুরু মানতেন এবং তিনি সর্বদা তাই ঠাকুর বলে সম্বোধন করতেন। তাহলেও সারদার মন বলে যদি তিনি সত্যই অসুস্থ হন, তবে স্ত্রী হিসেবে তাঁর কর্তব্য ঠাকুরের দেখাশোনা করা। তিনি মনঃস্থির করেন, স্বামীর কাছে দক্ষিণেশ্বরে যাবেন।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল: যাদবপুর—যদুকুল ও চপস্টিকস

প্রথম আলো, পর্ব-১: বিশ্বের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি জানেন?

১৮৭২ সালের ফাল্গুনের দোলপূর্ণিমা ও শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব তিথি। এই উপলক্ষে গঙ্গাস্নানের পুণ্যার্জনের জন্য বাংলার বাইরে দূর-দূরান্ত থেকে নরনারী কলকাতায় আসেন। সারদাও সম্পর্কে কয়েকজন আত্মীয়ার সঙ্গে কলকাতায় গঙ্গাস্নানে চলেছেন। এই আত্মীয়াদের দ্বারা তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে যাবার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন। পিতার বুঝতে দেরি হয়নি, মেয়ে কেন কলকাতা যেতে চাইছে। তিনি তাই সম্মতই হলেন না, মেয়েকে নিয়ে হেঁটে তারকেশ্বরের পথে কলকাতা রওনা দিলেন। তখন বিষ্ণুপুর ও তারকেশ্বরে রেললাইন ছিল না। কলকাতা যাওয়ার বাহন বলতে হয় পালকি নয়, হাঁটা পথ।

গ্রামের দরিদ্র মানুষেরা পায়ে হেঁটেই যাত্রা করতেন। প্রায় ষাট মাইল পথ মেয়ে ও সঙ্গিদের নিয়ে রামচন্দ্র এগিয়ে চললেন। তিনদিন, তিন রাত্রি তাঁরা চলেছেন ধানক্ষেতের পর ধানক্ষেত পার করে। পথের মাঝে পদ্ম,শালুকে ভরা দীঘি, কোথাও বট, অশ্বত্থের ছায়া। কখনও বা ঘন গাছে ছাওয়া পথ, যেখানে সবাই একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার চলেছে। কলকাতার পথ যে এত দীর্ঘ, সারদার এ বিষয়ে কোনও ধারণাই ছিল না। তিনি আর বুঝি চলতে পারছেন না। ভগবতীর কোমল চরণ, দীর্ঘ পথে ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝেই বসে পড়ছেন।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১০: ধনু হেসে বলে, শর, জান না সে কথা—আমারি অধীন জেনো তব স্বাধীনতা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

মেয়ের গায়ে পিতা স্নেহের স্পর্শ দিয়েই চমকে উঠলেন, এযে ধুম জ্বর। মেয়ের অঙ্গ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে সঙ্গিদের ছেড়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে একটা চটিতে উঠলেন। এখানেই জ্বরে বেহুঁশ অবস্থায় সারদার দিব্যদর্শন হয়। পরে তিনি সে কাহিনি নিজমুখে শুনিয়েছেন, ‘জ্বরে যখন বেহুঁশ হয়ে লজ্জাশরমরহিত হয়ে পড়ে আছি। তখন দেখি পাশে একজন রমণী এসে বসল, মেয়েটির রঙ কাল কুচকুচে। এক-পা ধুলো নিয়ে আমার বিছানার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি কোথা থেকে আসচ গা?’ রমণী বলল, ‘দক্ষিণেশ্বর থেকে আসচি’। পায়ের ধুলো দেখে বললাম, কেউ কি পা ধুতে জল দেয়নি? সে বললে, তোমাকে দেখতে এসেছি। সারদা বললেন, ভেবেছিলাম দক্ষিণেশ্বরে তাঁর কাছে যাব, তাঁকে সেবা করব। জ্বর হয়ে আমার ভাগ্যে সইল না। রমণী বললে, সেকি, তুমি যাবে বৈকি। তোমার জন্যই তো তাকে দক্ষিণেশ্বরে আটকে রেখেছি। ভয় কী? ভালো হয়ে যাবে।

সারদা জানতে চাইলেন, তিনি কে? রমণী বললে, আমি তোমার বোন হই। এই কথোপকথনের মধ্যে সারদা ঘুমিয়ে পড়লেন। ব্রহ্মসূত্রকার মহর্ষি বাদরায়ণ তাঁর সূত্রে বলেছেন, স্বপ্নের মধ্যে দিব্যদর্শন ঘটে। কোন কোন স্বপ্ন দৈবশক্তির প্রকাশ, যেমন সারদা মায়ের হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৬: ঐতিহাসিক বিরল বিবাহ ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

তার পরদিন থেকে সারদা ক্রমে সুস্থ হয়ে উঠলেন। এই দর্শনের পরই তাঁর জ্বর ছেড়ে যায়। দেহ দুর্বল হলেও স্বপ্নে দেখা রমণীর কথায় তিনি মনে উৎসাহ পেয়েছেন যে তাঁর সঙ্গে দেখা হবেই। কোথা খেকে যেন দু’খানা পালকি এসে হাজির। পিতা ও কন্যা পালকিতে উঠলেন। পরে নৌকাযোগে গঙ্গার ঘাটে এলেন। নৌকা দক্ষিণেশ্বর ঘাট ছুঁতেই সারদা শুনতে পেলেন মন্দিরের ঘণ্টা নয়, ঠাকুরের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর। তিনি ভাগনেকে বলছেন, ‘ও হৃদু, বারবেলা নেই তো রে, প্রথমবার আসছে’। ঠাকুরের এই কথায় যে প্রাণের স্পর্শ ছিল তাতে শ্রীমার হৃদয় ভরে গেল। নৌকাতেই বেলা কাটিয়ে রাত ন’টায় তাঁরা ঘাটে নামলেন। সারদা চলে গেলেন সোজা ঠাকুরের ঘরে। তাঁকে দেখেই ঠাকুর বলে উঠলেন, ‘তুমি এসেছ? বেশ করেছ’। পাশে দাঁড়ানো একজনকে বললেন, ‘মাদুর পেতে দে রে’। মাদুরে বসে কথা বলার সময় তিনি জানলেন যে, সারদা অসুস্থ, তাঁর জ্বর হয়েছিল। তখন তাঁকে সুস্থ করার চিন্তায় ঠাকুর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বার বার বলতে লাগলেন, ‘তুমি এতদিনে এলে, এখন আর আমার সেজোবাবু আছে যে তোমার যত্ন হবে’? ঠাকুরের সেজোবাবু হলেন রানির জামাই মথুরবাবু, যাঁকে তিনি রসদদার বলতেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content