শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
ব্রাহ্মণী যজ্ঞেশ্বরী ভৈরবী। শাক্ত-তন্ত্র শাস্ত্রের উত্তর সাধিকা এবং ঠাকুরের তন্ত্র সাধনার গুরুমাতা। তিনি দৈবাদেশে পূর্ববঙ্গ থেকে জলপথে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ঘাটে নামেন। ঠাকুরকে চিনে নিতে তাঁর দ্বিধা হয়নি। ভৈরবী ব্রাহ্মণীই তাঁকে প্রথম অবতাররূপে চিনেছিলেন। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সকলে যখন ঠাকুরের আচরণ দেখে তাঁর বায়ুরোগ হয়েছে বলে ধরে নিয়েছিল, এমন কি রানির জামাতা মথুরবাবু পর্যন্ত বুঝতে পারেননি। তখন শাস্ত্রে উল্লিখিত অবতারের লক্ষণ ও ঠাকুরের শারীরিক ভাব বৈশিষ্ট্য দেখে ভৈরবী মথুরবাবুর সাহায্যে বিরাট এক পণ্ডিতসভার আয়োজন করান। সেই সভায় মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতেরা বিচার করে ঠাকুরকে সকল সুলক্ষণযুক্ত অবতার বলে ঘোষণা করেন।
এরপর, একদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জগজ্জননী দর্শনের আকূতি ও অন্যদিকে কঠোর সাধনা শুরু হয়। তার ফলে অনিয়মের জন্য শরীরের প্রতি তাঁর অবহেলায় স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি কোনও ওষুধেই রোগের প্রশমন না হওয়ায় স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। ঠিক হল সর্বসময়ের সঙ্গী ভাগনে হৃদয়ের সঙ্গে ঠাকুর তাঁর বাড়ি কামারপুকুর যাবেন। মথুরবাবু সব ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন ব্রাহ্মণীর কাছে ঠাকুরের তন্ত্রসাধনা চলছিল। যদিও তিনি খুব দ্রুত এই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আসলে যিনি অবতার, তিনি তো সর্বজ্ঞ। মনুষ্যজন্ম নেওয়ায় লীলা করেন মাত্র। যেমন দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ লীলাচ্ছলেই তাঁর গুরু সান্দীপনির আশ্রমে গিয়েছিলেন এবং মাত্র ছ’মাসের মধ্যে সর্বশাস্ত্র নিষ্ণাত হয়ে ওঠেন। ঠাকুরেরও তেমনি মানবলীলা।
এরপর, একদিকে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জগজ্জননী দর্শনের আকূতি ও অন্যদিকে কঠোর সাধনা শুরু হয়। তার ফলে অনিয়মের জন্য শরীরের প্রতি তাঁর অবহেলায় স্বাস্থ্য খুব ভেঙে পড়ে। কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি কোনও ওষুধেই রোগের প্রশমন না হওয়ায় স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। ঠিক হল সর্বসময়ের সঙ্গী ভাগনে হৃদয়ের সঙ্গে ঠাকুর তাঁর বাড়ি কামারপুকুর যাবেন। মথুরবাবু সব ব্যবস্থা করে দিলেন। তখন ব্রাহ্মণীর কাছে ঠাকুরের তন্ত্রসাধনা চলছিল। যদিও তিনি খুব দ্রুত এই সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আসলে যিনি অবতার, তিনি তো সর্বজ্ঞ। মনুষ্যজন্ম নেওয়ায় লীলা করেন মাত্র। যেমন দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণ লীলাচ্ছলেই তাঁর গুরু সান্দীপনির আশ্রমে গিয়েছিলেন এবং মাত্র ছ’মাসের মধ্যে সর্বশাস্ত্র নিষ্ণাত হয়ে ওঠেন। ঠাকুরেরও তেমনি মানবলীলা।
ভৈরবী ঠাকুরের সঙ্গ ছাড়তে চাননি। কাকে পেয়ে কে যে ধন্য হয়েছে, তা অলক্ষ্যে বিধাতাপুরুষ ছাড়া আর কেউ জানে না। ভৈরবী বুঝে ছিলেন ঠাকুরের গুরুরূপে নয়, তাঁর মতো অসামান্য শিষ্য পেয়ে তিনি ধন্য হয়েছেন। সার্থক হয়েছে তাঁর এতদিনের সাধনা। ব্রাহ্মণীও তাই ঠাকুরের সঙ্গে এই যাত্রায় কামাপুকুর গেলেন। তাঁর যাওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল একটাই, তিনি জেনেছিলেন যে ঠাকুর বিবাহিত এবং গৃহী। তাই গদাধরের বউকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর মনে আশঙ্কা ছিল যে, যদি তাঁর অনুপম প্রতিভাধর শিষ্যটিকে কাছে পেয়ে সারদা তাঁকে সংসারে আবদ্ধ করে ফেলে। এখানেই তিনি সারদা দেবীর স্বরূপ চিনতে ভুল করেছিলেন, যেমন চিনে ছিলেন তাঁর শিষ্যকে তেমনটি পারননি। দূর থেকে জগতের জননীর স্বরূপ ধরা পড়েনা। তাঁকে চিনতে হলে যে কাছে যেতেই হয়।
ঠাকুর ১৮৬৭ সালে দেশে ফিরলেন। মা সারদার কথায় ‘তখন আমাকে খবর দিলেন, ব্রাহ্মণী এসেছেন, তুমি এস’। খবর পেয়ে সারদা কামারপুকুর গেলেন ও সেখানে তিন মাস ছিলেন। সারদা মা তখন চতুর্দশী বধূ। তাঁকে সামনা-সামনি দেখেও প্রথমে ভৈরবীর আশঙ্কা দূর হয়নি। তাই তিনি প্রথমে সারদার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। মার প্রতি কেমন খাপছাড়া ভাব দেখাতেন।
ঠাকুর ১৮৬৭ সালে দেশে ফিরলেন। মা সারদার কথায় ‘তখন আমাকে খবর দিলেন, ব্রাহ্মণী এসেছেন, তুমি এস’। খবর পেয়ে সারদা কামারপুকুর গেলেন ও সেখানে তিন মাস ছিলেন। সারদা মা তখন চতুর্দশী বধূ। তাঁকে সামনা-সামনি দেখেও প্রথমে ভৈরবীর আশঙ্কা দূর হয়নি। তাই তিনি প্রথমে সারদার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। মার প্রতি কেমন খাপছাড়া ভাব দেখাতেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫: চন্দ্রমণির বধূবরণ
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ
এ বিষয়ে শ্রীমা পরে জানিয়েছেন যে, ব্রাহ্মণী প্রথমে তাঁকে সুনজরে দেখেননি। পরে অবশ্য ভৈরবীর সন্দেহ নিরসন হয়। ভৈরবী ব্রাহ্মণীকে সারদা কিন্তু শাশুড়ি-জ্ঞানেই সেবা-যত্ন করতেন। আর ঠাকুর সারদার সঙ্গে খুবই আন্তরিক ব্যবহার করতেন। আগের মত গল্প-কথাও বলতেন। তাঁর শরীর খারাপের জন্য সারদাও সহজে হজম হয়, এমন লঘুপাচ্য খাবার রান্না করতেন।
এদিকে সারদার প্রতি ঠাকুরের এই সহৃদয় ব্যবহারে ভৈরবী যে সারদার সৌভাগ্যে খুশি হতে পারতেন না, তা তাঁর রুক্ষ মেজাজে ও কথায় অভিব্যক্ত হত। বালিকাবধূ তাঁর সামনে ভয়ে সংকুচিত হয়ে থাকতেন। পরে শ্রীমা স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ভৈরবী ছিলেন ঠাকুরের মায়ের মত। মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এমনটি করেই থাকেন, এতে দোষের কিছু নেই।
এদিকে সারদার প্রতি ঠাকুরের এই সহৃদয় ব্যবহারে ভৈরবী যে সারদার সৌভাগ্যে খুশি হতে পারতেন না, তা তাঁর রুক্ষ মেজাজে ও কথায় অভিব্যক্ত হত। বালিকাবধূ তাঁর সামনে ভয়ে সংকুচিত হয়ে থাকতেন। পরে শ্রীমা স্মৃতিচারণায় বলেছেন, ভৈরবী ছিলেন ঠাকুরের মায়ের মত। মায়েরা সন্তানের মঙ্গল কামনায় এমনটি করেই থাকেন, এতে দোষের কিছু নেই।
আরও পড়ুন:
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-১: ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিবমন্দির এক অনন্যসাধারণ কোচ স্থাপত্যশৈলীর উদাহরণ
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১: একটু শুরুর কথা হলে ক্ষতি কী…
আশ্চর্যের কথা হল, যে সিদ্ধ সাধিকা ঠাকুরের অবতারত্ব বুঝতে পেরেছিলেন আর তাঁরই শক্তিস্বরূপাকে চিনতে ভুল করলেন। আসলে ঠাকুরের মতো শিষ্যও যে কোটিতে একজন হয়। গুরুও তো এমন অমূল্য রতনের খোঁজেই থাকেন। তাই এই সংশয়। ব্রাহ্মণী কামারপুকুরের সকলের কাছেই মার মতন। ঠাকুর নিজেও তাঁকে মা ডাকতেন। তিনি নিজের ইচ্ছানুযায়ি যে কোন কাজ করতেন। তিনি নিজেই পুরো কামারপুকুর আর শিহড় ঘুরে এলেন।
পূর্ববঙ্গের মেয়ে, তাই রান্নার হাত ভালো ছিল। তরকারি রান্না করে সকলকে খাওয়াতেন। তবে তিনি বেশি ঝাল খেতেন। একদিন তিনি রামেশ্বরের স্ত্রীকে বেশ ঝালে পোড়া তরকারি খাইয়ে জানতে চান, কেমন হয়েছে। তখন অসহ্য ঝাল খেতে খেতে ঠাকুরের বউদি বলেছিলেন যে, ঝালটা খুব বেশিই হয়েছে। শ্রীমায়ের কথায় ‘আমাকে খেতে দিতেন, চোখ মুছতুম আর খেতুম। ভৈরবী এবার সারদার কাছে জানতে চান, তরকারি কেমন হয়েছে। সারদা মুখ নীচু করে অশ্রু আড়াল করে ভয়ে ভয়ে বলতেন, বেশ হয়েছে।
পূর্ববঙ্গের মেয়ে, তাই রান্নার হাত ভালো ছিল। তরকারি রান্না করে সকলকে খাওয়াতেন। তবে তিনি বেশি ঝাল খেতেন। একদিন তিনি রামেশ্বরের স্ত্রীকে বেশ ঝালে পোড়া তরকারি খাইয়ে জানতে চান, কেমন হয়েছে। তখন অসহ্য ঝাল খেতে খেতে ঠাকুরের বউদি বলেছিলেন যে, ঝালটা খুব বেশিই হয়েছে। শ্রীমায়ের কথায় ‘আমাকে খেতে দিতেন, চোখ মুছতুম আর খেতুম। ভৈরবী এবার সারদার কাছে জানতে চান, তরকারি কেমন হয়েছে। সারদা মুখ নীচু করে অশ্রু আড়াল করে ভয়ে ভয়ে বলতেন, বেশ হয়েছে।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৮: সুন্দরবনের নিশ্চিহ্ন প্রাণী
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!
ভৈরবী রামেশ্বরের স্ত্রীর কথায় অপ্রসন্ন হয়ে বলতেন, ‘বৌমা তো বলেছে ভাল হয়েছে, তোমার বাপু কিছুতে ভাল হয় না। তোমাকে আর ব্যঞ্জন দেব না’। সারদা মায়ের অপার সহিষ্ণুতা আর পরকে আপন ভাবার জন্যই প্রচুর ঝালের যাতনা নীরবে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। একদিন চিনু শাঁখারির খাওয়া উচ্ছিষ্ট নেওয়ার জন্য ভৈরবীর সঙ্গে হৃদয়ের বিবাদ হয়। ব্রাহ্মণী হৃদয়কে বলেন যে চিনু একজন ভক্ত, তার উচ্ছিষ্ট নিলে ক্ষতি কিসে। হৃদয় জানতে চান যে উচ্ছিষ্ট নিয়ে তিনি থাকবেন কোথায়। উত্তরে ভৈরবী জানান যে, শীতলার ঘরে আজ মনসা শোবে। একথায় হৃদয় রেগে গিয়ে কিছু ছুঁড়ে মারায় ব্রাহ্মণীর কান কেটে রক্ত পড়তে লাগল আর তিনি কাঁদতে লাখলেন।
এরপর ঠাকুর তাঁকে এমন ভয় দেখালেন যে ভয় পেয়ে তিনি চোখ কপালে তুলে লাহাবাবুদের মেয়ে প্রসন্নময়ীকে বলতে লাগলেন যে কোথায় যাবেন, পুরী না বৃন্দাবন? তারপর একদিন ভয়ে কোথায় চলে গেলেন, কেউ টের পায়নি। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। হৃদয়ের সঙ্গে যাতে আর ঝগড়া না লাগে, তাই ঠাকুর তাঁকে অমন ভয় দেখিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, ঠাকুরকে আর তার দেবার কিছু নেই। ঠাকুর খাঁটি সোনা, তাঁকে পাহাড়া দেবার দরকার নেই। তিনি গৃহী হয়েও নিষ্কাম যোগী। তাই তাঁর দৈবাদিষ্ট কাজ সম্পন্ন হওয়ায় তিনি নিঃশব্দে বিদায় নেন।
এরপর ঠাকুর তাঁকে এমন ভয় দেখালেন যে ভয় পেয়ে তিনি চোখ কপালে তুলে লাহাবাবুদের মেয়ে প্রসন্নময়ীকে বলতে লাগলেন যে কোথায় যাবেন, পুরী না বৃন্দাবন? তারপর একদিন ভয়ে কোথায় চলে গেলেন, কেউ টের পায়নি। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি। হৃদয়ের সঙ্গে যাতে আর ঝগড়া না লাগে, তাই ঠাকুর তাঁকে অমন ভয় দেখিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, ঠাকুরকে আর তার দেবার কিছু নেই। ঠাকুর খাঁটি সোনা, তাঁকে পাহাড়া দেবার দরকার নেই। তিনি গৃহী হয়েও নিষ্কাম যোগী। তাই তাঁর দৈবাদিষ্ট কাজ সম্পন্ন হওয়ায় তিনি নিঃশব্দে বিদায় নেন।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।