মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


শ্রীমা।

ফলহারিণী পুজোর দিন সারদা মাকে দশমহাবিদ্যা ষোড়শী জ্ঞানে ঠাকুরের পুজো করার পর সারদা এক বছরের বেশি সময় দক্ষিণেশ্বরে অবস্থান করেন। কিন্তু কলকাতার জলবায়ু সারদার বেশিদিন সহ্য হল না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এরপর তিনি কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটিতে ফিরে আসেন। কখনও শ্বশুরবাড়ি, কখনও বাপের বাড়িতে সারদা মা যাওয়া আসা করতে লাগলেন। তাঁর গ্রামে ফেরার পর ২৭ অগ্রহায়ণ, ১২৮০ সালে ঠাকুরের মেজদাদা রামেশ্বরের মৃত্যু হয়। সেই বছরেই রামনবমী তিথিতে তাঁর পিতা রামচন্দ্র দেহত্যাগ করেন। স্নেহপরায়ণ পিতৃবিহনে কন্যা সারদার শোকবিহ্বল হওয়া খুব স্বাভাবিক।
এর মধ্যে একবার পাড়ার ভূষণ মণ্ডলের মা এসে সারদাকে জানান যে, গ্রামের কয়েক জন মহিলা কলকাতায় গঙ্গাস্নানে যাচ্ছে। সারদা মায়ের মন তেমন ভালো ছিল না, তাঁর কাছে আবার সুযোগ এসে গেল দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার। তিনি তাঁর ভাসুরপো আর ভাসুরঝি শিবুদাদা ও লক্ষ্মীদিদিকে রাজি করালেন সঙ্গে যাবার জন্য। তারপর সঙ্গী মহিলাদের সঙ্গে আবার সেই সুদীর্ঘ পায়ে হাঁটা পথে যাত্রা করলেন। কামারপুকুর থেকে আট মাইল পরে আরামবাগ। সেখান থেকে প্রায় দশ মাইল পরে তেপান্তরের মাঠ। এ কোনও রূপকথার মাঠ নয়। দিনের বেলাতেই এই স্থান জনবিরল। রাতের অন্ধকারে এই মাঠ আরও ভয়াবহ হয়ে যায়। এই হল সেই কুখ্যাত তেলোভেলোর ডাকাত প্রান্তর। এই মাঠের দু’মাইল পরে ডাকাতকালীর থান আছে। রাত হতেই সেই কালীর থানে পুজো দিয়ে বাগদি ডাকাতের দল শিকার করতে বেরিয়ে পড়ে। তাই পথচারি ও তীর্থযাত্রিরা দলবেঁধে চেষ্টা করে দিন থাকতেই এই মাঠ পেরিয়ে যাবার জন্য।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…

তারপর পরে তারকেশ্বর। আরামবাগ পেরতেই সারদা ক্লান্ত হয়ে পড়লেন। দীর্ঘ পথের যাত্রা শ্রীমার শরীরে সয় না। ক্লান্ত চরণে তিনি সঙ্গীদের থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। তাই দেখে তাঁর সঙ্গীরা তাড়া দিচ্ছেন। সূর্যাস্তের আগেই যে এই ভয়ঙ্কর মাঠ পেরতে হবে। সারদা তাঁর জন্য দেরি না করে সঙ্গী মহিলাদের এগিয়ে যেতে বললেন। এমনকি, তাঁর ভাসুরঝি আর ভাসুরপোও তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে সঙ্গীদের সঙ্গে এগিয়ে গেলেন।

এখন সেই জনমানবহীন পথ দিয়ে অদম্য মনোবল নিয়ে সারদা একাকি হেঁটে চললেন। এই মনোবল যে তিনি কি করে পেলেন, তা একমাত্র মা সারদাই জানেন। হঠাৎ সারদার সামনে এসে দাঁড়াল লম্বা, ঘনকালো কোঁকড়া চুল এক ভীষণদর্শন মূর্তি।

শ্রীমার মুখেই শোনা যাক সেই ভয়ানক ঘটনার কথা। শ্রীমার কথায়, ‘কখনও তো ওদের মতো চলার অভ্যেস নেই। তবু ধিকি ধিকি চলতে লাগলুম। একা সেই তেপান্তরের মাঠে চলেছি। ওখানে বড় ডাকাতের ভয়। অনেক গল্প ছেলেবেলায় শুনেছি। সন্ধে হয়ে গেল তবু চলেছি। গা ছমছম করছে। এমন সময় দেখতে পেলুম, সামনে একটা লোক, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। হাতে রূপোর বালা, খুব ঢেঙা, লাঠি হাতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি থমকে দাঁড়ালুম। গোটা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। লোকটা কাছে এসে হাঁক পাড়ল, কে এখানে এ সময় দাঁড়িয়ে? সারদা দৃঢ় অথচ কোমল গলায় বললেন, বাবা, আমার সঙ্গীরা আমাকে ফেলে গিয়েছে। আমি বোধহয় পথ হারিয়েছি। তুমি আমাকে সঙ্গে করে তাদের কাছে পৌঁছে দেবে? তোমার জামাই দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়িতে থাকেন। আমি তাঁর কাছেই যাচ্ছি। তুমি আমায় সঙ্গে করে সেখানে পৌঁছে দাও। দেখবে, তিনি তোমাকে খুব আদরযত্ন করবেন’। এই সময় পিছন থেকে এক নারী মূর্তি এসে উপস্থিত হল। সে হল দস্যুর সঙ্গিনী। সারদা অকুণ্ঠ চিত্তে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে বললেন, ‘মা, আমি তোমার মেয়ে সারদা। সঙ্গীরা ফেলে যাওয়ায় ভীষণ বিপদে পড়েছিলুম। ভাগ্যে বাবা আর তুমি এসে পড়লে’।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

ডাকাতের কবলে পড়লে এমন সকলেই বলে, তাতে ডাকাতদের মনে রেখাপাত করে না। কিন্তু সারদার কথায় কি যে শক্তি ছিল, তারা দু’জন সস্নেহে তাঁকে মেয়ের মতো কাছে টেনে নিয়ে অভয় দিল। তারপর ক্ষুধার্ত সারদাকে মাঠের প্রান্তের এক দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজেদের পয়সায় মুড়ি-মুড়কি কিনে খাওয়াল। ডাকাতের ঘরণী সেখানে একখানা কাপড় বিছিয়ে মেয়ের মতো সারদার সঙ্গে রাতে শুয়ে পড়ল। সারদাও মায়ের আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যেহেতু এই স্থান ডাকাতদের বিচরণক্ষেত্র, তাই ডাকাত বাবা নিজে না ঘুমিয়ে সারা রাত পাহারা দিল। ভোর হতেই তারা সারদাকে নিয়ে তারকেশ্বরের পথে চলল।

ডাকাত মা বলল, ‘কাল রাতে মেয়ের মুড়ি ছাড়া তো কিছু খাওয়া হয়নি। তুমি যাও, কাছের বাজার থেকে মাছ, তরকারি কিনে নিয়ে এস। মেয়েকে আজ নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াব। দস্যু ছুটল বাজারে আর ভালো করে বাজার থেকে সামগ্রী নিয়ে এল। এদিকে মা সারদার সঙ্গীরা তাঁকে খুঁজতে তারকেশ্বরে এসে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করল। সারদা সবাইকে তাঁর ডাকাত মা-বাবা ও তাদের আদর যত্নের কথা বিস্তারিত ভাবে বললেন। শুনে সকলে অবাক হয়ে গেল। এবার মা, বাবার কাছ থেকে বিদায় নিলেন সারদা, তাঁর চোখে জল। ডাকাত মা-বাবার চোখেও জল। তারা দু’ জনেই কিছুদূর এগিয়ে দিল সারদা ও তাঁর সঙ্গীদের। পথের পাশের ক্ষেত থেকে কিছু কড়াইশুঁটি নিয়ে ডাকাত মা মেয়ে সারদার আঁচলে বেঁধে দিয়ে বলল, ‘রাতে যখন মুড়ি খাবি, তখন এইগুলো দিয়ে খাস’। সারদা মা তাদের দক্ষিণেশ্বরে আসার জন্য অনুরোধ করেন।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

মেয়ে সারদার অনুরোধ তারা রেখেছে, একবার নয়। অনেকবার দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন আর প্রতিবারই মেয়ে ও জামাইয়ের জন্য নাড়ু, মোয়া নিয়ে গিয়েছেন। ঠাকুরও শ্রীমার মুখে সব বৃত্তান্ত শুনে মুগ্ধ হলেন। তিনিও ওঁরা এলে নিজ শ্বশুর-শাশুড়ির মতোই আপ্যায়ন করতেন।

একদিন সারদা তাঁদের কাছে জানতে চাইলেন যে, কেন তারা সারদাকে এত স্নেহ করেন। প্রত্যুত্তরে আর গোপন করতে না পেরে ডাকাত বাবা বলেছিলেন যে, তারা ঘোর পাপী বলে মা তাদের প্রকৃত স্বরূপ দেখাননি। নিজের আসল রূপ গোপন রেখেছিলেন। কিন্তু তারা পরে সারদা মাকে কালী রূপে দেখেছিলেন। অনেকে শ্রীমার কাছে এই অবাককরা ঘটনা শুনতে চাইত। প্রথম-প্রথম সারদা শোনাতেন। পরে আর বলতে চাইতেন না। কারণ, তাঁর ভাসুরপো, ভাইঝিও তাঁকে ফেলে চলে যায়। মায়ের কথায়, ‘এখন এই কথা মনে পড়লে মনস্তাপ হয়। হাজার হোক আমারই তো ভাসুরপো, ভাইঝি। ও কথা বারবার বললে ওদের অপমান করা হয়’।

এই হলেন প্রকৃত জননী সারদা, যারা তাঁকে ভয়ঙ্কর প্রান্তরে একা রেখে চলে গেল। তাদের অপমান করতেও শ্রীমার মন সায় দেয় না।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।

Skip to content