রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

রামের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত, নিহত হল খর, দূষণ, ত্রিশিরা সহ জনস্থানবাসী চোদ্দ হাজার রাক্ষস। শূর্পণখা আশায় বুক বেঁধেছিল যে, খর-দূষণের পরাক্রমের কাছে পরাভূত হবে রাম। রামের উষ্ণ রক্ত সে পান করবে। তার অপমানের জ্বালা জুড়োবে। কিন্তু এ ঘটনায় সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেল সে। রাক্ষসশক্তির এমন পরাভব সে আগে কখনও হতে দেখেনি। আর সহ্য করতে পারল না শূর্পণখা। সে ছুটে গেল লঙ্কায়, রাক্ষসরাজ রাবণের কাছে।

লঙ্কেশ্বর রাবণ তখন প্রাসাদের উপরিতলে সোনার সিংহাসনে বসে আছেন। দশ মাথা আর কুড়িটি হাত প্রসারিত করে পর্বততুল্য দেহে সিংহাসনে বিরাজ করছেন তিনি। সচিবেরা ঘিরে রয়েছে তাঁকে। শূর্পণখার মনে হল, যেন সামনে দেখছেন প্রখরতেজ অগ্নিদেবতাকে। ঘন নীল মেঘের মতো তাঁর কমনীয় কান্তি। উজ্জ্বল সোনার আভূষণে, রক্তচন্দনের অনুলেপনে, রক্তবর্ণ রুদ্রাক্ষমালায় সুসজ্জিত তাঁর দেহ। সে দেহে রাজলক্ষণ পরিস্ফুট। সেই সঙ্গে বিগত সব ভয়াবহ যুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন রূপে দেহে বিষ্ণুচক্র ও অন্যান্য অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন তাঁর বীরত্বের জয়গাথা গাইছে। দশানন রাবণ নিজের প্রতাপ দেখাতে গিয়ে কখনও দেবতাদের উৎপীড়ন করেছেন, ইন্দ্রের নন্দনবন ছারখার করেছেন, কখনও ভোগবতী পুরীতে গিয়ে বাসুকিকে পরাস্ত করে তক্ষকের প্রিয় ভার্যাকে হরণ করে নিয়ে এসেছেন, আবার কখনও কৈলাসে গিয়ে কুবেরকে পরাস্ত করে তাঁর পুষ্পক রথ নিয়ে এসেছেন। আবার এই লোকপীড়ক রাবণই গোকর্ণতীর্থে মহাবনে জ্বলন্ত অগ্নির মাঝখানে ঊর্ধপদ হয়ে দশ সহস্র বছর তপস্যা করেছেন।
ব্রহ্মাকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে ব্রহ্মার বরে তিনি হয়েছেন দেবতা, দানব, রাক্ষস, গন্ধর্বদের অজেয়, ইচ্ছারূপধারী। রাবণ মহাবল। অচঞ্চল সমুদ্র তাঁর শক্তিতে উত্তাল হতে পারে, পর্বত শিখর ভেঙে পড়তে পারে। তিনি স্বভাবে নিষ্ঠুর, কর্কশভাষী, লোকের অনিষ্টকারী। যজ্ঞ নষ্ট করায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তাঁর দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপে লোকজগৎ ভীত, দেবতারা ত্রস্ত।

শূর্পণখা এমন অগ্রজের সামনে এসে দাঁড়াল। তার মনের মধ্যে ক্রোধের আগুন দাউদাউ শিখায় জ্বলছে। তার মনে হচ্ছে, লঙ্কাধিপতি রাক্ষসরাজ রাবণ নিজে কর্তব্যচ্যুত হয়ে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করছেন। প্রজাদের প্রতি সঠিক দায়িত্ব তিনি পালন করছেন না। সে সক্রোধে, কর্কশ স্বরে তার বক্তব্য বলতে শুরু করল—“তুমি কামভোগে প্রমত্ত হয়ে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করছ। কারণ তোমাকে বাধা দেওয়ার কেউ নেই। তুমি জানোই না যে রাক্ষসদের কি ভয়ংকর বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। কামনায় মত্ত, লোলুপ রাজাকে প্রজারা শ্মশানের আগুনের মতো অস্পৃশ্য মনে করে, একথা জানো নিশ্চয়ই। যে মহীপতি নিজের কর্তব্য সঠিক সময়ে যথাযথ ভাবে পালন করেন না, তিনি অচিরেই রাজ্যভ্রষ্ট হন এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। প্রজারা এরকম অধর্মজ্ঞ রাজাকে দূর থেকেই পরিহার করে। মহারাজ, রাজারা গুপ্তচরের মাধ্যমে দূরের বিষয় জানতে পারেন। সেজন্য তাঁদের চারচক্ষুও বলা হয়। তুমি হলে অযুক্তচার রাজা। তুমি গুপ্তচর নিয়োগ করনি, ফলে অজ্ঞতাবশত জনস্থানে রাক্ষসদের পরিস্থিতিও জানো না।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৭: প্রতিশোধের আগুন কি ডেকে আনল মৃত্যুমিছিল?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৪: কবির ভালোবাসার নজরুল

একজন পদাতিক মানুষ হয়েও রাম কিভাবে দীপ্ত তেজে জনস্থানকে রাক্ষসশূন্য করেছে, একাই চোদ্দ হাজার রাক্ষসকে বধ করেছে, এ বার্তা কি তোমার গোচরে এসেছে? দণ্ডকারণ্যের ঋষিদের অভয় দিয়ে জনস্থানকে রাক্ষসশূন্য করেছে সে। অথচ তুমি রাজসিংহাসনে সচিবদের নিয়ে নিশ্চিন্তে বসে আছো। তোমার মতো উচ্ছৃঙ্খল, আত্মগর্বে গর্বিত পুরুষের নিধন অবশ্যম্ভাবী। তুমি রাক্ষসদের রাজা হওয়ার যোগ্যই না।”

শূর্পণখার রাজনৈতিক বুদ্ধির প্রখরতা যথেষ্ট। সে জানে, রাবণকে উদ্দীপ্ত করার উপায়। রাজসভায় সচিবদের উপস্থিতিতেই সে একটানা বিদ্রূপ বাক্যে বিদ্ধ করেছে লঙ্কাধিপতিকে।

তার বাক্যবাণ স্বভাবতই জাগিয়ে তুলল রাক্ষসরাজের ক্রোধ। কর্কশ বাক্যে তিনি জানতে চাইলেন রামের পরিচয়—“কে রাম? কোথা থেকে এসেছে সে? তার কেমন পরাক্রম? কি জন্য দুর্গম দণ্ডকারণ্যে এসেছে সে? কেমন অস্ত্র ব্যবহার করে রাম, যে অস্ত্রে খর, দূষণের মতো বীর রাক্ষসেরাও নিহত হয়েছে?” রাবণের মনে অনেক প্রশ্ন জেগে উঠল রামকে ঘিরে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৬: যুগে যুগে যা ‘সবার উপরে’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১২: হঠাৎ স্নানঘর থেকে পঞ্চমের চিৎকার ‘মিল গয়া মিল গয়া’, সৃষ্টি হল সেই জনপ্রিয় গান ‘মুসাফির হুঁ ইয়ারো’

তাঁর প্রশ্ন শুনে শূর্পণখা বলল রামের বৃত্তান্ত। “রাম দশরথের পুত্র, দীর্ঘবাহু, আয়তনেত্র, চীরবসনধারণকারী কন্দর্পকান্তি পুরুষ। যুদ্ধে আমি দেখেছি, ইন্দ্রধনুর তুল্য স্বর্ণমণ্ডিত ধনু থেকে মহাবিষ সর্পের মতো নারাচ নিক্ষেপ করছে সে। ধনুর্ধর রাম একাই শিলাবৃষ্টির মতো তীক্ষ্ণ তীর নিক্ষেপ করে প্রচণ্ড শক্তিধর চোদ্দ হাজার রাক্ষসকে বধ করল- এ আমি স্বচক্ষে দেখেছি। শুধু নারী বলে আমার প্রতি দয়াবশত নাক-কান ছেদন করে প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছেন। রামের ভাই লক্ষ্মণ, সেও মহাবীর, রামের অনুগত। সে যেন তার বাইরে থাকা প্রাণ- এতোই একাত্ম দুই ভাই। আর রামের পত্নী সীতাও সঙ্গে আছে তাদের। সে ভারি যশস্বিনী, সৌন্দর্যময়ী নারী। জগতে তার মতো রূপ এবং গুণ -দুইই বিরল। আমি এর আগে কখনো এত সুন্দরী নারী দেখিনি। সীতা যার প্রণয়িনী হবে, যাকে আনন্দে আলিঙ্গন করবে, সে জগতে ইন্দ্রের সমতুল্য মনে করবে নিজেকে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

দশভুজা: পিকনিক দল থেকে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু: তাঁর লেন্সের বিস্তৃতি ছিল বিস্ময়কর

মহারাজ, আমি মনে করি, সীতা মর্ত্যলোকে অতুলনীয়া, সে তোমার উপযুক্ত নারী, তুমিই হতে পারো তার উপযুক্ত পতি। তুমি যদি একবার সেই পূর্ণ চন্দ্রের মতো পরিপূর্ণ সৌন্দর্যমণ্ডিত নারীকে দেখো, তুমি সঙ্গে সঙ্গেই কামনার বশীভূত হয়ে যাবে। যদি তাকে ভার্যা রূপে পেতে ইচ্ছা হয়, তবে এখনই বিজয় লাভের জন্য যুদ্ধযাত্রা কর। রাম এবং লক্ষ্মণের প্রতি তোমার যে শত্রুতাবোধ জন্মেছে, তার প্রতিকার করো। তীক্ষ্ণ বাণে রাম লক্ষ্মণকে বধ করে সীতাকে যথোচিত ভাবে ভোগ করো।”

শূর্পণখা এভাবেই রাবণের অভীষ্ট পূরণের দিকে এগিয়ে দিল তাঁকে। কিন্তু এ অভীষ্ট পূরণেই তো নিজের বংশের ধ্বংসের বীজ নিহিত। সে ভবিষ্যতের রূপ ধরা দিল না কারো মনেই। রাবণ হর্ষে উৎফুল্ল হয়ে সীতাকে প্রাপ্তির আশায় সেই আত্মবিনাশের উপায়টিকেই বেছে নিলেন।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content