শ্রীশ্রী মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।
পল্লী বাংলার মেয়েরা ছোট বয়স থেকেই রন্ধনে নিপুণা হয়। সারদাও গৃহস্থালি কর্মে শৈশবেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। প্রত্যহ ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করে তিনি নিজের মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতেন। মা রান্না করতে না পারলে তিনি নিজেই রান্না করতেন। কেবল কচি হাতে ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামাতে পারতেন না, তাঁর পিতাকে নামিয়ে দিতে হত।
সারদার পাঁচ ভাই প্রসন্ন, উমেশ, কালীকুমার, বরদাপ্রসাদ এবং অভয় গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যেতেন। সে-সময় স্ত্রীশিক্ষার তেমন প্রচলন সমাজে ছিল না, গ্রামে তো নয়ই। কিন্তু সারদা মায়ের আজীবন শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ছিল। তাই তিনি ছোটবেলায় ভাইদের সঙ্গে মাঝে মাঝে পাঠশালায় যেতেন। সেখানে কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। বিবাহোত্তর কালে মা আর ঠাকুরের মেজ দাদা রামেশ্বরের মেয়ে লক্ষ্মীমণির সঙ্গে বর্ণপরিচয় পড়তেন।
ঠাকুরের নিজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাগানের কর্মচারি পীতাম্বর ভাণ্ডারির এগারো বছরের ছেলে শরতের সাহায্যে সারদা ও লক্ষ্মী বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ অবধি পড়েছিলেন। তবে নিজের শিক্ষা বিষয়ে মা শরতের নাম করেননি, তাই তার সাহায্য লক্ষ্মী যতটা পেয়েছিলেন, সারদার ততটা সুযোগ হয়নি।
সারদার পাঁচ ভাই প্রসন্ন, উমেশ, কালীকুমার, বরদাপ্রসাদ এবং অভয় গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যেতেন। সে-সময় স্ত্রীশিক্ষার তেমন প্রচলন সমাজে ছিল না, গ্রামে তো নয়ই। কিন্তু সারদা মায়ের আজীবন শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ছিল। তাই তিনি ছোটবেলায় ভাইদের সঙ্গে মাঝে মাঝে পাঠশালায় যেতেন। সেখানে কিছু অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল। বিবাহোত্তর কালে মা আর ঠাকুরের মেজ দাদা রামেশ্বরের মেয়ে লক্ষ্মীমণির সঙ্গে বর্ণপরিচয় পড়তেন।
ঠাকুরের নিজ ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাগানের কর্মচারি পীতাম্বর ভাণ্ডারির এগারো বছরের ছেলে শরতের সাহায্যে সারদা ও লক্ষ্মী বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ অবধি পড়েছিলেন। তবে নিজের শিক্ষা বিষয়ে মা শরতের নাম করেননি, তাই তার সাহায্য লক্ষ্মী যতটা পেয়েছিলেন, সারদার ততটা সুযোগ হয়নি।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখনীয় যে, ঠাকুর নিজে পুঁথিগত বিদ্যাকে বলতেন ‘চালকলা বাঁধা বিদ্যা’। তার কারণ তাঁরা ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের বংশ, পড়ে-লিখে দক্ষিণা গ্রহণকারি পৌরোহিত্যই করতে হবে। এই বিদ্যা তো আসলে ‘অপরা বিদ্যা’। এই বিষয়ে খুব সহজভাবে একটু দার্শনিক প্রসঙ্গের আলোচনা করা যাক। কেন ঠাকুর পুঁথিগত শিক্ষাকে পছন্দ করতেন না, তা বোঝা দরকার। আমাদের জ্ঞান চার প্রকারে হয়ে থাকে।
পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে যখন জাগতিক বিষয়ের সরাসরি যোগ হয়, তখন আমরা প্রত্যক্ষজ্ঞান লাভ করি। বাকি তিনটি জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। যেমন প্রত্যক্ষজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে আমরা কিছু অনুমান করে থাকি, যাকে দার্শনিক ভাষায় অনুমিতি বলে। আবার প্রত্যক্ষজ্ঞানের ওপর নির্ভর করেই আমাদের একটি বস্তুর সঙ্গে অপর একটি বস্তুর সাদৃশ্য জ্ঞান হয়, যাকে তুলনাত্মক জ্ঞান বলে। বাকি রইল শাব্দ জ্ঞান। যা শব্দোচ্চারণের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে বা বই পড়ে শব্দার্থজ্ঞানের মাধ্যমে হয়। অতএব শাস্ত্রের জ্ঞানও শাব্দ জ্ঞানই।
পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সঙ্গে যখন জাগতিক বিষয়ের সরাসরি যোগ হয়, তখন আমরা প্রত্যক্ষজ্ঞান লাভ করি। বাকি তিনটি জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল। যেমন প্রত্যক্ষজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে আমরা কিছু অনুমান করে থাকি, যাকে দার্শনিক ভাষায় অনুমিতি বলে। আবার প্রত্যক্ষজ্ঞানের ওপর নির্ভর করেই আমাদের একটি বস্তুর সঙ্গে অপর একটি বস্তুর সাদৃশ্য জ্ঞান হয়, যাকে তুলনাত্মক জ্ঞান বলে। বাকি রইল শাব্দ জ্ঞান। যা শব্দোচ্চারণের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে বা বই পড়ে শব্দার্থজ্ঞানের মাধ্যমে হয়। অতএব শাস্ত্রের জ্ঞানও শাব্দ জ্ঞানই।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু
লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৬: হিচককের সাইকো—ম্যারিয়নের স্নান ও নর্মা-র মৃতদেহ
এই চারপ্রকার জ্ঞানকেই উপনিষদ বা বেদান্তদর্শন নিকৃষ্টজ্ঞান বা অপরা বিদ্যা বলেছে। হ্যাঁ, জাগতিক বিষয় জানার জন্য মানুষের এই চারটি জ্ঞানই আবশ্যিক। তা না হলে জাগতিক ব্যবহার সম্ভব নয়। কিন্তু এই চারটি জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ নিজেকে জানতে পারে না, অর্থাৎ নিজ আত্মচেতনার বোধ হয় না। দর্শনে একমাত্র আত্মচৈতন্যের জ্ঞানকেই পরা বিদ্যা বা শ্রেষ্ঠজ্ঞান বলা হয়েছে।
ঠাকুর জন্ম থেকেই ছিলেন আত্মচৈতন্যের আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁর যে ভাবসমাধি, তা তো তাঁর আত্মবোধে একীভূত হওয়ারই দৃষ্টান্ত। তবে সাধারণ মানুষের বোধে ঠাকুর যে একজন আত্মজ্ঞানী, তা বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই সকলে তাঁর আচরণে অসঙ্গতি দেখতেন নিজেদের অজ্ঞতার জন্য। সেই পরাবিদ্যার যিনি শ্রেষ্ঠ সাধক পরমহংস, তিনি কেন অপরা বিদ্যারূপী অক্ষর শিক্ষা করবেন! যে প্রসঙ্গে এই বিষয়ের অবতারণা, সেখানে আবার ফিরে যাই। এখানে লক্ষণীয় হল যে ঠাকুর নিজে সারদা মা ও লক্ষ্মীর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। যে সমাজ তখনও স্ত্রী শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়নি। ঠাকুর সেখানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
ঠাকুর জন্ম থেকেই ছিলেন আত্মচৈতন্যের আলোয় উদ্ভাসিত। তাঁর যে ভাবসমাধি, তা তো তাঁর আত্মবোধে একীভূত হওয়ারই দৃষ্টান্ত। তবে সাধারণ মানুষের বোধে ঠাকুর যে একজন আত্মজ্ঞানী, তা বোঝা সম্ভব ছিল না। তাই সকলে তাঁর আচরণে অসঙ্গতি দেখতেন নিজেদের অজ্ঞতার জন্য। সেই পরাবিদ্যার যিনি শ্রেষ্ঠ সাধক পরমহংস, তিনি কেন অপরা বিদ্যারূপী অক্ষর শিক্ষা করবেন! যে প্রসঙ্গে এই বিষয়ের অবতারণা, সেখানে আবার ফিরে যাই। এখানে লক্ষণীয় হল যে ঠাকুর নিজে সারদা মা ও লক্ষ্মীর শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। যে সমাজ তখনও স্ত্রী শিক্ষার স্বীকৃতি দেয়নি। ঠাকুর সেখানে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
আরও পড়ুন:
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৫: আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কী?
এমনকি, ঠাকুরের ভাগ্নে হৃদয় সারদার থেকে বই কেড়ে নিয়ে বলেছিলেন, মেয়েদের বই পড়তে নেই, শেষে কি নাটক-নভেল লিখবে? লক্ষ্মী বই ছাড়েননি। বাড়ির মেয়ে বলে তাঁকে হৃদয় জোর করতে পারেননি। সারদা পরে লুকিয়ে আবার বই কিনে আনিয়েছিলেন। তখন লক্ষ্মী পাঠশালায় গিয়ে পড়ে এসে মাকে পড়াতেন। শিক্ষার প্রতি মায়ের অনুরাগ ঠাকুরও বুঝেছিলেন, তাই মুখে কিছু না বললেও ভাগনের মামীর প্রতি ব্যবহারে তিনি ব্যথা পেয়েছিলেন। মা কিন্ তু তাঁর স্বভাবগুণে ভাগ্নে হৃদয়ের এতে কোনও দোষই দেখেননি।
ঠাকুর যখন চিকিৎসার জন্যে শ্যামপুকুরে ছিলেন, তখন ভব মুখুজ্যেদের একটি মেয়ে রোজ সারদার সঙ্গে গঙ্গাস্নানের কালে মাকে পড়াত এবং আগের পড়া ধরত। মা মুঠো করে পয়সা দিতেন বলে সকলে ভাবত তিনি গুণতে জানেন না। একবার দারুণ গ্রীষ্মকালে এক ভক্ত কলকাতা থেকে কিছু মিঠে কাঁচা আম জয়রামবাটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মা তাঁকে পান্তাভাত খেতে দিয়ে নিজে আম গুণতে গিয়ে বারংবার ছয় পর্যন্ত গুণে গুলিয়ে ফেলছিলেন। শেষে বললেন, ‘বাবা, তুমি গুণে নাও’। আবার হয়তো, কোনও ভক্তের কাছে জানতে চেয়েছেন, ছয় গণ্ডায় কত হয়। ভক্তের উত্তর শুনে তিনি শিশুর মতো হেসে উঠেছেন। অথচ সারদা মা তাঁর দীক্ষিত ভক্তকে ১০৮ বার জপের সংখ্যা বুঝিয়ে দিয়েছেন। নিজেরও লক্ষ জপের সংখ্যার হিসেব মা রাখতেন।
ঠাকুর যখন চিকিৎসার জন্যে শ্যামপুকুরে ছিলেন, তখন ভব মুখুজ্যেদের একটি মেয়ে রোজ সারদার সঙ্গে গঙ্গাস্নানের কালে মাকে পড়াত এবং আগের পড়া ধরত। মা মুঠো করে পয়সা দিতেন বলে সকলে ভাবত তিনি গুণতে জানেন না। একবার দারুণ গ্রীষ্মকালে এক ভক্ত কলকাতা থেকে কিছু মিঠে কাঁচা আম জয়রামবাটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মা তাঁকে পান্তাভাত খেতে দিয়ে নিজে আম গুণতে গিয়ে বারংবার ছয় পর্যন্ত গুণে গুলিয়ে ফেলছিলেন। শেষে বললেন, ‘বাবা, তুমি গুণে নাও’। আবার হয়তো, কোনও ভক্তের কাছে জানতে চেয়েছেন, ছয় গণ্ডায় কত হয়। ভক্তের উত্তর শুনে তিনি শিশুর মতো হেসে উঠেছেন। অথচ সারদা মা তাঁর দীক্ষিত ভক্তকে ১০৮ বার জপের সংখ্যা বুঝিয়ে দিয়েছেন। নিজেরও লক্ষ জপের সংখ্যার হিসেব মা রাখতেন।
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২২: কেস কালাদেও: ফাইল নম্বর ১
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৩: স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়-বন্ধু সকলের কাছে সব কথা না বললেই শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকে সংসারে
আসলে অবগুণ্ঠনবতী অন্তর্যামী সারদা মা নিজের দৈব স্বরূপকে গোপন রাখতে পারতেন। কখনও তা কারও কাছে প্রকাশ পেলে, তারা স্বরূপ সহ্য করতে পারত না। যেমন একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, মায়ের বাল্যসখী অঘোরমণি একবার জয়রামবাটিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় রামহৃদয় ঘোষাল উপস্থিত ছিলেন। ছোট্ট সারদাকে জগদ্ধাত্রীর সামনে ধ্যান করতে দেখে তিনি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ দেখতে লাগলেন। কিন্তু কে যে জগদ্ধাত্রী আর কে মা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তখন ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন। মায়ের লুক্কায়িত প্রকৃত স্বরূপ চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল বলেই তিনি ভয় পেয়েছিলেন।—চলবে।
* আলোকের ঝর্ণাধারায় (sarada-devi): ড. মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় (Dr. Mousumi Chattopadhyay), অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, বেথুন কলেজ।