বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

সারদা মায়ের যখন ছ’বছর বয়সে বিয়ে হয়, তখন তাঁর একমাত্র বোন কাদম্বিনী আর এক ভাই প্রসন্নকুমার খুবই ছোট ছিল। বাকি চার ভাই তখনও জন্মায়নি। আজ ভাইফোঁটার পর্বে মা সারদা ও তাঁর ভাইদের কথা শোনা যাক। সারদার বিয়ের আগের রাত্রেও তাঁরা তিন ভাই-বোন একসঙ্গে মাটিতে চাটাই পেতে শুয়েছিল। সারদার বিবাহের পর মা শ্যামাসুন্দরীর কোলে আরও দুটি পুত্রসন্তান আসে উমেশচন্দ্র ও কালীকুমার।
বিয়ের পর যখন জয়রামবাটিতে ঠাকুর প্রথম তাঁর শ্বশুরবাড়ি আসেন। তখন জামাইয়ের আপ্যায়নের জন্য মা শ্যামাসুন্দরীর ব্যস্ততার শেষ নেই। এর মধ্যে বাড়ির ভিতর দাওয়ায় চাটাইয়ের ওপর কাঁথা পেতে কালীকুমারকে রেখে তিনি কাজ সারছিলেন। সারুও আজ গাছকোমর বেঁধে ছোট হাতে ঝাঁটা ধরে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। মনটা তার আজ আনমনা। প্রায় দেড় বছর পর ঠাকুরকে দেখতে পেলেন। ভাই-বোনের সঙ্গে খেলা করার সময় এবং ঘরের কাজে যখনই ঠাকুরের কথা মনে এসেছে, কেমন একটা টান অনুভব করেছেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২২: সুন্দরবনে গোয়াল পুজো আর ‘ধা রে মশা ধা’

শ্যামাসুন্দরী যখন তিরিশের কোঠায় তখন তাঁর সারুর চোদ্দবছরের জন্মদিন। সারদার দুই ভাই প্রসন্ন আর উমেশের তখন খেলাধুলো করার বয়স। মা সারদার আঠারো-উনিশ বছর বয়সকালে পাঁচ ভাই ও দুই বোন মিলে সাত ভাই-বোন তাঁরা। কালীকুমারের পর সারদার আরও দু’জন ভাই হয়, বরদাপ্রসাদ ও অভয়চরণ। এর মাঝে বোন কাদম্বিনীর কোকন্দ গ্রামের সুধারাম চক্রবর্তীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। তার শরীর ভালো নয়, সে মাঝে মাঝেই ভোগে, তখন জয়রামবাটি আসে। বাপের বাড়িতে সারদাই ভাই-বোনদের মানুষ করছেন। শ্যামাসুন্দরী আর সংসারের সব কাজ দেখে উঠতে পারেন না। ভাইরা পড়তে বসলে তাদের পাহারা দেওয়া সারদার রোজকার কাজ।
ছোট দুই ভাই বরদা আর অভয় ওদের দেখতে হয়। পড়া না থাকলে ওদের খাইয়ে দিতে হয়, ঘুমনোর আগে। দক্ষিণেশ্বরে ষোড়শীপুজো হওয়ার একবছরের মধ্যে সারদামার শরীরটা আবার খারাপ হল। পেটের সমস্যা লেগেই আছে। এদিকে ঠাকুরের এখন প্রকৃতিভাবের সাধনা চলছে। মাঝেমধ্যে তিনি সারদার কাছে আবদার করেন তাঁকে সখিবেশে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য। আবার বাপের বাড়িতে ভাইদের প্রতিও সারদার টান আছে। বড়দিদি নামেই, আসলে তো তিনিই তাদের মা। শেষ পর্যন্ত জয়রামবাটিতে যাবার জন্য তিনি মনস্থ করলেন।

কালীমাড়োর সামনের রাস্তা দিয়ে উত্তরে কিছুটা এগিয়েই তিনি বাঁদিকে বাড়ির দোচালা দেখতে পেলেন। বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই খুঁটিতে বাঁধা গরুর পরিচিত ডাক শুনতে পেলেন। অবলা প্রাণীটিও তাঁকে ঠিক চিনতে পেরেছে। সে দঁড়ি টেনে মাথা নেড়ে সারদার কাছে যাবার চেষ্টা করে। সারদা মা কাছে গিয়ে গায়ে হাত বুলিয়ে দেন। এদিকে প্রসন্ন আর উমেশই প্রথমে বুঝতে পারে সারদা এসেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে ছুটে গিয়ে ‘দিদি’ এসেছে বলে হইচই শুরু করে দেয়।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৪: কুর্গের সবুজ দুর্গ

জয়রামবাটিতে ফিরে এসে সারদা সংসারের নিদারুণ দারিদ্র্য টের পায়। বাবা রামচন্দ্রের শরীর ধীরে ধীরে ভাঙছে। অভাবের সংসারে সুরাহার জন্য জনমজুর রেখে চাষের কাজ যা হয়, তাতে কোনরকমে সংসার চলে। রামচন্দ্র নিজের শরীরের হাল ভাল নয় বুঝে তৃতীয় পুত্র কালীকুমারের পৈতে দেবার কথা ভাবেন। অভাবের সংসার হলেও সৎ ব্রাহ্মণের পরিবারে উপনয়নের বিধি- বিধান তো আছে। সারদা নিজের বাবার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে তাঁকে বলেন যে, এত তাড়ার কি আছে, দেরি হলেও করা যায়, তার বিধান তো আছে। কিন্তু রামচন্দ্র রাজি হন না। বরদা আর অভয়ের এখনও পৈতে দেওয়ার বয়স হয়নি। তিনি কালীর পৈতে দিতে চান এখনই। তাছাড়া এখন সারদাও এখানে আছেন। মেয়ে যে তাঁর বড় ভরসার জায়গা।
আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে শেষপর্যন্ত সব কাজ মিটতে মাসখানেক লেগে গেল। তখন চৈত্রমাস, রামচন্দ্র বুঝতে পারছেন, তাঁর সময় হয়ে আসছে। সবাই তা টের পাচ্ছিল। ভাই কালীকুমারের পৈতের পর মাত্র তিনটে দিন পার হয়েছে। বাড়ির দেওয়ালে আঁকা মঙ্গলচিহ্ন স্বস্তিক ও বসুধারা তখনও উজ্জ্বল। এরই মধ্যে সবার আশঙ্কাকে সত্য করে রামগতপ্রাণ রামনবমীর পুণ্যতিথিতে সারদার বাবা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩৭: ঈর্ষার বিষময় পরিণতি, বিচ্ছিন্নতাবোধ, ধ্বংস, এখনও রাজনীতিতে অব্যাহতগতিতে প্রবহমান, নয় কী?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৩: অকালে খেয়েছ কচু, মনে রেখো কিছু কিছু

তারপর নিজের চোখে দুঃসহ অভাবের পরিণতি দেখেন সারদা। তাঁর মাকে সংসার চালানোর জন্য ধান ভানতে যেতে হচ্ছে। এমনকি, রাঁধুনির কাজও করতে হয়েছে। তাতেও যেন সংসারের অভাব কাটছে না। সারদা যতটা পেরেছেন সংসারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাও দেখছেন যে, সকলের মুখে অন্ন যোগাতে না পেরে তাঁর ভাইদের এক-এক করে আত্মীয়দের কাছে পাঠাতে হচ্ছে। প্রসন্ন গেছে জিবটায়, বরদা রয়েছে শিহড়ের হরেরাম ভট্টাচার্যের বাড়িতে। আর সব থেকে ছোট ভাই অভয় পড়া শোনায় ভাল। তাই তাকে ভবিষ্যতে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য মামার বাড়িতে রাখা হয়েছে।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content