শোণনদের তীরে রাত্রি হল ভোর। প্রভাতী আলোয় আবার শুরু হল পথ চলার প্রস্তুতি। যেতে হবে সেই মিথিলা নগরী। এবার শোণ নদ পার হতে হবে। নদের জল কোথাও কোথাও অগভীর, পার হওয়া দুষ্কর নয়। নদ পার হয়ে ঋষিদের সঙ্গে রাম লক্ষ্মণ আবার শুরু করলেন পথ চলা। সারাদিন বহু পথ পাড়ি দিয়ে দিনের শেষে তাঁরা এসে পৌঁছলেন আর এক নদীর তীরে। ত্রিলোক যার স্পর্শে পবিত্র, ধন্য, সেই জাহ্নবী সুরলোক থেকে সমুদ্রগামিনী হয়ে বয়ে চলেছেন তাঁদের সামনে দিয়ে। পুণ্যসলিলা, নদীশ্রেষ্ঠ জাহ্নবীর কলকল্লোল ভেঙে দিচ্ছে রাতের স্তব্ধতা। স্নান, অগ্নিহোত্র সেরে সকলে বসলেন বিশ্বামিত্রকে ঘিরে। গঙ্গা ছিলেন সুরনদী, নেমে এলেন মর্ত্যলোকে, এসে অতল সাগরে মিশে গেলেন— এ যাত্রাপ্রবাহের অন্তরালে বিশেষ কোনও আখ্যান আছে না কি? রামের প্রশ্নে বিশ্বামিত্র আরম্ভ করলেন গঙ্গার কাহিনী। ভারতবর্ষের হৃদয় জুড়ে তাঁর স্থিতি। তাঁকে না জানলে এ দেশ, এই ভূমিকে চেনা হয় না যে!
প্রথমে বললেন তিনি গঙ্গার জন্মকথা। সেও এক পুরাণকথা। পর্বতরাজ তুষারমৌলি হিমালয়। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা গঙ্গা। হিমালয়পত্নী মেরুরাজকন্যা মনোরমার কোলে জন্মেছিলেন দুই অতুলনীয় কন্যারত্ন — নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা আর দেবীশ্রেষ্ঠা উমা। ত্রিপথগামিনী গঙ্গাকে নিজেদের কল্যাণকাজে সহায়রূপে চাইলেন দেবতারা। হিমালয় আপত্তি করেননি তাতে। এরপর নগাধিরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যাটি সুরলোকে বইতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি মর্ত্যে এলেন কীভাবে? সে আখ্যানের আগে উপক্রমণিকা হয়ে জুড়ে আছে যে আখ্যানটি, সেটি হল সগর রাজার উপাখ্যান। তাকে না জেনে গঙ্গার মর্ত্যে আসার কাহিনী অসম্পূর্ণ। কাজেই বিশ্বামিত্র কথায় কথায় ধরে দিলেন সেই ভূমিকারূপী আখ্যানটিকে।
সগর ছিলেন এককালে অযোধ্যাপতি, রামের পূর্বজ। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ — সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তাঁর আখ্যান। সে আখ্যানের মূল কাঠামো একই থাকলেও কালে কালে অল্প বিস্তর রূপ পরিবর্তন ঘটেছে তার মধ্যে। আমরা এখানে বিশ্বামিত্রের মুখে শুনি সগর রাজার আখ্যান। মহাবীর, ধনুর্ধর, ধর্মপরায়ণ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সগর। দুই স্ত্রী ছিল তাঁর। বিদর্ভরাজকন্যা কেশিনী আর অরিষ্টনেমির কন্যা সুমতি। তাঁরা যেমন রূপবতী তেমনই ধর্মেকর্মে অচলমতি। কিন্তু একটিই দুঃখ বুক জুড়ে ছিল তাঁদের। সে হল সন্তানহীনতার। সেই দুঃখ থেকে উত্তরণের চেষ্টা করলেন রাজা। দুই পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভৃগুপ্রস্রবণ পর্বতে। মগ্ন হলেন কঠিন তপস্যায়। তপস্যায় কেটে গেল শত বছর। অবশেষে ভৃগুমুনি তুষ্ট হয়ে বর দিলেন তাঁদের। সন্তান জন্ম নেবে তাঁদের ঘরে। তবে মুনির কথা অনুসারে, এক স্ত্রী জন্ম দেবেন একজন বংশধর পুত্রের আর অন্যজন জন্ম দেবেন ষাট হাজার পুত্রের। কেশিনী স্বেচ্ছায় চেয়ে নিলেন একটি পুত্রের বর। সুমতি চাইলেন ষাট হাজার পুত্রের জননী হতে। কিছুকাল পরে কেশিনী জন্ম দিলেন এক পুত্রের, নাম হল তার অসমঞ্জ। সুমতি প্রসব করলেন লাউয়ের মতো আকৃতির একটি পিণ্ড। তা থেকে বেরিয়ে এল ষাট হাজার ছেলে। ধাত্রী মায়েরা ঘিয়ে পূর্ণ কলসে তাদের রেখে দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল তারা, সমান বয়স তাদের, শক্তিও তাদের সমান। ধীরে ধীরে যৌবনের পথে পা রাখল তারা। এদিকে সমস্যা বেড়ে উঠল অসমঞ্জকে নিয়ে। সে কথা শোনে না কারও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে উঠল দুর্বিনীত, অত্যাচারী। তার অত্যাচার চলতে থাকল ষাট হাজার ভাইয়ের উপর। সাধারণ নগরবাসীরাও অস্থির হয়ে উঠলেন তার দৌরাত্ম্যে। শেষে রাজা সগর প্রজাদের দুর্দশায় বাধ্য হয়ে নির্বাসন দিলেন অসমঞ্জকে। দেশে যেন স্বস্তির শ্বাস পড়ল। শান্তি ফিরে এল। অসমঞ্জের পুত্র ছিলেন অংশুমান। অমিতশক্তি, মহাযোদ্ধা অথচ বিনীত, প্রিয়ভাষী এই রাজকুমার পিতার বিপরীত স্বভাব। প্রজাদের বড় প্রিয় তিনি।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুকাল। এবার সগর রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ইচ্ছা জাগল মনে। শুরু হল বিরাট যজ্ঞের বিপুল আয়োজন। অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান বৃদ্ধ রাজা সগরের বড় সহায় এ যজ্ঞে। যজ্ঞের ঘোড়াটিকে নিয়ে অংশুমান যাত্রা করলেন দিগ্বিজয়ে। কিন্তু যাত্রাপথে যজ্ঞের ঘোড়াকে অপহরণ করলেন ইন্দ্র, রাক্ষসের বেশে। সগরের ক্রমেই বেড়ে চলা প্রতিপত্তি ইন্দ্রের ঈর্ষ্যার কারণ হয়ে উঠেছিল। গৌড়ীয় রামায়ণের কাহিনীতে অবশ্য ইন্দ্র নন, অনন্তরূপী নাগ রসাতল থেকে উঠে এসে যজ্ঞের ঘোড়াকে অপহরণ করেছিল। অশ্বমেধের অশ্বই অপহৃত হল, এমন ভয়ংকর বিঘ্নে যজ্ঞ পণ্ড হওয়ার উপক্রম। রাজা তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে দায়িত্ব দিলেন ঘোড়াকে উদ্ধার আর অপহরণকারীকে বন্দী করে আনার জন্য। পৃথিবীর সব স্থানে কিংবা রসাতল বা জলের মধ্য থেকেই হোক, এদের খুঁজে আনতেই হবে, এমন আদেশ দিলেন তিনি। পৃথিবীপৃষ্ঠে যদি এদের সন্ধান না মেলে, তবে এক এক যোজন স্থান খনন করে খুঁজতে হবে তাদের। না হলে অশ্বমেধের সব আয়োজন বৃথা হয়ে যাবে। ঘনিয়ে আসবে অমঙ্গলের কালো মেঘ। যজ্ঞের ঘোড়াকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তিনি পৌত্র অংশুমানকে নিয়ে ঋত্বিকদের সঙ্গে থেকে যাবেন সেই যজ্ঞভূমিতে।
প্রথমে বললেন তিনি গঙ্গার জন্মকথা। সেও এক পুরাণকথা। পর্বতরাজ তুষারমৌলি হিমালয়। তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা গঙ্গা। হিমালয়পত্নী মেরুরাজকন্যা মনোরমার কোলে জন্মেছিলেন দুই অতুলনীয় কন্যারত্ন — নদীশ্রেষ্ঠা গঙ্গা আর দেবীশ্রেষ্ঠা উমা। ত্রিপথগামিনী গঙ্গাকে নিজেদের কল্যাণকাজে সহায়রূপে চাইলেন দেবতারা। হিমালয় আপত্তি করেননি তাতে। এরপর নগাধিরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যাটি সুরলোকে বইতে শুরু করলেন। কিন্তু তিনি মর্ত্যে এলেন কীভাবে? সে আখ্যানের আগে উপক্রমণিকা হয়ে জুড়ে আছে যে আখ্যানটি, সেটি হল সগর রাজার উপাখ্যান। তাকে না জেনে গঙ্গার মর্ত্যে আসার কাহিনী অসম্পূর্ণ। কাজেই বিশ্বামিত্র কথায় কথায় ধরে দিলেন সেই ভূমিকারূপী আখ্যানটিকে।
সগর ছিলেন এককালে অযোধ্যাপতি, রামের পূর্বজ। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ — সর্বত্র ছড়িয়ে আছে তাঁর আখ্যান। সে আখ্যানের মূল কাঠামো একই থাকলেও কালে কালে অল্প বিস্তর রূপ পরিবর্তন ঘটেছে তার মধ্যে। আমরা এখানে বিশ্বামিত্রের মুখে শুনি সগর রাজার আখ্যান। মহাবীর, ধনুর্ধর, ধর্মপরায়ণ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সগর। দুই স্ত্রী ছিল তাঁর। বিদর্ভরাজকন্যা কেশিনী আর অরিষ্টনেমির কন্যা সুমতি। তাঁরা যেমন রূপবতী তেমনই ধর্মেকর্মে অচলমতি। কিন্তু একটিই দুঃখ বুক জুড়ে ছিল তাঁদের। সে হল সন্তানহীনতার। সেই দুঃখ থেকে উত্তরণের চেষ্টা করলেন রাজা। দুই পত্নীকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভৃগুপ্রস্রবণ পর্বতে। মগ্ন হলেন কঠিন তপস্যায়। তপস্যায় কেটে গেল শত বছর। অবশেষে ভৃগুমুনি তুষ্ট হয়ে বর দিলেন তাঁদের। সন্তান জন্ম নেবে তাঁদের ঘরে। তবে মুনির কথা অনুসারে, এক স্ত্রী জন্ম দেবেন একজন বংশধর পুত্রের আর অন্যজন জন্ম দেবেন ষাট হাজার পুত্রের। কেশিনী স্বেচ্ছায় চেয়ে নিলেন একটি পুত্রের বর। সুমতি চাইলেন ষাট হাজার পুত্রের জননী হতে। কিছুকাল পরে কেশিনী জন্ম দিলেন এক পুত্রের, নাম হল তার অসমঞ্জ। সুমতি প্রসব করলেন লাউয়ের মতো আকৃতির একটি পিণ্ড। তা থেকে বেরিয়ে এল ষাট হাজার ছেলে। ধাত্রী মায়েরা ঘিয়ে পূর্ণ কলসে তাদের রেখে দিল। ক্রমে বেড়ে উঠল তারা, সমান বয়স তাদের, শক্তিও তাদের সমান। ধীরে ধীরে যৌবনের পথে পা রাখল তারা। এদিকে সমস্যা বেড়ে উঠল অসমঞ্জকে নিয়ে। সে কথা শোনে না কারও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে উঠল দুর্বিনীত, অত্যাচারী। তার অত্যাচার চলতে থাকল ষাট হাজার ভাইয়ের উপর। সাধারণ নগরবাসীরাও অস্থির হয়ে উঠলেন তার দৌরাত্ম্যে। শেষে রাজা সগর প্রজাদের দুর্দশায় বাধ্য হয়ে নির্বাসন দিলেন অসমঞ্জকে। দেশে যেন স্বস্তির শ্বাস পড়ল। শান্তি ফিরে এল। অসমঞ্জের পুত্র ছিলেন অংশুমান। অমিতশক্তি, মহাযোদ্ধা অথচ বিনীত, প্রিয়ভাষী এই রাজকুমার পিতার বিপরীত স্বভাব। প্রজাদের বড় প্রিয় তিনি।
এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুকাল। এবার সগর রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ করার ইচ্ছা জাগল মনে। শুরু হল বিরাট যজ্ঞের বিপুল আয়োজন। অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান বৃদ্ধ রাজা সগরের বড় সহায় এ যজ্ঞে। যজ্ঞের ঘোড়াটিকে নিয়ে অংশুমান যাত্রা করলেন দিগ্বিজয়ে। কিন্তু যাত্রাপথে যজ্ঞের ঘোড়াকে অপহরণ করলেন ইন্দ্র, রাক্ষসের বেশে। সগরের ক্রমেই বেড়ে চলা প্রতিপত্তি ইন্দ্রের ঈর্ষ্যার কারণ হয়ে উঠেছিল। গৌড়ীয় রামায়ণের কাহিনীতে অবশ্য ইন্দ্র নন, অনন্তরূপী নাগ রসাতল থেকে উঠে এসে যজ্ঞের ঘোড়াকে অপহরণ করেছিল। অশ্বমেধের অশ্বই অপহৃত হল, এমন ভয়ংকর বিঘ্নে যজ্ঞ পণ্ড হওয়ার উপক্রম। রাজা তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে দায়িত্ব দিলেন ঘোড়াকে উদ্ধার আর অপহরণকারীকে বন্দী করে আনার জন্য। পৃথিবীর সব স্থানে কিংবা রসাতল বা জলের মধ্য থেকেই হোক, এদের খুঁজে আনতেই হবে, এমন আদেশ দিলেন তিনি। পৃথিবীপৃষ্ঠে যদি এদের সন্ধান না মেলে, তবে এক এক যোজন স্থান খনন করে খুঁজতে হবে তাদের। না হলে অশ্বমেধের সব আয়োজন বৃথা হয়ে যাবে। ঘনিয়ে আসবে অমঙ্গলের কালো মেঘ। যজ্ঞের ঘোড়াকে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত তিনি পৌত্র অংশুমানকে নিয়ে ঋত্বিকদের সঙ্গে থেকে যাবেন সেই যজ্ঞভূমিতে।
সগরপুত্ররা পৃথিবী জুড়ে কোথাও সেই ঘোড়া আর তার অপহারককে খুঁজে না পেয়ে মহা উৎসাহে প্রবল শক্তিতে কোদাল, শূল, মুষল দিয়ে ভূমি খনন করতে শুরু করলেন। তাদের আঘাতে জীবপালনী বসুন্ধরা আর্ত রমণীর মতো চিৎকার করতে লাগলেন। প্রাণভয়ে, যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে লাগল আহত নাগ, সর্প, অসুর, রাক্ষসেরা। কত প্রাণিহত্যা হল এই ভূমি খননে, তার ইয়ত্তা রইল না। যজ্ঞের অশ্বের অপহারক সন্দেহে নির্বিচারে জীব বিনাশে মেতে উঠল সগরপুত্ররা। তখন লোকপিতামহ ব্রহ্মার কাছে প্রতিকার চেয়ে ছুটে গেলেন দেবতা, সর্প, গন্ধর্বেরা। ব্রহ্মা জানালেন, তাদের কাজের মধ্যেই নিজেদের ধ্বংসের বীজ বপন করেছে তারা। আশ্বস্ত হয়ে ফিরে গেলেন দেবতারা।
এদিকে সগরের কাছে ফিরে এসে পুত্ররা জানালো নিজেদের ব্যর্থতার কথা। সগর এবার তাদের রসাতল ভেদ করে ঘোড়ার সন্ধানের নির্দেশ দিলেন। ষাট হাজার রাজপুত্র একসঙ্গে ছুটল রসাতলের দিকে। আবার খননের কাজ শুরু করে তারা বিরূপাক্ষ নামে এক বিপুলকায় দিগগজের সাক্ষাৎ পেল। বন-জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত সমেত সমস্ত পৃথিবীকে মাথায় করে ধরে রেখেছে সে। একে একে তারা দক্ষিণে মহাপদ্ম, পশ্চিমে সৌমনস, উত্তরে হিমশুভ্রভদ্র নামে আরও তিন দিগ্গজ দেখতে পেল। কিন্তু যজ্ঞের ঘোড়ার সন্ধান কিছুতেই পেল না। শেষে প্রচণ্ড ক্রোধে তারা উত্তর-পূর্ব দিকে ভূমি খনন করতে শুরু করল। সে পথে গিয়ে সাক্ষাৎ পেল কপিল মহর্ষির। ধ্যানমগ্ন ঋষির কাছেই যজ্ঞের ঘোড়াটি বিচরণ করছে। সগরপুত্ররা নিশ্চিত হল, ইনিই ঘোড়াটিকে চুরি করেছেন। তারা মহর্ষির দিকে ছুটে গেল অস্ত্রশস্ত্র, পাথরের টুকরো নিয়ে। এদিকে স্বয়ং বাসুদেব রূপ ধরেছেন ঋষির, অসীম তাঁর অধ্যাত্মতেজ — সে উপলব্ধি হল না রাজপুত্রদের। কপিল মহর্ষির উপর আক্রমণ করতেই তাঁর ক্রোধে ভস্মীভূত হল ষাট হাজার সগরপুত্র।
এরপর কেটে গেল বহু কাল। ফিরে এল না পুত্রেরা। অপেক্ষায়, দুশ্চিন্তায় অস্থির হলেন রাজা। এবার প্রিয় পৌত্র অংশুমানকে পাঠালেন পুত্রদের সন্ধানে। অংশুমান রসাতলের পথ ধরেই যাত্রা শুরু করলেন। চলার পথে দেখা হল দিগগজ বিরূপাক্ষের সঙ্গে। বিনীতভাবে কুশল প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন পিতৃব্য আর যজ্ঞের ঘোড়ার সন্ধান। এর উত্তরে দিগগজ তাঁকে কৃতকার্য হয়ে ওঠার আশ্বাস দিল। জানাল যে, তিনি ফিরে আসবেন যজ্ঞের ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে। পথে দেখা হল অন্য তিনটি হাতীর সঙ্গেও। তারাও একই কথা বলল। উৎসাহিত হয়ে উঠল অংশুমানের মন। দ্রুতবেগে তিনি পৌঁছলেন সেই স্থানে, যেখানে আছে যজ্ঞের ঘোড়াটি। আশা জাগল, সেখানেই হয়তো পেয়ে যাবেন তাঁর পিতৃব্যদেরও। কিন্তু গিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর ষাট হাজার পিতৃব্যের দেহভস্মের স্তুপ। এ দৃশ্য দেখে শোকে আর্তনাদ করে উঠলেন অংশুমান। এমন পরিণতির কথা ভাবতেও পারেননি তিনি। আরও দেখতে পেলেন, কিছু দূরে বনের মধ্যে যজ্ঞের সেই ঘোড়া! ফিরে যাওয়ার আগে মনস্থির করলেন, ভস্মীভূত স্বজনদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করবেন। কিন্তু সেই স্থানে জল খুঁজে পেলেন না কোথাও। এমন সময় সেখানে দেখা পেলেন পিতৃব্যদের মাতুল সুপর্ণ গরুড়ের। তিনি অংশুমানকে দিলেন এ বিষয়ে প্রকৃত উপায়ের সন্ধান। বললেন, ‘‘অংশুমান, শোক করো না এদের জন্য। জীবকল্যাণের জন্য এদের বিনাশই কাম্য ছিল। মহাপ্রতাপশালী মহর্ষি কপিলের রোষানলে এই সগরপুত্ররা দগ্ধ হয়েছে। তাদের মুক্তির হবে যে কোনো জলে নয়, হিমালয়কন্যা কলুষনাশিনী সুরনদী গঙ্গার জলধারায়। গঙ্গাধারায় প্লাবিত হবে এই ভস্মরাশি। সম্পন্ন হবে পারলৌকিক ক্রিয়া। তখনই এদের স্বর্গপ্রাপ্তি হবে। তাই, যদি সামর্থ্য থাকে, নিয়ে এসো মর্ত্যলোকে গঙ্গাকে। আপাতত এই যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে ফিরে যাও যজ্ঞভূমিতে। পিতামহের যজ্ঞকর্ম সম্পন্ন করো।” গরুড়ের বাক্যে নতুন এক ভাবনা আচ্ছন্ন করল অংশুমানের মন। ধরাধামে নিয়ে আসতে হবে পতিতপাবনী গঙ্গাকে।
অংশুমান ফিরে এলেন সগর রাজার কাছে। পুত্রশোকের আকস্মিক আঘাত যজ্ঞের আনন্দ ম্লান করে দিল। বিমর্ষ মনে অসমাপ্ত যজ্ঞানুষ্ঠান সমাপ্ত করলেন রাজা। কিন্তু মনের মধ্যে কেবল প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে, কোন উপায়ে আসবেন গঙ্গা এই মর্ত্যভূমিতে, এই পাপে পঙ্কিল ধূলিমলিন ধরণীতে? এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল সগর রাজার ত্রিশ হাজার বছর রাজত্বকাল। অংশুমানকে রাজ্যভার দিয়ে কালের ধর্ম মেনে তিনি স্বর্গে গেলেন পুত্রদের মুক্তির উপায় সিদ্ধি না করেই। কে আনবেন তবে গঙ্গাকে মর্ত্যলোকে— সে হল সগর রাজার উত্তরপুরুষ ভগীরথের উপাখ্যান। অন্যদিন হবে সে গল্প।—চলবে
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
এরপর কেটে গেল বহু কাল। ফিরে এল না পুত্রেরা। অপেক্ষায়, দুশ্চিন্তায় অস্থির হলেন রাজা। এবার প্রিয় পৌত্র অংশুমানকে পাঠালেন পুত্রদের সন্ধানে। অংশুমান রসাতলের পথ ধরেই যাত্রা শুরু করলেন। চলার পথে দেখা হল দিগগজ বিরূপাক্ষের সঙ্গে। বিনীতভাবে কুশল প্রশ্ন করে জানতে চাইলেন পিতৃব্য আর যজ্ঞের ঘোড়ার সন্ধান। এর উত্তরে দিগগজ তাঁকে কৃতকার্য হয়ে ওঠার আশ্বাস দিল। জানাল যে, তিনি ফিরে আসবেন যজ্ঞের ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে। পথে দেখা হল অন্য তিনটি হাতীর সঙ্গেও। তারাও একই কথা বলল। উৎসাহিত হয়ে উঠল অংশুমানের মন। দ্রুতবেগে তিনি পৌঁছলেন সেই স্থানে, যেখানে আছে যজ্ঞের ঘোড়াটি। আশা জাগল, সেখানেই হয়তো পেয়ে যাবেন তাঁর পিতৃব্যদেরও। কিন্তু গিয়ে দেখতে পেলেন তাঁর ষাট হাজার পিতৃব্যের দেহভস্মের স্তুপ। এ দৃশ্য দেখে শোকে আর্তনাদ করে উঠলেন অংশুমান। এমন পরিণতির কথা ভাবতেও পারেননি তিনি। আরও দেখতে পেলেন, কিছু দূরে বনের মধ্যে যজ্ঞের সেই ঘোড়া! ফিরে যাওয়ার আগে মনস্থির করলেন, ভস্মীভূত স্বজনদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করবেন। কিন্তু সেই স্থানে জল খুঁজে পেলেন না কোথাও। এমন সময় সেখানে দেখা পেলেন পিতৃব্যদের মাতুল সুপর্ণ গরুড়ের। তিনি অংশুমানকে দিলেন এ বিষয়ে প্রকৃত উপায়ের সন্ধান। বললেন, ‘‘অংশুমান, শোক করো না এদের জন্য। জীবকল্যাণের জন্য এদের বিনাশই কাম্য ছিল। মহাপ্রতাপশালী মহর্ষি কপিলের রোষানলে এই সগরপুত্ররা দগ্ধ হয়েছে। তাদের মুক্তির হবে যে কোনো জলে নয়, হিমালয়কন্যা কলুষনাশিনী সুরনদী গঙ্গার জলধারায়। গঙ্গাধারায় প্লাবিত হবে এই ভস্মরাশি। সম্পন্ন হবে পারলৌকিক ক্রিয়া। তখনই এদের স্বর্গপ্রাপ্তি হবে। তাই, যদি সামর্থ্য থাকে, নিয়ে এসো মর্ত্যলোকে গঙ্গাকে। আপাতত এই যজ্ঞের ঘোড়া নিয়ে ফিরে যাও যজ্ঞভূমিতে। পিতামহের যজ্ঞকর্ম সম্পন্ন করো।” গরুড়ের বাক্যে নতুন এক ভাবনা আচ্ছন্ন করল অংশুমানের মন। ধরাধামে নিয়ে আসতে হবে পতিতপাবনী গঙ্গাকে।
অংশুমান ফিরে এলেন সগর রাজার কাছে। পুত্রশোকের আকস্মিক আঘাত যজ্ঞের আনন্দ ম্লান করে দিল। বিমর্ষ মনে অসমাপ্ত যজ্ঞানুষ্ঠান সমাপ্ত করলেন রাজা। কিন্তু মনের মধ্যে কেবল প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে, কোন উপায়ে আসবেন গঙ্গা এই মর্ত্যভূমিতে, এই পাপে পঙ্কিল ধূলিমলিন ধরণীতে? এসব ভাবনা ভাবতে ভাবতে কেটে গেল সগর রাজার ত্রিশ হাজার বছর রাজত্বকাল। অংশুমানকে রাজ্যভার দিয়ে কালের ধর্ম মেনে তিনি স্বর্গে গেলেন পুত্রদের মুক্তির উপায় সিদ্ধি না করেই। কে আনবেন তবে গঙ্গাকে মর্ত্যলোকে— সে হল সগর রাজার উত্তরপুরুষ ভগীরথের উপাখ্যান। অন্যদিন হবে সে গল্প।—চলবে
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।