ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
দণ্ডকারণ্যের গহন অরণ্য মাঝে একলা কুটিরবাসিনী সীতা, দু’ চোখে তার বর্ষার সজল কাজল মেঘের ছায়া। স্বামী রামচন্দ্রের অনুপস্থিতি, দূর বনপ্রদেশ থেকে ভেসে আসা তাঁর আর্ত স্বর অস্থির করে তুলেছে তাঁকে। অজানা অনিষ্টের আশঙ্কা অন্তরে তুলেছে উথাল-পাথাল ঢেউ। সেই সঙ্গে দেবর লক্ষ্মণের প্রতি গাঢ় অবিশ্বাসের বিষবাষ্পে আলোড়িত তাঁর মন। লক্ষ্মণ তাঁর কঠোর, কুৎসিত বাক্যবাণে বিদ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত বনদেবতাদের হাতে তাঁর রক্ষার ভার সঁপে দিয়ে চলে গিয়েছেন রামের সন্ধানে। সীতা নিজের মানসিক স্থৈর্য, সুস্থিত ভাবনা— সব একলহমায় হারিয়ে ফেলে বসে রয়েছেন সাধারণ রমণীর মতো। আশ্রম জুড়ে বাতাস বইছে, সে বাতাস যেন ভারী হয়ে আছে উৎকণ্ঠায়, ব্যাকুলতায়, অশ্রুবাষ্পে। আশ্রমে নেমে এসেছে যেন অকালসন্ধ্যার ভয়াল আঁধার।
লঙ্কেশ্বর দশানন রাবণের অপেক্ষা তো এমন উপযুক্ত পরিস্থিতিরই। আহা! জীবনের শেষ লগ্নে মারীচ যে বড় উপকার করল তাঁর। রাবণ দেখছেন, দুই ভাই আশ্রম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। আশ্রমে একাকী তরুণী বিদেহরাজনন্দিনী সীতা। ভোরের আলোর মতো রূপ তাঁর। দৈবী সে রূপের আকর্ষণে ত্রিভুবনজয়ী লঙ্কাধিপতির মন লুব্ধতার সীমা অতিক্রম করে ফেলল। মুহূর্তকাল আর অপেক্ষা নয়। সীতাকে নিয়ে যাবেনই তিনি লঙ্কায়। রাবণ জানেন, তিনি অপরাজেয়। ক্ষমতাবলে জগতে সবই তাঁর করায়ত্ত হতে পারে।
সুকৌশলী রাবণ এবার পরিব্রাজকের সৌম্য রূপ ধারণ করলেন। পরনে তাঁর সূক্ষ্ম গৈরিক বসন। মাথায় শিখা, হাতে কমণ্ডলু, ত্রিদণ্ড। পায়ে তাঁর পাদুকা, বাম কাঁধে সমিধ-কুশের ভার। বহিরঙ্গে এখন তিনি শান্ত, সংযত সন্ন্যাসী। কিন্তু অন্তরে তাঁর দুঃসহ কামনার চোরাস্রোত। আশ্রমের বাইরে প্রকৃতিজগৎ তাঁর এই কপট মায়ার খেলায় স্তব্ধ, আশঙ্কিত। বেগবতী গোদাবরী আসন্ন বিপদ শঙ্কায় হারিয়ে ফেলল তার স্বচ্ছন্দ গতি। রাবণকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল বনের নিরীহ যত পশুপাখি। তৃণাচ্ছাদিত কূপের মতো রাবণ ছদ্মরূপে এগিয়ে গেলেন আশ্রমকুটিরের অভিমুখে।
সুকৌশলী রাবণ এবার পরিব্রাজকের সৌম্য রূপ ধারণ করলেন। পরনে তাঁর সূক্ষ্ম গৈরিক বসন। মাথায় শিখা, হাতে কমণ্ডলু, ত্রিদণ্ড। পায়ে তাঁর পাদুকা, বাম কাঁধে সমিধ-কুশের ভার। বহিরঙ্গে এখন তিনি শান্ত, সংযত সন্ন্যাসী। কিন্তু অন্তরে তাঁর দুঃসহ কামনার চোরাস্রোত। আশ্রমের বাইরে প্রকৃতিজগৎ তাঁর এই কপট মায়ার খেলায় স্তব্ধ, আশঙ্কিত। বেগবতী গোদাবরী আসন্ন বিপদ শঙ্কায় হারিয়ে ফেলল তার স্বচ্ছন্দ গতি। রাবণকে দেখে ভয়ে পালিয়ে গেল বনের নিরীহ যত পশুপাখি। তৃণাচ্ছাদিত কূপের মতো রাবণ ছদ্মরূপে এগিয়ে গেলেন আশ্রমকুটিরের অভিমুখে।
আরও পড়ুন:
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫১: মারীচমায়ায় কি দিগভ্রান্ত সীতা?
ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-২: রাজাদের স্থাপত্য-কীর্তি ও রাজধানী
পাতায় ছাওয়া কুটিরে, চোখের জলে ভেসে রামের অপেক্ষায় অধীর হয়ে বসে রয়েছেন সীতা। চিন্তায় শোকে তাঁর অস্থির অবস্থা। যেন তিনি আজ চন্দ্রহীনা আঁধার রাত্রি। রাবণ এলেন সন্ন্যাসীবেশে কুটিরপ্রান্তে। লুব্ধ মনে উপভোগ করলেন সীতার অপার সৌন্দর্য। প্রলুব্ধ মন অশান্ত হয়ে উঠল সীতার অনুপম অঙ্গলাবণ্যে। বেদমন্ত্র উচ্চারণ করে স্তুতি শুরু করলেন সীতার—“হে চারুমুখী, বিলাসিনী, তুমি কি শ্রী, না কীর্তি, না কি লক্ষ্মী, না অপ্সরা? না কি তুমি স্বেচ্ছাবিহারিণী কামপত্নী রতি?” লঙ্কাধিপতির কথার পরতে পরতে সীতার আনখশির দেহসৌন্দর্য হতে লাগল উন্মোচিত।
কপটসন্ন্যাসী সীতার কল্যাণ চিন্তা করে জানালেন, তিনি তাঁকে এই ভয়াল বনের মাঝে জনহীন কুটির থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চান। সীতার এমন ‘থির বিজুরি’ রূপ এই নির্জন কান্তারভূমিতে শোভা পায় না। এ অরণ্যে কামরূপী রাক্ষসদের বড় উপদ্রব, হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয়। পদে পদে প্রাণহানির শঙ্কা। আর এমন কঠিন ভূমিতলে শয্যা, ফলমূল আহার কি এমন দৈবী রূপবতী নারীর উপযুক্ত? সীতার প্রাপ্য ছিল জগতের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, অলংকার। প্রাপ্য ছিল দিগ্বিজয়ী বীর স্বামী। কিন্তু সে কিছুই পায়নি বলে সন্ন্যাসীর বোধ হচ্ছে।
কপটসন্ন্যাসী সীতার কল্যাণ চিন্তা করে জানালেন, তিনি তাঁকে এই ভয়াল বনের মাঝে জনহীন কুটির থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে চান। সীতার এমন ‘থির বিজুরি’ রূপ এই নির্জন কান্তারভূমিতে শোভা পায় না। এ অরণ্যে কামরূপী রাক্ষসদের বড় উপদ্রব, হিংস্র পশুর আক্রমণের ভয়। পদে পদে প্রাণহানির শঙ্কা। আর এমন কঠিন ভূমিতলে শয্যা, ফলমূল আহার কি এমন দৈবী রূপবতী নারীর উপযুক্ত? সীতার প্রাপ্য ছিল জগতের শ্রেষ্ঠ খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, অলংকার। প্রাপ্য ছিল দিগ্বিজয়ী বীর স্বামী। কিন্তু সে কিছুই পায়নি বলে সন্ন্যাসীর বোধ হচ্ছে।
আরও পড়ুন:
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?
পরনে সন্ন্যাসীর বেশ। মুখে সীতার উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি। গেরুয়াবসন সন্ন্যাসীর কথায় ভ্রম জাগে, অবিশ্বাস দানা বাঁধে সীতার মনে। আবার ব্রাহ্মণ জ্ঞান করে উপেক্ষাও করতে পারেন না। অবসন্ন মনে অতিথি সৎকারের আয়োজন করেন। মনের ভার কিছুটা যেন লাঘব হয় সীতার। অকপটে সন্ন্যাসীর কাছে নিজের কুল, স্বামীর পরিচয়, তাঁর গুণাবলী বলতে শুরু করেন। বলতে থাকেন, অযোধ্যায় রাজ্যাভিষেকের পূর্ব মুহূর্তে কৈকেয়ীর মনস্কামনা পূরণের জন্য কীভাবে পিতৃসত্য পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তাঁর স্বামী। তারপর শুরু হয় তাঁদের চোদ্দ বছরের বনবাস জীবন।
অযোধ্যা ত্যাগ করে আসার সময় রাম ছিলেন পঁচিশ বছরের পূর্ণ যুবা, আর সীতা নিজে ছিলেন অষ্টাদশী। জনকনন্দিনী বৈদেহী যুক্তিক্রম হারিয়ে ভুলে যান, অপরিচিতা নারীর দেহসৌন্দর্যের সকাম স্তুতি পরিব্রাজকের স্বভাব নয়। সীতার নিঃসঙ্কোচ আত্মকথন শুনতে শুনতে লঙ্কাধিপতির মনে সীতাকে প্রাপ্তির, তাঁকে হরণের বাসনা দৃঢ়তর হয়ে ওঠে।
অযোধ্যা ত্যাগ করে আসার সময় রাম ছিলেন পঁচিশ বছরের পূর্ণ যুবা, আর সীতা নিজে ছিলেন অষ্টাদশী। জনকনন্দিনী বৈদেহী যুক্তিক্রম হারিয়ে ভুলে যান, অপরিচিতা নারীর দেহসৌন্দর্যের সকাম স্তুতি পরিব্রাজকের স্বভাব নয়। সীতার নিঃসঙ্কোচ আত্মকথন শুনতে শুনতে লঙ্কাধিপতির মনে সীতাকে প্রাপ্তির, তাঁকে হরণের বাসনা দৃঢ়তর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন:
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৯: পৌরুষ, পুরুষ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও কিছু সমস্যা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে
রাবণ এ বার ছদ্মবেশ ত্যাগ করলেন। সীতার সামনে দাঁড়িয়ে দশানন রাবণ আত্মপরিচয় দিলেন। ত্রিভুবনজয়ী বীর তিনি। কপটবেশে নারীর মন জয়ের চেয়ে অনেক বেশি বিশ্বাস তাঁর নিজের বিক্রমে, বাহুবলে। অমিতবিক্রমে নারীকে জয় করবেন—এ সত্যেই আস্থা তাঁর। অকপটে বললেন, তিনি সর্বলোকজগতের সন্তাপ সৃষ্টিকারী। দেবতারাও হার মেনেছেন তাঁর কাছে। তিনি ব্রহ্মার মানসপুত্র পুলস্ত্যের পৌত্র, মহাত্মা বিশ্রবার পুত্র, কুবেরের বৈমাত্রেয় ভাই। লোকপ্রজাপতি ব্রহ্মার বরে তিনি ইচ্ছানুসারে রূপ ধরতে পারেন।
এরপরেই প্রস্তাব এল, “সীতা, তুমি রূপে গুণে লোকজগতে অনন্যা। আমার বড় অভিলাষ, তুমি আমার প্রধান মহিষী হও। সমুদ্রের মাঝে এক দ্বীপে লঙ্কা নগরীতে আমার প্রাসাদ। জগতের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য সেই নগরীতে যেন রূপ পেয়েছে। ত্রিশ যোজন ব্যাপী আমার প্রাসাদ ইন্দ্রের অমরাবতীর মতোই ঐশ্বর্যশালী। সেই প্রাসাদে তুমি পাঁচশ দাসীর সেবায় দিন কাটাবে সীতা। লঙ্কানগরীর শ্রেষ্ঠ উপবনগুলিতে আমরা বিহার করবো। তোমার তখন আর এই অরণ্যবাসের কঠিন দিনগুলোর কথা মনে থাকবে না। সীতা, তুমি আমার কথা মেনে নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।”
এ বার যেন সম্বিত ফিরে পেলেন জনকাত্মজা। ক্রোধে জ্বলে উঠল তাঁর দুই চোখ। মুখভঙ্গিমায় ফুটে উঠল উপেক্ষা আর অনাদরের বার্তা। লঙ্কারাজ রাবণের অমিত ঐশ্বর্যের প্রলোভনকে তাচ্ছিল্যভরে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। —চলবে।
এরপরেই প্রস্তাব এল, “সীতা, তুমি রূপে গুণে লোকজগতে অনন্যা। আমার বড় অভিলাষ, তুমি আমার প্রধান মহিষী হও। সমুদ্রের মাঝে এক দ্বীপে লঙ্কা নগরীতে আমার প্রাসাদ। জগতের শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য সেই নগরীতে যেন রূপ পেয়েছে। ত্রিশ যোজন ব্যাপী আমার প্রাসাদ ইন্দ্রের অমরাবতীর মতোই ঐশ্বর্যশালী। সেই প্রাসাদে তুমি পাঁচশ দাসীর সেবায় দিন কাটাবে সীতা। লঙ্কানগরীর শ্রেষ্ঠ উপবনগুলিতে আমরা বিহার করবো। তোমার তখন আর এই অরণ্যবাসের কঠিন দিনগুলোর কথা মনে থাকবে না। সীতা, তুমি আমার কথা মেনে নিয়ে আমার সঙ্গে চলো।”
এ বার যেন সম্বিত ফিরে পেলেন জনকাত্মজা। ক্রোধে জ্বলে উঠল তাঁর দুই চোখ। মুখভঙ্গিমায় ফুটে উঠল উপেক্ষা আর অনাদরের বার্তা। লঙ্কারাজ রাবণের অমিত ঐশ্বর্যের প্রলোভনকে তাচ্ছিল্যভরে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। —চলবে।
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।