সিদ্ধাশ্রমে সিদ্ধি লাভ হল বিশ্বামিত্রের। তবে কি আবার ফিরে চলা অযোধ্যায়? স্নেহকাতর পিতা সেখানে দুই পুত্রের জন্য অধীর অপেক্ষায়। কিন্তু চলার পথ যে কানে কানে বলে যায়, ‘চরৈবেতি’, বলে এগিয়ে চলার কথা। সিদ্ধাশ্রমে যজ্ঞ শেষে রাত ভোর হল। রাম লক্ষ্মণ দুই ভাই এসে প্রণাম করলেন বিশ্বামিত্রকে। জানতে চাইলেন এরপরের গন্তব্যস্থল। ঋষিরা জানালেন, বিশ্বামিত্রের এবার গন্তব্য মিথিলা নগরী, রাজা জনকের দেশ। তাঁরাও এ যাত্রায় সঙ্গ নেবেন। জনকরাজা এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছেন। সেখানে আছে এক আশ্চর্য ধনু। পুরাকালে দেবতা আর অসুরদের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতারা অদ্ভূত রত্নতুল্য সেই ধনু দিয়েছিলেন জনকরাজাকে। দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস— কেউই তাকে তুলে ধরতে সমর্থ নন। সাধারণ মানুষের তো কথাই নেই। ঋষিরা দুই রাজকুমারকে দেখাতে চান সেই পরম শক্তিধর ধনুকটি। তপঃসাধনার পুণ্যভূমি সিদ্ধাশ্রম ছেড়ে রাম লক্ষ্মণকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বামিত্র শুরু করলেন পথ চলা। জাহ্নবীর উত্তর তীরে হিমালয় অভিমুখে এবার যাত্রা তাঁদের। কিন্তু মন ভার হয়ে উঠল যেন আশ্রমের তরুলতা, পশুপাখিদের। বনদেবতাদের মঙ্গল কামনা করলেন বিশ্বামিত্র, দিলেন সান্ত্বনা। বনের পথ ধরে চলছেন ঋষিরা, চলেছেন রাম-লক্ষ্মণ দুই রাজার কুমার। তাঁদের পিছু পিছু আসছে সিদ্ধাশ্রমের যত পশু পাখির দল। অরণ্য প্রকৃতি আর মানুষের অন্তরাত্মা দুইয়ের মধ্যে যেন আপনিই গড়ে উঠেছে এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গতার সেতু। সমগ্র রামায়ণ জুড়ে অরণ্যপ্রকৃতি আর মানুষের এই নিবিড় সখ্য আর স্নেহের বন্ধন ফুটে উঠতে থাকে ঘটনা পরম্পরায়।
সূর্য গেল অস্তাচলে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঢেকে দিল চারিদিক। বহু পথ পার হয়ে ঋষিরা এসে থামলেন শোণ নদের তীরে। সায়ংসন্ধ্যা করে বিশ্বামিত্রকে সামনে রেখে তপোধন ঋষিরা সব বসলেন একত্রে। এ কোন দেশে এলেন তাঁরা? বহু সমৃদ্ধ মানুষের বাসভূমি এই দেশটি কার? জানতে চাইলেন দাশরথি রাম। বিশ্বামিত্র আরম্ভ করলেন সে দেশের ইতিকথা।
পুরাকালে কুশ নামে ব্রহ্মার এক পুত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ মহাত্মা নরপতি। তাঁর ছিল চার পুত্র — কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূর্ত্তরজ আর বসু। তাঁরা সকলে বেদবিদ্যায় পারঙ্গম, বিনীতস্বভাব। পিতার আদেশে তাঁরা চারজন চারটি নগর স্থাপন করে রাজত্ব করতে লাগলেন। কুশাম্ব স্থাপন করলেন কৌশাম্বী নগরী। বড় সুন্দর, সুশোভিত সেই নগরী। কুশনাভ নির্মাণ করলেন মহোদয় নগর, অমূর্ত্তরজ প্রাগজ্যোতিষ, বসু তৈরি করলেন ধর্মারণ্যের কাছে গিরিব্রজ নগর।
পাঁচটি সুউচ্চ পর্বত প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে এই গিরিব্রজ। আর এই পাঁচটি পর্বতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সুমাগধী নদী, যেন পঞ্চ পর্বতের মাঝখানে বিছিয়ে আছে একখানি কণ্ঠহার। এ নদীর নামেই এ দেশ বিখ্যাত হল মগধ নামে। এ হল সেই বসু রাজার মাগধী নগরী। চারিদিক তার ঘিরে আছে হরিৎ শ্যামল শস্যক্ষেত্র।
সূর্য গেল অস্তাচলে। সন্ধ্যার অন্ধকার ঢেকে দিল চারিদিক। বহু পথ পার হয়ে ঋষিরা এসে থামলেন শোণ নদের তীরে। সায়ংসন্ধ্যা করে বিশ্বামিত্রকে সামনে রেখে তপোধন ঋষিরা সব বসলেন একত্রে। এ কোন দেশে এলেন তাঁরা? বহু সমৃদ্ধ মানুষের বাসভূমি এই দেশটি কার? জানতে চাইলেন দাশরথি রাম। বিশ্বামিত্র আরম্ভ করলেন সে দেশের ইতিকথা।
পুরাকালে কুশ নামে ব্রহ্মার এক পুত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মপরায়ণ মহাত্মা নরপতি। তাঁর ছিল চার পুত্র — কুশাম্ব, কুশনাভ, অমূর্ত্তরজ আর বসু। তাঁরা সকলে বেদবিদ্যায় পারঙ্গম, বিনীতস্বভাব। পিতার আদেশে তাঁরা চারজন চারটি নগর স্থাপন করে রাজত্ব করতে লাগলেন। কুশাম্ব স্থাপন করলেন কৌশাম্বী নগরী। বড় সুন্দর, সুশোভিত সেই নগরী। কুশনাভ নির্মাণ করলেন মহোদয় নগর, অমূর্ত্তরজ প্রাগজ্যোতিষ, বসু তৈরি করলেন ধর্মারণ্যের কাছে গিরিব্রজ নগর।
পাঁচটি সুউচ্চ পর্বত প্রাচীরের মতো ঘিরে রেখেছে এই গিরিব্রজ। আর এই পাঁচটি পর্বতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে সুমাগধী নদী, যেন পঞ্চ পর্বতের মাঝখানে বিছিয়ে আছে একখানি কণ্ঠহার। এ নদীর নামেই এ দেশ বিখ্যাত হল মগধ নামে। এ হল সেই বসু রাজার মাগধী নগরী। চারিদিক তার ঘিরে আছে হরিৎ শ্যামল শস্যক্ষেত্র।
এবার বিশ্বামিত্র বললেন, কুশনাভ রাজার কাহিনী। স্বর্গের অপ্সরা ঘৃতাচী। তার গর্ভে সে রাজার একশ কন্যারত্ন জন্মেছিল। রূপে গুণে তাঁরা অতুলনীয়। রূপযৌবনবতী এই কন্যারা একদিন সুসজ্জিত হয়ে রাজ-উদ্যানে নিজেদের মধ্যে আমোদ আহ্লাদে মেতে উঠেছেন। সমবেত নৃত্য, গীত, বাদ্যে আনন্দ উপভোগ করছে সবাই। যেন তাঁরা আকাশে উজলে ওঠা বিদ্যুন্মালা। তাদের উপস্থিতিতে উদ্ভাসিত রাজার উদ্যান। এমন সর্বাঙ্গসুন্দরী, গুণবতী কন্যাদের দেখে থমকে দাঁড়ালেন সেখানে বায়ু। পৃথিবীর সর্বত্রই তাঁর অবাধ চলাচল। চলতে চলতে এমন অতুলনীয়া কন্যাদের দেখে কামনায় আকুল হয়ে এদের সকলকেই পত্নীরূপে পেতে চাইলেন তিনি। বায়ু দেবতা, তাঁর পত্নী হলে এই মানবকন্যারাও দেবভাব লাভ করবেন, এমন প্রলোভনও দিলেন তিনি। কিন্তু কুশনাভের একশ কন্যা অবজ্ঞাভ’রে হেসে উড়িয়ে দিলেন বায়ুর এই বিবাহপ্রস্তাব। তাঁরা বায়ুকে বললেন, “আপনি তো সর্বত্রগামী, অন্তর্যামী। মানুষের অন্তরের কথা তো অনায়াসেই জানতে পারেন আপনি। আমাদের ধর্মপরায়ণ, সত্যবাদী পিতাকে অগ্রাহ্য করে আমরা কখনওই স্বয়ংবরা হব না, এ কথাও আপনার অজানা নয়। আমাদের কুলধর্ম থেকে ভ্রষ্ট করা কি আপনার উচিত কাজ? এমন বিসদৃশ প্রস্তাব কি আমাদের অপমান করার জন্য?”
এমন উত্তর শুনে ক্রোধে, অপমানবোধে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন বায়ু। রাজকন্যাদের শরীরে প্রবেশ করে তাঁদের কটিদেশ ভগ্ন করে দিলেন। বায়ু ভুলে গেলেন তাঁর দেবস্বভাবকে, কামনার রিপু জ্বালিয়ে তুলল ক্রোধের আগুন। কন্যারা কিন্তু ক্ষমা করলেন বায়ুকে, তাঁর ব্যভিচারী অন্যায় আচরণকে। পরমাসুন্দরী রাজকন্যারা পুরুষের কামনায় সাড়া না দিয়ে তাঁর প্রতিশোধের আগুনে হয়ে গেলেন বিকৃতরূপা। কবেকার গল্প এসব, আজকের পৃথিবীতেও এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে, অতর্কিতে, আচম্বিতে, ভিন্ন রূপে।
ব্যথায়, লজ্জায় কাতর কুব্জদেহে, অবসন্ন মনে, চোখের জলে ভেসে কন্যারা ফিরে এলেন রাজপুরীতে। “আহা! কোন ধর্মজ্ঞানহীন দুরাত্মার এমন কাজ!”—রাজা দেখে জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন, বায়ুদেবতা কামনার বশে ধর্মাধর্মজ্ঞানশূন্য হয়ে এমন কাজ করেছেন। তিনি বল প্রয়োগ করে পেতে চেয়েছিলেন কন্যাদের। আর কন্যারা চেয়েছিলেন পিতার সম্মতি নিয়ে ধর্মসঙ্গত পথে বায়ু তাঁদের পাণিগ্রহণ করুন। সেকথা শুনে ক্রুদ্ধ বায়ু কুব্জ করে দিয়েছেন তাঁদের। কন্যাদের ক্ষমাগুণ তৃপ্ত, তুষ্ট করল রাজার মন। দেবতা যা পারলেন না, মানবকন্যারা সেই বোধেই উজ্জ্বল করল নিজেদের চরিত্রকে, বংশকে। কন্যাদের কল্যাণচিন্তায় মগ্ন হল রাজার মন। মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন কন্যাদের উপযুক্ত পাত্রে বিবাহ বিষয়ে। কুশনাভ রাজার নগরের নাম ছিল মহোদয়। সে নগরে কন্যাদের দেহ কুব্জ করেছিলেন বায়ু। সেই থেকে এ নগর পরিচিত হল কান্যকুব্জ নামে।
চূলী নামে এক মহর্ষি কঠোর ব্রহ্মচর্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেই ব্রহ্মচারী তপস্বীকে অত্যন্ত নিষ্ঠা আর সংযমের সঙ্গে সেবা করতেন সোমদা নামে এক গন্ধর্বকন্যা। বহুকাল এমনি ভাবে কেটে গেল। অবশেষে একদিন পরিতুষ্ট মনে মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন সোমদাকে, কী তার প্রার্থনা। নিজের মনের কথা অকপটে খুলে বলতে দ্বিধা করেননি গন্ধর্বকন্যা। মহর্ষির মতোই ব্রহ্মতেজে তেজস্বী এক পুত্রসন্তান লাভের বড় ইচ্ছা তাঁর। অবিবাহিতা, অনন্যপূর্বা এই কন্যা নিজেই পতিরূপে বরণ করে নিতে চাইলেন ঋষিকে। সোমদার সেবাযত্নে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন চূলী মহর্ষি। তাঁকে ফেরাতে পারলেন না আর। তাঁদের ব্রহ্মতেজঃসম্পন্ন পুত্র হয়েছিল, নাম ব্রহ্মদত্ত। কাম্পিল্য নগরীতে ব্রহ্মদত্ত তাঁর রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। ব্রহ্মদত্তের সুনাম এবং সমৃদ্ধির কথা এসে পৌঁছল কুশনাভ রাজার কানে। তিনি ব্রহ্মদত্তকে আহ্বান জানালেন তাঁর কন্যাদের পাণি গ্রহণের জন্য। এলেন রাজা ব্রহ্মদত্ত, অনুপম তেজঃশক্তিতে উদ্ভাসিত অন্তর তাঁর। একে একে শত কন্যার পাণি গ্রহণ করলেন তিনি। আর তাঁর করস্পর্শে শত কন্যা এক নিমেষে আবার ফিরে পেলেন তাঁদের আগের রূপ। মুছে গেল তাঁদের শরীরপীড়া, দূর হল কুব্জতা। কন্যারা পূর্ব অবস্থা ফিরে আসায় রাজার মনের ভার নেমে গেল। আনন্দিত, প্রসন্ন মনে অভিনন্দিত করলেন জামাতাকে। রূপে গুণে পুত্রের যোগ্য পত্নীদের দেখে ব্রহ্মদত্তের মা সোমদাও ভারি খুশি হলেন।
কন্যারা চলে গেলেন পিতৃগৃহ ছেড়ে। অপুত্রক রাজা কুশনাভ এবার পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞের সময় অন্তরীক্ষলোক থেকে আবির্ভূত হলেন কুশনাভের পিতা কুশ। তাঁর আশীর্বাদে কিছুকাল পরে পুত্র লাভ করলেন রাজা। নাম তাঁর গাধি। এই পুত্র কুশবংশে এনে দিলেন চিরস্থায়ী অক্ষয় কীর্ত্তি। গল্পকর্তা বিশ্বামিত্র এবার নিজের পরিচয় দিলেন। সত্যপরাক্রম, ধর্মনিষ্ঠ সেই রাজা, কান্যকুব্জের অধীশ্বর গাধির পুত্র স্বয়ং বিশ্বামিত্র!
এ দেশের রাজপুত্র ছিলেন তিনি। কুশরাজার বংশধর, তাই তিনি কৌশিক। ক্ষত্রিয় রাজকুমার হয়েও তপোবলে তিনি ব্রাহ্মণ। ছেড়ে দিয়েছেন রাজ্যপাট, ক্ষাত্রতেজ হয়েছে নির্বাপিত। আজ তপঃশক্তির অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত তাঁর অন্তরে। কঠোর তপস্যায় নিজেই বেঁধেছেন নিজের জীবনকে। দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয় নরপতির তেজ রূপান্তরিত হয়েছে ঋষিপ্রজ্ঞায়। রামায়ণের আদিকাণ্ডে পুরোধা পুরুষ তিনি। রামচন্দ্রের কিশোর জীবন ক্ষাত্রতেজে উদ্দীপিত হয়ে উঠল তাঁরই শিক্ষায়, দীক্ষায়। আচার্যের মতো স্নেহে শাসনে শেখালেন তাঁকে জীবনের পাঠ।
বিশ্বামিত্রের ভগ্নীর নাম ছিল সত্যবতী। মহর্ষি ঋচীকের সাথে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। পুণ্যপ্রাণা সত্যবতী স্বামীর সঙ্গে স্বর্গলাভের পর হিমালয়ের কোলে কৌশিকী নদীরূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছেন। ভগ্নীর প্রতি স্নেহের টানে সেই দিব্য, রমণীয় স্বচ্ছতোয়া নদীর কাছাকাছি হিমালয়ের শান্ত আশ্রয়ে তপশ্চর্যা তাঁর। সিদ্ধাশ্রমে তিনি গিয়েছিলেন বিশেষ এক যজ্ঞ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ায় আবার তিনি ফিরে যেতে চান কৌশিকী নদীর কাছাকাছি কোনও নির্জন প্রদেশে।
গল্পে কথায় কেটে গেল অর্ধেক রাত। শোণ নদের কূলে নিশুতি আঁধার রাতে বিশ্বামিত্র শোনালেন তাঁর বংশকথা, নিজের জীবনের আশ্চর্য গাথা। চারপাশে গাছপালা সব নিষ্পন্দ, সাড়া নেই পশুপাখিদের। এমন রাতে জেগে আছে শুধু বনের হিংস্র নিশাচর পশুরা, যক্ষ, রাক্ষসেরা। সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো কাজল কে যেন লেপে দিয়েছে। তার মাঝে মাঝে গ্রহ তারার সোনার বিন্দুগুলি ফুটে আছে শুধু। গ্রীষ্মের মধ্যরাত। চাঁদ তার স্নিগ্ধ শীতল আলোয় যেন তপ্ত জগতের ক্লান্তিটুকু ধুয়ে দিচ্ছে। যাত্রাপথে সবচেয়ে নির্ভরতা যাঁর উপরে, গুরুপ্রতিম এই মানুষটির জীবনের আশ্চর্য অজানা দিক সহসা উন্মোচিত হল এই শোণতটভূমিতে এসে। কাহিনী শুনে বিস্ময়ে অভিভূত দুই কোশলকুমার এবার শ্রান্তিতে তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।—চলবে
এমন উত্তর শুনে ক্রোধে, অপমানবোধে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করলেন বায়ু। রাজকন্যাদের শরীরে প্রবেশ করে তাঁদের কটিদেশ ভগ্ন করে দিলেন। বায়ু ভুলে গেলেন তাঁর দেবস্বভাবকে, কামনার রিপু জ্বালিয়ে তুলল ক্রোধের আগুন। কন্যারা কিন্তু ক্ষমা করলেন বায়ুকে, তাঁর ব্যভিচারী অন্যায় আচরণকে। পরমাসুন্দরী রাজকন্যারা পুরুষের কামনায় সাড়া না দিয়ে তাঁর প্রতিশোধের আগুনে হয়ে গেলেন বিকৃতরূপা। কবেকার গল্প এসব, আজকের পৃথিবীতেও এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে, অতর্কিতে, আচম্বিতে, ভিন্ন রূপে।
ব্যথায়, লজ্জায় কাতর কুব্জদেহে, অবসন্ন মনে, চোখের জলে ভেসে কন্যারা ফিরে এলেন রাজপুরীতে। “আহা! কোন ধর্মজ্ঞানহীন দুরাত্মার এমন কাজ!”—রাজা দেখে জানতে চাইলেন। জানতে পারলেন, বায়ুদেবতা কামনার বশে ধর্মাধর্মজ্ঞানশূন্য হয়ে এমন কাজ করেছেন। তিনি বল প্রয়োগ করে পেতে চেয়েছিলেন কন্যাদের। আর কন্যারা চেয়েছিলেন পিতার সম্মতি নিয়ে ধর্মসঙ্গত পথে বায়ু তাঁদের পাণিগ্রহণ করুন। সেকথা শুনে ক্রুদ্ধ বায়ু কুব্জ করে দিয়েছেন তাঁদের। কন্যাদের ক্ষমাগুণ তৃপ্ত, তুষ্ট করল রাজার মন। দেবতা যা পারলেন না, মানবকন্যারা সেই বোধেই উজ্জ্বল করল নিজেদের চরিত্রকে, বংশকে। কন্যাদের কল্যাণচিন্তায় মগ্ন হল রাজার মন। মন্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন কন্যাদের উপযুক্ত পাত্রে বিবাহ বিষয়ে। কুশনাভ রাজার নগরের নাম ছিল মহোদয়। সে নগরে কন্যাদের দেহ কুব্জ করেছিলেন বায়ু। সেই থেকে এ নগর পরিচিত হল কান্যকুব্জ নামে।
চূলী নামে এক মহর্ষি কঠোর ব্রহ্মচর্য সাধনায় মগ্ন ছিলেন। সেই ব্রহ্মচারী তপস্বীকে অত্যন্ত নিষ্ঠা আর সংযমের সঙ্গে সেবা করতেন সোমদা নামে এক গন্ধর্বকন্যা। বহুকাল এমনি ভাবে কেটে গেল। অবশেষে একদিন পরিতুষ্ট মনে মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন সোমদাকে, কী তার প্রার্থনা। নিজের মনের কথা অকপটে খুলে বলতে দ্বিধা করেননি গন্ধর্বকন্যা। মহর্ষির মতোই ব্রহ্মতেজে তেজস্বী এক পুত্রসন্তান লাভের বড় ইচ্ছা তাঁর। অবিবাহিতা, অনন্যপূর্বা এই কন্যা নিজেই পতিরূপে বরণ করে নিতে চাইলেন ঋষিকে। সোমদার সেবাযত্নে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন চূলী মহর্ষি। তাঁকে ফেরাতে পারলেন না আর। তাঁদের ব্রহ্মতেজঃসম্পন্ন পুত্র হয়েছিল, নাম ব্রহ্মদত্ত। কাম্পিল্য নগরীতে ব্রহ্মদত্ত তাঁর রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। ব্রহ্মদত্তের সুনাম এবং সমৃদ্ধির কথা এসে পৌঁছল কুশনাভ রাজার কানে। তিনি ব্রহ্মদত্তকে আহ্বান জানালেন তাঁর কন্যাদের পাণি গ্রহণের জন্য। এলেন রাজা ব্রহ্মদত্ত, অনুপম তেজঃশক্তিতে উদ্ভাসিত অন্তর তাঁর। একে একে শত কন্যার পাণি গ্রহণ করলেন তিনি। আর তাঁর করস্পর্শে শত কন্যা এক নিমেষে আবার ফিরে পেলেন তাঁদের আগের রূপ। মুছে গেল তাঁদের শরীরপীড়া, দূর হল কুব্জতা। কন্যারা পূর্ব অবস্থা ফিরে আসায় রাজার মনের ভার নেমে গেল। আনন্দিত, প্রসন্ন মনে অভিনন্দিত করলেন জামাতাকে। রূপে গুণে পুত্রের যোগ্য পত্নীদের দেখে ব্রহ্মদত্তের মা সোমদাও ভারি খুশি হলেন।
কন্যারা চলে গেলেন পিতৃগৃহ ছেড়ে। অপুত্রক রাজা কুশনাভ এবার পুত্রেষ্টি যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞের সময় অন্তরীক্ষলোক থেকে আবির্ভূত হলেন কুশনাভের পিতা কুশ। তাঁর আশীর্বাদে কিছুকাল পরে পুত্র লাভ করলেন রাজা। নাম তাঁর গাধি। এই পুত্র কুশবংশে এনে দিলেন চিরস্থায়ী অক্ষয় কীর্ত্তি। গল্পকর্তা বিশ্বামিত্র এবার নিজের পরিচয় দিলেন। সত্যপরাক্রম, ধর্মনিষ্ঠ সেই রাজা, কান্যকুব্জের অধীশ্বর গাধির পুত্র স্বয়ং বিশ্বামিত্র!
এ দেশের রাজপুত্র ছিলেন তিনি। কুশরাজার বংশধর, তাই তিনি কৌশিক। ক্ষত্রিয় রাজকুমার হয়েও তপোবলে তিনি ব্রাহ্মণ। ছেড়ে দিয়েছেন রাজ্যপাট, ক্ষাত্রতেজ হয়েছে নির্বাপিত। আজ তপঃশক্তির অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত তাঁর অন্তরে। কঠোর তপস্যায় নিজেই বেঁধেছেন নিজের জীবনকে। দুর্ধর্ষ ক্ষত্রিয় নরপতির তেজ রূপান্তরিত হয়েছে ঋষিপ্রজ্ঞায়। রামায়ণের আদিকাণ্ডে পুরোধা পুরুষ তিনি। রামচন্দ্রের কিশোর জীবন ক্ষাত্রতেজে উদ্দীপিত হয়ে উঠল তাঁরই শিক্ষায়, দীক্ষায়। আচার্যের মতো স্নেহে শাসনে শেখালেন তাঁকে জীবনের পাঠ।
বিশ্বামিত্রের ভগ্নীর নাম ছিল সত্যবতী। মহর্ষি ঋচীকের সাথে বিবাহ হয়েছিল তাঁর। পুণ্যপ্রাণা সত্যবতী স্বামীর সঙ্গে স্বর্গলাভের পর হিমালয়ের কোলে কৌশিকী নদীরূপে প্রবাহিত হয়ে চলেছেন। ভগ্নীর প্রতি স্নেহের টানে সেই দিব্য, রমণীয় স্বচ্ছতোয়া নদীর কাছাকাছি হিমালয়ের শান্ত আশ্রয়ে তপশ্চর্যা তাঁর। সিদ্ধাশ্রমে তিনি গিয়েছিলেন বিশেষ এক যজ্ঞ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে। সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ায় আবার তিনি ফিরে যেতে চান কৌশিকী নদীর কাছাকাছি কোনও নির্জন প্রদেশে।
গল্পে কথায় কেটে গেল অর্ধেক রাত। শোণ নদের কূলে নিশুতি আঁধার রাতে বিশ্বামিত্র শোনালেন তাঁর বংশকথা, নিজের জীবনের আশ্চর্য গাথা। চারপাশে গাছপালা সব নিষ্পন্দ, সাড়া নেই পশুপাখিদের। এমন রাতে জেগে আছে শুধু বনের হিংস্র নিশাচর পশুরা, যক্ষ, রাক্ষসেরা। সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো কাজল কে যেন লেপে দিয়েছে। তার মাঝে মাঝে গ্রহ তারার সোনার বিন্দুগুলি ফুটে আছে শুধু। গ্রীষ্মের মধ্যরাত। চাঁদ তার স্নিগ্ধ শীতল আলোয় যেন তপ্ত জগতের ক্লান্তিটুকু ধুয়ে দিচ্ছে। যাত্রাপথে সবচেয়ে নির্ভরতা যাঁর উপরে, গুরুপ্রতিম এই মানুষটির জীবনের আশ্চর্য অজানা দিক সহসা উন্মোচিত হল এই শোণতটভূমিতে এসে। কাহিনী শুনে বিস্ময়ে অভিভূত দুই কোশলকুমার এবার শ্রান্তিতে তৃপ্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।