শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
১২৯১ সালে ঠাকুরের গলরোগ ধরা পড়ে। পাণিহাটির মহোৎসবে যোগদানের পর থেকে সেই রোগ ক্রমে বেড়ে যায়। ওষুধের সবরকম ব্যবস্থা করা হলেও তা বেড়েই চলে। ভাদ্রমাসে একদিন তাঁর গলা থেকে রক্ত বার হলে ভক্তরা চিন্তায় পড়েন। তাঁরা সকলে পরামর্শ করে ওই মাসেরই তৃতীয় সপ্তাহে ঠাকুরকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হবে বলে স্থির করেন। উত্তর কলকাতার ৫৫ নম্বর শ্যামপুকুর স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু সেখানে ঠাকুরের জন্য বিশেষ পথ্য তৈরি না হলে ভালো চিকিৎসায় কোন ফল হবে না। এটি বুঝতে পেরে ঠাকুরের প্রবীণ ভক্তরা শ্রীমাকেও শ্যামপুকুরে নিয়ে আসার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু এখানে অন্দরমহল না খাকায় শ্রীমা অপরিচিত লোকদের মধ্যে কীভাবে থাকবেন, তার সমস্যা দেখা দিল। সারদা মা বাইরের লোকের কাছে অবগুণ্ঠনবতী হলেও দেশকালভেদে নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করে চলতে পারতেন।
ঠাকুরের ভালো পথ্য রাঁধার লোকের অভাব শুনে তিনি নিজে একটুও ইতস্তত না করে দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্যামপুকুরবাটিতে চলে আসেন। আর ঠাকুরের রোগমুক্তির জন্য তাঁর সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করলেন। শ্যামপুকুরের বাড়ির একটুখানি ছাদে সামান্য ছাউনি দিয়ে শ্রীমায়ের থাকার ব্যবস্থা করা হল। এখানে একমহলা বাড়িতে স্নানের জন্য একটিমাত্র নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। তাই তিনি রাত তিনটের আগে উঠে পড়তেন। স্নানাদি শেষ করে তিনতলার ছাদের সিঁড়ির চাতালে কখন উঠে যেতেন তা লোকে টেরও পেত না। সারাদিন সেই সরু চাতালে থেকেই ঠাকুরের জন্য পথ্য প্রস্তুত করতেন। তারপর ঠাকুরের ঘর থেকে লোকের ভিড় সরিয়ে দেবার পর তিনি নিজেই ঠাকুরকে খাওয়াতে যেতেন। রাত এগারটার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সারদা দোতলায় নেমে তাঁর নিজের থাকার জন্য নির্দিষ্ট ঘরে মাত্র তিনঘণ্টা বিশ্রাম নিতেন। এ ভাবে প্রতিদিন মা সারদা ঠাকুরের নিত্যসেবা করে যেতে লাগলেন। এমনকি, যেসব ভক্তরা ঠাকুরকে রোজ দেখাশোনা করতে আসত, তারা পর্যন্ত কিছু জানতে পারত না। এই বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণপুঁথিতে বলা হয়েছে—
বিন্দুনিবাসিনী মাতা শুনা ছিল কানে।
কৃপায় তাঁহার এবে দেখিনু নয়নে।।
কৃপায় তাঁহার এবে দেখিনু নয়নে।।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
প্রথমে চিকিৎসায় ঠাকুরের উন্নতি হলেও পরের দিকে অবস্থার আর কোন পরিবর্তন হচ্ছে না দেখে ঠাকুরের ভক্তরা চিন্তিত হলেন। তখন ডাক্তারের পরামর্শে কলকাতার বাইরে কাশীপুরে গোপালচন্দ্র ঘোষের বাগানবাড়ি ভাড়া করে ঠাকুরকে সেখানে আনা হল। শ্রীমাও সঙ্গে গেলেন। ঠাকুর যেদিন উদ্যানবাটিতে এলেন সেদিনটি ছিল শুক্রবার, ২৭ ফাল্গুন। ঠাকুরের ত্যাগী যুবক ভক্তরা যাঁরা আগে পালা করে ঠাকুরের দেখাশোনা করতেন, এখন ঘর ছেড়ে একপ্রকার এখানেই থাকতে লাগলেন। সারদাকে তাই রন্ধনে সাহায্য করতে ও তাঁর একাকিত্ব দূর করার জন্য লক্ষ্মীদেবীকে নিয়ে আসা হল। গোলাপমা, যোগিনমা প্রমুখ মায়ের মহিলা ভক্তরা মাঝে মাঝে আসা যাওয়া করতেন। কখনও থেকেও যেতেন। খোলামেলা স্থানে ফল ও ফুলের বাগানসমেত সুন্দর দোতলা উদ্যানবাটি। কেয়ারি করে সাজান বাগানের পথ। সামনের দিকে ছোট বাঁধানো একটি পুকুরঘাট। এই পরিছন্ন পরিবেশে এসে ঠাকুর-সহ সকলেই খুশি হলেন।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৬: স্বপ্নে আমার মনে হল
শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-১: তিনকন্যা
এখানে প্রাকৃতিক নীরবতা পাখির কলতানে মুখর হয়ে ভোরের আকাশকে রাঙিয়ে দেয়। হয়ত, তখন সবেমাত্র সকালের রোদের ঝিলিক দিয়েছে। এমনই এক সকাল ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি। সেদিন ছুটির দিন বলে ঠাকুরের গৃহী ভক্তরা সকলেই সমবেত হয়েছেন। সেই সময়ে ঠাকুর নিঃশব্দে, ধীরে উপর থেকে নীচে নেমে এলেন। ধীরে ধীরে বাগানের এধার, ওধার পায়চারি করতে শুরু করলেন। তাঁকে দেখে সকল গৃহী ভক্ত আনন্দে শিহরিত হলেন। তাঁরা আশান্বিত হলেন, তাহলে ঠাকুর ভালো হয়ে যাবেন। ঠাকুরের ত্যাগী ভক্তরা কিছু জানতে পারলেন না। কারণ, তাঁরা সারারাত জেগে ঠাকুরের সেবা করেছেন। এখন তাঁরা ঠাকুরকে নিদ্রিত দেখে বিশ্রাম করতে খিয়েছিলেন। কিন্তু গৃহী ভক্তরা ছুটি বলে ঠাকুরকে দেখতে এসে কিছুজন একতলার হলঘরে বসেছেন। বাকিরা সকলে বাগানে বসে আছেন। তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন যে ঠাকুর আগের মতো দোতলার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছেন, সঙ্গে লাটু মহারাজকে নিয়ে। ঠাকুরের সাজ ছিল সেদিন অপরূপ। পরনে লালপেড়ে ধুতি, গায়ে জামার ওপরে লালপাড় বনাতের একটা চাদর। মাথায় ছিল সবুজ বনাতের কানঢাকা টুপি, পায়ে জুতো আর অপূর্ব স্বর্গীয় মুখশ্রী।
আরও পড়ুন:
বিচিত্রের বৈচিত্র, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় শিষ্যের দর্শন তো রোজ পাওয়া যাবে না/২
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?
তিনি ভক্তদের কাছে এসে গিরীশকে বলেন যে, তিনি ঠাকুরের মধ্যে কী দেখেছেন যে লোকের কাছে এত কথা বলে বেড়ান। গিরীশ ঘোষ যাঁর বিশ্বাস পাঁচ শিকে পাঁচ আনা, উঠে দাঁড়িয়ে জোড়হাতে বলেন, ‘ব্যাস, বাল্মীকি যাঁর সম্বন্ধে বলে শেষ করতে পারেননি, আমি আর কতটুকুই বা বলতে পেরেছি’। একথা শুনে ঠাকুরের দিব্যভাব উদ্বেলিত হয়ে উঠল, তিনি তদ্গতচিত্ত হয়ে ভাবাবিষ্ট হলেন। হঠাৎ অর্ধবাহ্য দশায় মধুর হেসে ধীরে ধীরে ডান হাত ওপরে তুলে সেই মহাযোগীর মুদ্রায় বলে উঠলেন, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক, চৈতন্য হোক’। সকলে উৎসাহের সঙ্গে হুংকার দিয়ে বলে উঠল, ‘জয় রামকৃষ্ণ’। ভক্তের দল আনন্দে কেউ তাঁর পায়ে পড়লেন, কেউ স্তবপাঠ করতে লাগলেন। কেউ বাগানের ফুল দিয়ে অঞ্জলি দিতে লাগলেন। জয়ধ্বনিতে উদ্যানবাটি তখন মুখরিত। এরপর ঠাকুর কারও মাথায় পা রাখলেন, কারও বুকে হাত বুলিয়ে দিলেন, কাউকে স্পর্শ করলেন। সেই মহাভাবের ছোঁয়ায় সকলেরই দিব্যদর্শন হল। তাঁরাও ভাবের ঘোরে জয়রবে আনন্দ করতে লাগলেন। ত্যাগী ভক্তরা ছুটে এসে দেখেন যে, ঠাকুর আবার সহজ অবস্থায় ফিরে আসছেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।