রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


ছবি: সংগৃহীত।

সুতীক্ষ্ণ মুনির আশ্রম থেকে বের হয়ে আবার পথ চলা শুরু হল। উজ্জ্বল রৌদ্রকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে বনভূমির পাতার আড়াল ভেদ করে। তার কঠোর তাপ তখনও ঝলসে দেয়নি জগৎসংসার। রামের উদ্দেশ্যে সীতার মনে জমে আছে বেশ কিছু কথা, বেশ কিছু শঙ্কা। শরভঙ্গ মুনির আশ্রমে রামের শরণাপন্ন মুনিদের রাম আশ্বাস দিয়েছিলেন রাক্ষসদের দমন করে রক্ষা করবেন তাঁদের। সে প্রতিশ্রুতির মধ্যে অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছেন সীতা। আর দেরি না করে এবার বলা উচিত সেই ভয়-ভাবনার কথা।
বিদুষী রাজনন্দিনী সীতার মুখ থেকে সেসব কথা বেরিয়ে এল ভোরের স্নিগ্ধ উজ্জ্বল আলোর মতো — “রাঘব, যাঁরা সজ্জন তাঁরা অহিংসার পথেই ধর্ম অর্জন করে থাকেন। আর সাতটি যে ব্যসন রয়েছে, সেগুলিকে ধর্মের বিনাশক বলেই জানি। রাজার ধর্ম নষ্ট হয় সাতটি ব্যসনে। তার মধ্যে চারটি কামজ ব্যসন আর তিনটি ক্রোধজ ব্যসন-এ তো তোমার অজানা কিছু নয়। কামজ ব্যসনের মধ্যে প্রথমেই স্থান মিথ্যাবাক্যের। দ্বিতীয় স্থানে পরস্ত্রীগমন। আর তৃতীয়টি হল অকারণ পরহিংসা। শাস্ত্রকাররা যাকে অকারণ রৌদ্রতা বলেছেন। শত্রুতা ছাড়াই মানুষ যখন হিংসা করে তখন সে এই ক্রূর আচরণটি করে ফেলে। প্রথম দুটির থেকে এটি আরও বেশি গুরুতর। যাঁরা জিতেন্দ্রিয়, তাঁরা এসব আচরণের থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন। রাঘব, তোমাকেও তো ইন্দ্রিয়জয়ী মানুষ বলেই চিনি। তুমি মিথ্যাবাক্য কখনোই বলবে না, এ আমি নিশ্চিত। পরস্ত্রীদূষণ তোমার দ্বারা কখনই ঘটবে না, এও আমি স্থিরভাবে বিশ্বাস করি। কিন্তু অকারণ রৌদ্রতা নামক তৃতীয় ব্যসনটিতে তোমার প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে আমি বড় দুশ্চিন্তায় আছি।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬: রামচন্দ্রের আবির্ভাব ও বসুন্ধরাকন্যা সীতার অনুষঙ্গ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৮: রবীন্দ্রনাথ সাঁতার কাটতেন, সাঁতার শেখাতেন

তুমি রাক্ষসদের বধ করে তাদের দমন করার যে আশ্বাস ঋষিদের দিয়েছ, তার ফলে অকারণ পরহিংসা অনিবার্য। এতে রাক্ষসদেরও তোমার প্রতি বৈরিভাব জন্মাবে। পরিণামে তোমার অকল্যাণ হবে রাঘব। দণ্ডকারণ্যে তুমি, লক্ষ্মণ দু’ জনেই ধনুর্বাণ ধারণ করে পথ চলছ, পথে বনচারী রাক্ষস দেখলে তাদের উদ্দেশ্য করে তীর ছুঁড়বে তোমরা, এ তো অনিবার্য সত্য। আর যদি তীর নাও ছোঁড়ো, তবুও তোমাদের মতো শক্তিশালী ধনুর্ধারীদের দেখতে পেলে বনচারীরাও তো শত্রু বলেই মনে করবে। তারা যখন জানবে যে, তুমি তাদের বধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, তখন তারা আড়ালে তোমাদের অনিষ্ট সাধনেরই চেষ্টা করবে। এসব ভেবে ভয়ে আমার বুক কেঁপে উঠছে রাঘব। সব সময় তোমার মঙ্গল চিন্তা করি। কিন্তু এখন বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। দণ্ডকারণ্যে আমার আর একটুও থাকতে ইচ্ছা করছে না।
আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-১৩: পয়লা বৈশাখের ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’— অসম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্ব ঐতিহ্য

অণুগল্প: কাজু বরফি

রাঘব, ক্ষত্রিয়ের জন্য ধনুর্বাণ হল আগুনের ইন্ধনের মতো। ক্ষত্রিয়ের কাছে অস্ত্র থাকলে তার স্বভাব এমনিতেই হিংস্র হয়ে ওঠে। সে ইচ্ছা না করলেও তার তেজ বেড়ে যায়। একটা প্রাচীন আখ্যান মনে পড়ছে। এক তপস্বী ছিলেন। পবিত্র, শান্ত স্বভাব তাঁর। এক তপোবনে নির্জনে, নিরালায় তপঃসাধনা করেন তিনি। ইন্দ্র একবার তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোর উদ্দেশ্যে একটি তীক্ষ্ণ খড়গ এনে গচ্ছিত রেখে গেলেন তাঁর কাছে। গচ্ছিত বস্তুটি সযত্নে রক্ষা করতে হবে বলে তপস্বী সব সময় সেটি নিজের কাছে রাখতেন। বনে ফলমূল আনতে গেলেও সেটি চুরি যাওয়ার ভয়ে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শেষে খড়্গটির সংসর্গে তিনি ক্রমেই হিংস্র স্বভাবের হয়ে উঠতে লাগলেন। তপস্বী ভুলে গেলেন তাঁর সংযত তাপসোচিত স্বভাব। ক্রূরতা, নিষ্ঠুরতা গ্রাস করে নিল তাঁকে। অকারণ হিংসায় ধর্মচ্যুতি হল তাঁর। অবশেষে নরকে গেলেন তিনি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৫: শরীর ফিট রাখতে রোজ ভিটামিন টনিক খাচ্ছেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫০: ‘ফিশ পাস’ পুরোদমে চালু হলে ইলিশের প্রজনন বাধাহীনভাবে সম্ভবপর হবে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

তুমি তো সবই জানো রাঘব। আমি তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এ গল্প বললাম না, বললাম স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য। তোমাকে শিক্ষা দেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। এসব কথা বলছি তোমাকে ভালোবেসে। তুমি ধনুর্বাণ ধারণ করে হিংসার বৃদ্ধি করো না। আমার অনুরোধ, তুমি শত্রুতা ছাড়া রাক্ষসদের বধ করো না। তারা অন্যায় করলে তবেই তুমি তার শাস্তি দিও। স্বধর্ম পালনকারী ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল আর্তের রক্ষা করা। সে পর্যন্তই যেন তোমার ধনুর কর্তব্য সীমিত থাকে। রাজ্য পরিত্যাগ করে এই বনবাস কালে কোথায় অস্ত্র আর ক্ষাত্রধর্ম, কোথায়ই বা তপস্যা! পরস্পরবিরোধী দুই বিষয়। এখন আমাদের তপশ্চরণের বিরোধী ক্ষাত্রতেজ পরিত্যাগ করে তপোবনের ধর্মই পালন করা উচিত। তবেই তা দেশকালের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক: পর্ব-৯: নুনিয়া

একই ননস্টিক পাত্রে দীর্ঘদিন রান্না করছেন? কী ভাবে বুঝবেন তা পরিবর্তনের সময় এসেছে না কি

রাঘব, তুমি অযোধ্যায় ফিরে আবার ক্ষাত্রধর্মের আচরণ করো। কিন্তু এই তপোবনে স্থানকালোচিত সংযমধর্ম পালন করো। হিংসা থেকে নিবৃত্ত হও। তুমি ধর্মবোধ অনুসারে রাজ্য পর্যন্ত ত্যাগ করলে, তাহলে তপোবনের ধর্ম অনুসারে তোমার এখন শুদ্ধ, সংযত, মুনিব্রতই পালন করা উচিত। তুমি জানো, দেশ-কাল অনুসারী ধর্ম আচরণ করলে, তার থেকেই অর্থ, তার থেকেই সুখ, তার দ্বারাই স্বর্গ লাভ হয়। ধর্মসার এই জগতে ধর্মলাভের সব উপায়ই তো তোমার জানা আছে, রাঘব। তুমি এবার লক্ষ্মণের সঙ্গে পরামর্শ করে যা অভিপ্রেত মনে হয় তাই করো।” সীতা এই বলে থামলেন। বুকের মধ্যে জমে থাকা বক্তব্যের পাষাণভার কিছুটা যেন নেমে গেল।

রামের মনে কতটা দাগ কেটে গেল সীতার বলা কথাগুলি? তিনি কি গ্রহণ করলেন সে বক্তব্যের অর্থভার? রাম স্বীকার করলেন, সীতার বক্তব্যের যথার্থতা। কিন্তু তিনি এও মনে করেন, দণ্ডকারণ্যের মুনিরা আর্ত হয়েই তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। কাজেই আর্তরক্ষায় তিনি ক্ষত্রিয় বীররূপে বদ্ধপরিকর। মুনিদের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি, তার থেকে সরে আসতে পারবেন না কিছুতেই।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content