শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
সারদা মায়ের বাবা রামচন্দ্রের মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলেরা সকলেই অল্পবয়স্ক ছিল, তাদের সাংসারিক কাজ দেখার মতো সামর্থ্য তখন ছিল না। রামচন্দ্রের মৃত্যুতে পূজার্চনা করে পাওয়া আয় বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেরা চাষের কাজ নিজেরা দেখতে না পারায় জমি থেকে যে ধান পাওয়া যেত, তাতে সারা বছর চলত না। সারদার মামা ঈশ্বরচন্দ্র কলকাতায় পৌরোহিত্য করে যা কিছু উপার্জন করতেন, তাতেও সংসারে আয় দিত না। সারদার মা শ্যামাসুন্দরী সংসার প্রতিপালনের জন্য গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ুজ্যেদের বাড়িতে এক আঢ়া ধান ভানতেন ও তার জন্য চার কুড়ি করে ধান পেতেন। এক আঢ়া মানে ১৬ কুড়ি, এক কুড়ি হল ৪ মান। এক মন ধান হল ২৪ মান। এই হিসেব দিয়েছেন ব্রহ্মচারি অক্ষয়চৈতন্য তাঁর গ্রন্থে। সারদা যখন জয়রামবাটিতে থাকতেন, তখন নিজের মাকে ধানভানার কাজে সাহায্য করতেন। এই বাড়ুজ্যেদের তালপুকুরে সারদা রোজ স্নান করতেন ও পানীয় জল নিয়ে আসতেন।
এ ভাবে দুঃখে কষ্টে কিছু বছর কাটানোর পর শ্যামাসুন্দরী স্বপ্নাদেশে বাড়িতে জগদ্ধাত্রী দেবীর পুজো শুরু করেন। জগদ্ধাত্রীপুজোর প্রসঙ্গে সারদা মা বলেছেন, একবার গ্রামের কালীপুজোর সময় নব মুখুজ্যে তাঁদের সঙ্গে আড়াআড়ি করে পুজোর চাল না নিয়ে ফেরত দিল। পুজোর যোগাড়ের চাল শ্যামাসুন্দরী তৈরি করে রেখেছিলেন। চাল না নেওয়ায় সারদা মায়ের কথায়, ‘মা সমস্ত রাত্রি কেবল কেঁদে চলেছেন আর বলছেন, কালীর জন্যে চাল করেচি, আমার চাল নিলে না? এ চাল আমার কে খাবে? এ কালীর চাল তো কেউ খেতে পারবে না। তারপর রাত্রে দেখেন কী, লালমুখী দেবী দোরগোড়ায় পায়ের উপর পা দিয়ে বসেচেন। তখন ঐ একটি ঘর- বরদার ঘরটি। ঠাকুর এলেও ঐ ঘরে থাকতেন। জগদ্ধাত্রী আমার মাকে গা চাপড়ে চাপড়ে ওঠালেন। উঠিয়ে বললেন, তুমি কাঁদচ কেন? কালীর চাল আমি খাব, তোমার ভাবনা কি? মা বললেন, কে তুমি? জগদ্ধাত্রী বললেন, এই যে গো, এর পরেই পুজো। পরদিন মা আমাকে বলেচেন, ওরে সারদা, লালরঙ, পায়ের উপর পা দিয়ে-ও কি ঠাকুর? জগদ্ধাত্রী? আমি জগদ্ধাত্রীপুজো করব-একটা বাই হয়ে গেল’।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৮: ইষ্টদর্শন
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা
শ্যামাসুন্দরী বিশ্বাসদের কাছ থেকে দু’ আঢ়া ধান আনালেন। তখন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল সারাক্ষণ। শ্যামাসুন্দরী বলেন যে, কি করে তাঁর পুজো হবে, ধানই শুকতে পারা যায়নি। শেষে শ্রীমার কথায়, ‘মা জগদ্ধাত্রী এমন রোদ দিলেন যে, চারিদিকে বৃষ্টি হচ্ছে আর মার চাটাইয়ে রোদ’। কাঠের আগুনে সেঁকে মূর্তি শুকিয়ে রং দেওয়া হল।
এক অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা শিয়াস গ্রামের কুঞ্জ মিস্ত্রির কাছে গিয়ে বলে যে, জয়রামবাটির প্রসন্ন মুখুজ্যের ঘরে জগদ্ধাত্রী গড়তে তোমায় যেতে হবে। যথা সময়ে মিস্ত্রি এসে উপস্থিত হলে সকলে অবাক হয়ে জানতে চায়, কে গিয়েছিল তাকে বলতে? মিস্ত্রি বলে যে, তাঁরা যে একটি মেয়েমানুষ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবার শ্রীমার ভাই প্রসন্ন ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে পুজোর খবর দিতে যান। ঠাকুর শুনে বলে ওঠেন ‘মা আসবেন, মা আসবেন, বেশ বেশ, তোদের বড় খারাপ অবস্থা ছিল যে রে?’ প্রসন্ন বলেন, ‘আপনি যাবেন? আপনাকে নিতে এলুম’। ঠাকুর বলেন, ‘এই আমার যাওয়া হল, যা, বেশ পুজো করগে, বেশ বেশ, তোদের ভাল হবে’। সেই জগদ্ধাত্রীপুজোয় গ্রামসুদ্ধু লোককে খাওয়ানো হল।
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২১: একদা কী করিয়া মিলন হল দোঁহে/ কী ছিল বিধাতার মনে
মা সারদার কথায়, ‘ঐ চালেই সব খরচপত্র কুলিয়ে গেল। প্রতিমা বিসর্জনের সময় মা জগদ্ধাত্রীমূর্তির কানে বলে দিলেন, মা জগাই, আবার আর বছর এসো, আমি তোমার জন্যে সমস্ত বছর ধরে সব যোগাড় করে রাখব। পরের বছর মা আমাকে বললেন, তুমি কিছু দিয়ো, আমার জগাইয়ের পুজো হবে। আমি বল্লুম, অত ল্যাঠা আমি পারব নি, একবার পুজো হল, আবার ল্যাঠা কেন? দরকার নেই, ও পারব না। রাত্রে স্বপ্নে দেখি কি, তিনজন এসে হাজির- জগদ্ধাত্রী, জয়া, বিজয়া। বলচেন, আমরা তবে যাব? আমি বল্লুম, কে তোমরা? বললেন, আমি জগদ্ধাত্রী। বল্লুম, না,না, তোমরা কোথায় যাবে? না,না, কোথা যাবে, তোমরা থাক, তোমাদের যেতে বলিনি’।
মা সারদার বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোয় দেবীর দু’পাশে জয়া ও বিজয়ার মূর্তিরও পুজো হয়। সেইবার থেকে জগদ্ধাত্রী পুজোয় শ্রীমা প্রতিবার জয়রামবাটি চলে আসেন। সারদা মায়ের কথায়, ‘বাসনকোসন মাজতে হয় কিনা। আর তখন তো আমাদের সংসারে লোকজন বেশি ছিল না, বাসন মাজতে আসতুম’। তারপর স্বামি যোগানন্দ পুজোর সব বাসন কাঠের করে দেওয়ায় শ্যামাসুন্দরী মেয়েকে বলেন যে, আর বাসন মাজতে হবে না। জগদ্ধাত্রীপুজোর জমিও করে দিলেন।
এই প্রসঙ্গে সারদা মায়ের ভাই কালী মুখুজ্যে বলেন যে, প্রথম চার বছর তাঁর মায়ের নামে পুজোর সঙ্কল্প হয়। পরের চার বছর তাঁর দিদির নামে, তার পরের চার বছর খুড়ো নীলমাধবের নামে পুজো হয়। স্বামি যোখানন্দ কাঠের বারকোষ, লট্কন, সিংহাসনের চৌকি প্রভৃতি অনেক জিনিস করে দিয়েছিলেন। আর তিনশ টাকা দিয়ে পুজোর জন্য তিন বিঘে জমি কিনে দেন।
এই প্রসঙ্গে সারদা মায়ের ভাই কালী মুখুজ্যে বলেন যে, প্রথম চার বছর তাঁর মায়ের নামে পুজোর সঙ্কল্প হয়। পরের চার বছর তাঁর দিদির নামে, তার পরের চার বছর খুড়ো নীলমাধবের নামে পুজো হয়। স্বামি যোখানন্দ কাঠের বারকোষ, লট্কন, সিংহাসনের চৌকি প্রভৃতি অনেক জিনিস করে দিয়েছিলেন। আর তিনশ টাকা দিয়ে পুজোর জন্য তিন বিঘে জমি কিনে দেন।
আরও পড়ুন:
কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৩: উইলসন-এ-কথা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
বার বছর পুজো হবার পর ইন্দুমতী দেবী যিনি সারদাকে ‘মা’ বলতেন, বলেন যে, শ্রীমা বললেন, সবাইর নামে পুজো হল, আর পুজো করবেন না, তাঁরা আর মাকে আনতে পারবেন না। সেই রাতে আবার দেবী শ্রীমাকে এখন যেখানে শ্রীমায়ের বাড়ি হয়েছে, সেই স্থানে দেখা দিয়ে বলেন, ‘তবে আমি যাই সদুরা আনবে বলছে, তবে ওদের ঘরে যাই? সদু অর্থাৎ মধু মুখুজ্যের পিসি। তখন শ্রীমা নিজের গলায় কাপড় দিয়ে দেবীর পা জড়িয়ে ধরে বলেন ‘না, মা তিনসত্য করে বুঝি চলে যাচ্চ এখান থেকে? আমি আর ছাড়ব না তোমাকে। আমি বছর বছর তোমাকে আনব’। এরপর শ্রীমা নিজে তাঁর ইষ্টদেবীর নামে নয়বিঘা জমি দেবত্র করে দেন। তাঁর ভাইয়েরা সেই জমি চাষ করে প্রতি বছর প্রত্যেকে দেড় আঢ়া করে সাড়ে চার আঢ়া ধান জগদ্ধাত্রীপুজোয় দেবেন, এমন ব্যবস্থা শরৎ মহারাজ করে গিয়েছিলেন।—চলবে
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।