সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ভয়াল ঘনঘোর তাড়কাবন পার হয়ে শুরু হল আবার পথ চলা। দুই রাজকুমারকে নিয়ে বিশ্বামিত্রের এবার গন্তব্য সিদ্ধাশ্রম। দীর্ঘ চলার পথে কত অজানাকে জানল দুই কুমার। জয় করল কতই না ভয়কে। অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরে উঠল ঋষির গল্পে, কথায়। এবার পথের শেষ দেখা যায়। ওই যে কিছু দূরে পাহাড়ের গা-ঘেঁষে গভীর মেঘের মতো নীলাঞ্জনছায়া এক বনভূমি। নাম তার সিদ্ধাশ্রম। তাকে দেখে ভয় জাগে না, বুক কাঁপে না। বেশ স্বস্তির আভাস ছড়িয়ে ভেসে আসছে সেখান থেকে পাখ-পাখালির মধুর কলকাকলি। তার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে বনের পশুদের বিচিত্র ধ্বনি। নিভৃত বনের মাঝে আশ্রমভূমি। সেখানে মুনি ঋষিদের বাস, তাঁদের জীবনযাপন, তপশ্চর্যা। এ বনের নাম সিদ্ধাশ্রম কেন? এরও কি কোনও বৃত্তান্ত আছে? আছে কিছু নামমাহাত্ম্য? — প্রশ্ন জাগল রামের মনে। বিশ্বামিত্র তাঁদের বলতে শুরু করলেন সিদ্ধাশ্রমের কাহিনী। বিষ্ণু বামনরূপে তপশ্চরণ করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন এই আশ্রমে। এ হল বামনরূপধারী বিষ্ণুর পূর্বাশ্রম।

পুরাকালে পরাক্রমশালী দৈত্যরাজ ছিলেন বলি। বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র, বিরোচনের পুত্র ছিলেন তিনি। তপস্যালব্ধ ফলে বলীয়ান হয়ে অজেয়, অমর হলেন। স্বর্গের দেবতাদের পরাস্ত করে স্বর্গচ্যুত করলেন। ক্রমে ত্রিভুবনের অধীশ্বর হলেন দৈত্যরাজ। এবার এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করলেন তিনি। আর ঘোষণা করলেন, সে যজ্ঞে সমস্ত প্রাণীর অভীষ্ট যা কিছু, সব দান করবেন তিনি। এভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবেন বলিরাজ, এইটিই তাঁর লক্ষ্য। এদিকে সুরলোক থেকে বিতাড়িত, পরাস্ত দেবতারা এ সংবাদে ভয়ে কাতর হয়ে পড়লেন। তাঁরা তখন হারানো স্বর্গ ফিরে পাওয়ার উপায় খুঁজতে এলেন এই আশ্রমে বিষ্ণুর কাছে। নিলেন তাঁর শরণ। বামনরূপে বলির কাছে গিয়ে ত্রিপাদ পরিমিত ভূমির প্রার্থনা করতে তাঁকে অনুরোধ জানালেন দেবতারা —

“ত্রিভুবনের অধিপতি, যজ্ঞকর্তা বলি তখন ভাববেন, এই খর্বাকৃতি বামন, তাঁর কতটুকুই বা ভূমির প্রয়োজন হবে! এদিকে ক্ষমতা, রাজৈশ্বর্যের অহংকারে, সকলের অভিলষিত বস্তু দানের গর্বে আচ্ছন্ন বলিরাজা উপলব্ধি করতে পারবেন না, এই তিন-পা ভূমির প্রার্থী স্বয়ং জগতের নাথ! তিনি বামনকে অবজ্ঞাভরে দিতে চাইবেন সেই ভূমিখণ্ডটুকু। আর জগৎপতি হয়ে তুমি পদবিস্তারে স্বর্গ, অন্তরীক্ষ এবং পৃথিবীলোক ব্যাপ্ত করবে। তাহলে আমরা আবার ফিরে পাব স্বর্গলোকের অধিকার। এই আশ্রমে অবস্থান কালে এই কার্য সিদ্ধ হলে এর নাম হবে সিদ্ধাশ্রম।”

দেবতাদের অনুরোধে বিষ্ণু বামন অবতারে বলিরাজার কাছে গিয়ে ত্রিপাদ ভূমি প্রার্থনা করলেন। তিন পা পরিমিত ভূমিখণ্ড পেয়ে তিনি অদ্ভূত রূপ ধারণ করে তিনলোক অধিকার করলেন। গর্বোন্মত্ত বলিকে তিনি পাতাললোকের অধিবাসী করে রাখলেন। ইন্দ্র ফিরে পেলেন আবার দেবলোকের অধিকার। বামনের স্মৃতিধন্য এই পুণ্য আশ্রমও প্রসিদ্ধি পেল সিদ্ধাশ্রম নামে। এই বলে থামলেন বিশ্বামিত্র। বিষ্ণুর বামনরূপের প্রতি ভক্তিবশতই বসবাসের জন্য এই স্থান বেছে নিয়েছেন তিনি। এখানেই তাঁর যজ্ঞকর্ম, কর্মসাধনা, তপশ্চর্যা।

বৈরোচনি বলি আর বামন অবতারে বিষ্ণুর আখ্যান বহু পুরাণের উপজীব্য। একই আখ্যান কখনও ভাগবতে, কখনও বামনপুরাণে বা বৃহদ্ধর্মপুরাণে কিছু রূপ পরিবর্তন করে ঠাঁই পেয়েছে। বিদ্বজ্জনদের অভিমত, বামন অবতারের মূল ভাবনার উৎস ঋগ্বেদেই নিহিত। সে ভাবনার কাঠামো রূপটি আছে শতপথ ব্রাহ্মণের দেব-অসুরের দ্বন্দ্ব কাহিনীতেও।

কথায় কথায় পৌঁছে গেলেন তাঁরা সিদ্ধাশ্রমে। এগিয়ে এলেন আশ্রমবাসীরা তাঁদের অভ্যর্থনায়। স্থির হল, সেদিনই বিশ্বামিত্র যজ্ঞে দীক্ষা নেবেন। স্থিরচিত্ত, মৌনব্রত ঋষি পরদিন বসবেন যজ্ঞে। দীক্ষা তিনি এর আগেও নিয়েছিলেন। কিন্তু রাক্ষসদের বাধাবিঘ্নে সে যজ্ঞ যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়নি। আর দীক্ষিত অবস্থায় হিংসার পথে তিনি রাক্ষসদের পরাস্তও করতে পারেননি। তারপর যজ্ঞের বাধা দূর করার জন্যই তিনি গিয়েছেন অযোধ্যায়। সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন অমিতশক্তি রামকে। তাড়কাবধের পর তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন অমোঘ আয়ুধরাশির উত্তরাধিকার। প্রজাপতি কৃশাশ্বের মন্ত্রজাত আশ্চর্য অস্ত্র সেসব। উপযুক্ত অধিকারী রাম শিখে নিয়েছেন তাদের আবাহন, প্রয়োগ এবং সংবরণের কৌশল। এখন তিনি আর অযোধ্যাপতির আদরের বালক পুত্রটি নন, তিনি যেন এখন পরিণত ক্ষত্রিয় বীর। এ যজ্ঞরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হয়ে জাগবেন তিনি রাত্রিদিন। ছয় দিন ধরে চলবে এ যজ্ঞ। রাম লক্ষ্মণ প্রার্থনা করলেন, সমস্ত বিঘ্ন দূর হয়ে এই যজ্ঞও সিদ্ধ হোক। সিদ্ধাশ্রমের নাম সার্থকতর হয়ে উঠুক।

আরম্ভ হল যজ্ঞ। যজ্ঞাসনে বসলেন বিশ্বামিত্র মৌনবৃত্তি হয়ে। রাম লক্ষ্মণ দাঁড়িয়ে রইলেন, স্থির কিন্তু প্রখর দৃষ্টিতে। হাতে উদ্যত ধনুর্বাণ। রাক্ষসের আগমনের আশঙ্কায় কাটল নিদ্রাহীন রাত। এভাবেই কেটে গেল পাঁচটি দিন, নির্বিঘ্নে। ষষ্ঠ দিনে ব্রতনিষ্ঠ মুনিরা স্থাপন করলেন যজ্ঞবেদী। মন্ত্রপাঠ, আহুতি দান চলতে লাগল।

হঠাৎই যজ্ঞের অগ্নিশিখা যেন জ্বলে উঠল তীব্রতায়। সহসা যেন আকাশে বর্ষামেঘের গুরু গর্জন। সে ঘোর নিনাদে কেঁপে উঠল চারিদিক। চারিদিকে থেকে যেন অশান্তি এসে গ্রাস করতে চাইল যজ্ঞের শান্তিকে। মারীচ, সুবাহু আর তাদের অনুগামীরা ছুটে আসছে যজ্ঞবেদীর অভিমুখে। রক্তধারার বর্ষণে ভেসে যাচ্ছে যজ্ঞবেদী। রাম মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠলেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আর গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝে নিলেন মায়াবী রাক্ষসবাহিনীর উপস্থিতিকে। ধনুকে টঙ্কার দিলেন রাম। ভাই লক্ষ্মণকে বললেন, বায়ু যেমন মেঘকে সরিয়ে দেয়, তেমন করে এই রাক্ষসদেরও সরিয়ে দেব আমি। এই বলে তাড়কার পুত্র মারীচের দিকে ছুঁড়লেন তিনি মানবাস্ত্র। ঘূর্ণ্যমান সেই অস্ত্রের আঘাতে মারীচ গিয়ে আছড়ে পড়ল সুদূর সমুদ্রের তীরে। অনায়াসেই হয়তো তাকে বধ করতে পারতেন রাম। কিন্তু মারীচের অভিশপ্ত জীবন, রাক্ষস জীবন লাভের ইতিবৃত্ত, তাড়কাবধের ঘটনা হয়তো তাঁকে সে নিষ্ঠুর কাজে বাধা দিয়েছিল। মারীচ আহত হয়েও বেঁচে গেল। এ যেন মারীচের পুনর্জন্ম লাভ। তার মনেও ঘটল আমূল পরিবর্তন। সমুদ্রের তীরে অরণ্যের মাঝে কুটির বেঁধে মন দিল সে তপস্যায়। ধ্যানের মধ্যে ভেসে ওঠে শুধু রামেরই মূর্তিখানি। সে কাহিনী পরের। আপাতত সুবাহু আর তার সঙ্গীদের কি দুর্গতি হল সে দিকে দেখি।

যজ্ঞবিনাশকারী সুবাহুকে আগ্নেয়াস্ত্রে বধ করলেন রাম। বায়ব্য অস্ত্রে অন্যান্য রাক্ষসদেরও হত্যা করে যজ্ঞস্থলে ফিরিয়ে আনলেন শান্তি। যজ্ঞ এবার নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হল। সিদ্ধাশ্রমে বিশ্বামিত্রের যজ্ঞকর্ম সিদ্ধ হল। কৃতার্থ হলেন বিশ্বামিত্র। সন্তুষ্ট চিত্তে প্রাণভরে তিনি আশীর্বাদ জানালেন দুই রাজকুমারকে।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content