মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


দক্ষিণেশ্বরে কালীমন্দিরের আরতি দেখার সুযোগও সারদা সবসময় পেতেন না। একদিন তিনি মা জগদীশ্বরীর জন্য খুব যত্ন করে রঙ্গন ও জুঁইফুলের সাতলহরি মালা গেঁথে কালীমায়ের সজ্জাকরের কাছে পাঠালেন মাকে পরানোর জন্য। মন্দিরের বেশকারির কি মনে হল, সে মাকালীর সোনার গয়না খুলে সারদা মায়ের গাঁথা মালা দিয়েই সাজিয়ে দেয়। ঠাকুর সেদিন মায়ের মন্দিরে গিয়ে মায়ের রূপ দেখে আনন্দে বিভোর হয়ে বললেন, ‘আহা, মায়ের কালো অঙ্গে কি সুন্দর মানিয়েছে। কে দিলে এই মালা’? সারদা মালা গেঁথেছেন জেনে ঠাকুর খুব প্রসন্ন হয়ে বললেন, ‘ ডাক, তাকে ডেকে নিয়ে আয়, ওঁর গাঁথা মালায় মাকে কি অপরূপ দেখাচ্ছে, তা নিজের চোখে দেখে যাক’।

পরিচারিকা বৃন্দা ছুটে গিয়ে সারদাকে এই খুশির খবর দিল যে ঠাকুর ডাকছেন। একথা শুনে সারদা তাঁর মনের খুশি চেপে রেখে গেলেন মন্দিরে বৃন্দার সঙ্গে। কিন্তু সামনে বলরাম আর সুরেনকে দেখে লজ্জায় মন্দিরে যাওয়ার পেছনের সিঁড়ির পথ ধরলেন যা ঠাকুরের দৃষ্টি এড়াল না। তিনি তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘ও কি করছ, না, না সামনে দিয়ে এস। দেখ, আজ তোমার মালায় মা কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছেন’। এ দিকে মাকালীর মুখে মা সারদা দেখলেন স্বয়ং ঠাকুরের মুখ, যা দেখে তিনি আত্মহারা হয়ে গেলেন।
অল্প পরিসরে সারদার থাকতে কষ্ট হয় দেখে ঠাকুরের রসদ্দার শম্ভুচরণ মল্লিক মায়ের মন্দিরের কাছে কিছু জমি আড়াইশো টাকায় কিনে নেন। শম্ভুবাবুর স্ত্রী সারদা মাকে দেবীজ্ঞানে ভক্তি করতেন। মার দক্ষিণেশ্বরে থাকার কালে প্রতি জয়মঙ্গলবার মাকে নিজ গৃহে নিয়ে এসে ষোড়শোপচারে পুজো করতেন। শম্ভু মল্লিক নেপালের রাজকর্মচারি ক্যাপ্টেন বিশ্বনাথ উপাধ্যায়ের থেকে শালকাঠ নিয়ে সারদার নিবাসের জন্য একখানা চালাঘর তৈরি করে দেন। সেখানে সবসময় তাঁর সঙ্গে থাকার জন্য একজন পরিচারিকারও ব্যবস্থা করেন। এই চালাঘরে শ্রীমা নিছের হাতে রোজ ঠাকুরের জন্য নানাপ্রকার রান্না করতেন। আর খাওয়ার সময় নিজে খাবার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরের কাছে বসে থেকে খাওয়াতেন। সারদার প্রসন্নতার জন্য ঠাকুরও মাঝে মাঝে দিনের বেলায় চালাঘরে যেতেন।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

একদিন বিকেলে ঠাকুর সেই ঘরে আসার পর অনেক রাত অবধি বৃষ্টি হতে থাকায় বাধ্য হয়ে তাঁকে রাতে থেকে যেতে হল। সেই রাতে মা ঠাকুরকে ঝোলভাত রেঁধে খাইয়েছিলেন। ঠাকুর সারদার সেবা দেখে সে-দিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন যে, মা কালীর বামুনরা রাতে বাড়ি যায় না? যেন তাই এখানে এসেছেন। সারদা নিকুঞ্জদেবীকে বলেছিলেন, ‘শম্ভু মল্লিক থাকার জন্যে ঘর করে দিলে, তা বৌমা, সেখানে থাকতে মন চাইত না। সেই শুনে ঠাকুর হৃদয়কে বললেন, হৃদু, তবে তোর স্ত্রীকে আন। শুনে হৃদু বললে, আমার স্ত্রীর জন্যে কি শম্ভু বাড়ি করে দিলে?’
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

একবছর ওই ঘরে থাকার পর সারদা কঠিন আমাশয় রোগে আক্রান্ত হন। শম্ভুবাবুর প্রচেষ্টায় ডাক্তার গঙ্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সারদা মায়ের চিকিৎসা করেন। রোগ কিছুটা সারলে মা বায়ু পরিবর্তনের জন্য আশ্বিন মাসে জয়রামবাটি ফিরে আসেন। সেখানে গিয়ে আবার রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি একেবারে শয্যাশায়ি হয়ে পড়লেন। এমনকি প্রাণ সংশয়ও দেখা দিল। সেই সময় মাকে বারবার ঘরের কাছে কলুপুকুরে শৌচে যেতে হত। সারদা এতই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে ওঠার ক্ষমতা না থাকায় পুকুরপাড়েই পড়ে থাকতেন। পুকুরের জলে নিজের রুগ্ন দেহের প্রতিবিম্ব দেখে তাঁর মনে দেহত্যাগের পর্যন্ত ইচ্ছা হয়। এরপর রোগ উপশমের জন্য শ্রীমা গ্রামদেবী সিংহবাহিনীর দ্বারে হত্যা দেন।

মা সারদার কথায়, হত্যা দেবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ‘তুমি কেন এখানে পড়ে আছ’ বলে মা সিংহবাহিনী তাঁকে তুলে দেন। মা সিংহবাহিনী ওষুধরূপে তাঁকে ওলতলার খানিক মাটি গ্রহণ করতে আদেশ করেন। সেই আদেশ পালনের পরই শোনা যায় মার শরীর ক্রমে সুস্থসবল হয়ে ওঠে। তারপর থেকে মা সর্বদা নিজের কাছে দেবী সিংহবাহিনীর মাটি রাখতেন আর রোজ তার থেকে কিঞ্চিৎ খেতেন।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১৩: সাগর দীঘির ধারে হিরণ্যগর্ভ শিবমন্দির ও মধুপুর ধাম

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

এর আগে জয়রামবাটির পাশের গ্রামের লোকেরা সিংহবাহিনীর কথা তেমন জানত না। সারদা মা হত্যা দিয়ে পড়ে থাকায় ও তাঁর অসুখ সারলে নিজ গ্রামদেবীর মাহাত্ম্য চারদিকে প্রচারিত হয় জাগ্রতাদেবীরূপে। লোকে তাঁর কাছে মানত করে সফল হচ্ছে, এই আশায় পূজাপ্রার্থী লোকের আগমনে ক্রমে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিতহয়ে উঠল। এ বিষয়ে মা বলেছিলেন যে, তাঁর শরীর তখন ফুলে গিয়েছিল, নাক, কান দিয়ে রস গড়াত। তাঁর ভাই উমেশই সিংহবাহিনীর কাছে হত্যা দেবার জন্য বলে। চোখ দিয়ে জল পড়ে ভালো দেখতে পেতেন না। উমেশই মাকে ধরে সেখানে নিয়ে যায়।

সারদা দেবীর মাড়োতে পড়ে রইলেন। তার মধ্যে তিন-চার বার তাঁকে বাহ্যে যেতে হয়। উমেশের ভিক্ষে মা সেখানে থাকতেন। তিনি মাঝে মাঝে আওয়াজ দিয়ে সারদাকে সান্ত্বনা দিতেন। তিনি সারদার মাকে খবর দিয়ে ঘরে তুলে আনতে বলেন। অমন অসুখে ফেলে রাখতে নেই, একথা শ্যামাসুন্দরীকে বলেন। আর শ্রীমাকে বললেন, লাউফুলের রসের চোখে টোপ দিতে। সারদা বললেন যে, সেই ওষুধে যেমনভাবে জাল টেনে নেয়, তেমন চোখের সব ময়লা টেনে বার করে দিল। সেদিনই শ্রীমার শরীরের ফোলা ভাব কমে গিয়ে শরীর ঝরঝরে হয়ে গেল। তিনি ধীরে ধীরে সেরে উঠলেন। কেউ জিজ্ঞাসা করলে সারদা তাকে বলতেন, ‘মা ওষুধ দিয়েছেন। সেই হতেই মা সিংহবাহিনীর মাহাত্ম্য প্রচার হল, আমিও ওষুধ পেলুম জগৎও ধন্য হল।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content