বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি সংগৃহীত।

পূবের আকাশে লালচে আভা ছড়িয়েছে সবেমাত্র। সূর্য ওঠার আগে প্রতিদিনের মতোই শুরু হল পৃথিবীপতিকে জাগানোর পর্ব। স্তুতিগায়ক, সূত, মাগধেরা রাজার বন্দনা করতে শুরু করল। সোনা-রূপোর পাত্রে চন্দনসুবাসিত স্নানের জল নিয়ে এল পরিচারকেরা। রাজ-অন্তঃপুরের রমণীরা ঘুম ভেঙে এসে নিজের নিজের কাজে উপস্থিত হল রাজার কাছে। চন্দন, অগুরু, তেল, পরিচর্যার আরও নানান উপকরণ নিয়ে উপস্থিত হল পরিচর্যানিপুণ পুরুষেরা। তবুও ঘুম ভাঙল না রাজার। ভয়ে, আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল অন্তঃপুরিকাদের। নাড়ীজ্ঞানসম্পন্ন মহিষীরা রাজাকে স্পর্শ করে দেখলেন, শরীরে প্রাণের সাড়া আর নেই। ‘হায়! হায়! মহারাজ আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন’—কান্নায় ভেঙে পড়লেন অন্তঃপুরিকারা। রাত্রি জাগরণের ক্লান্তিতে, শোকের শ্রান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন কৌশল্যা, সুমিত্রা। কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল তাঁদের। শোকের বার্তা মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল রাজপুরী থেকে নগরে, জনপদে—যেন পিতৃবিয়োগের বেদনাভার গ্রাস করল সমস্ত রাজ্যকে।
শয্যায় শায়িত রাজার দেহ আজ যেন নির্বাপিত অগ্নিশিখা, শুকিয়ে যাওয়া গভীর, শূন্য সমুদ্রখাত। অস্তাচলগামী সূর্যের মতোই নিভে গিয়েছে তাঁর শৌর্য, বীর্য, অমিত বিক্রম। কৌশল্যা রাজার চরণে আছড়ে পড়ে কাঁদতে লাগলেন। পুত্রের বনবাসদুঃখ আর স্বামী হারানোর শোক— দুইয়ের ভারে তিনি আজ বড় নিঃসহায়। তাঁর মনে পড়ছে, পুত্রশোকে কতই না তীব্র বাক্যে বিদ্ধ করেছেন রাজাকে। আজ চোখের জলে ক্ষমা চাইলেন রাজার কাছে। কিন্তু কৈকেয়ীকে কোনওক্রমেই ক্ষমা করতে পারলেন না কৌশল্যা।

কৈকেয়ীর অভীষ্ট সিদ্ধি, অন্যায় চাহিদা পূরণের বাধ্যবাধকতাই দশরথকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে—এ ভাবনাকে আজ আর দমিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। কাজেই রাজার এক সময়ের প্রিয় মহিষী কৈকেয়ীর প্রতি তপ্ত গরল বাক্য বেরিয়ে এল কৌশল্যার মুখ থেকে—”কৈকেয়ী, তুমি আজ খুশি তো? এখন যাও, তোমার ইচ্ছা মতো নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করো। রাজ্যের লোভে মানুষ এত নিচে নামতে পারে যে নিজের স্বামিকেও মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে দ্বিধা করে না। আসলে, লোভী যারা, তারা কাজ আর অকাজ, কীর্তি আর অকীর্তি, ধর্ম অধর্ম—কোনও কিছুর মধ্যে পার্থক্যই বুঝতে পারে না। তুমি লোভের ফাঁদে পা ফেলে বৈধব্য, অকীর্তি আর জগৎসংসারে নিন্দা —একসঙ্গে এই তিনটে অনর্থযোগ ঘটালে কৈকেয়ী। তবে তুমি দেখে নিও, তুমি মহারাজকে দিয়ে যার জন্য এ রাজ্য থেকে রামকে নির্বাসনের ব্যবস্থা করলে, সেই ভরত এসে তোমার নিন্দাই করবে। তোমার জন্য যে নিষ্পাপ ভরতেরও নিন্দা জুটল কপালে।”

আরও কত কি বিলাপ করে চলেছেন কৌশল্যা। কত ব্যথা, কত না-বলা কথা বেরিয়ে আসছে কান্নার স্রোতে। বিচক্ষণ কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ এবার আদেশ দিলেন, দশরথের মৃতদেহের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে কৌশল্যাকে। অন্তঃপুরিকাদের দল জোর করেই অন্যত্র নিয়ে গেলেন তাঁকে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩১: অন্ধমুনির অভিশাপ কি ফলল তবে?

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৩: বাবা বিশ্বনাথের দরবারে

চার পুত্রের পিতা রাজা দশরথ। মৃত্যুকালে কাছে পেলেন না কোনও পুত্রকেই। কীভাবে সৎকার হবে তাঁর নশ্বর দেহের? তেলপূর্ণ পাত্রে রাজার দেহ রক্ষিত থাকল। বশিষ্ঠ মন্ত্রিদের সঙ্গে নিভৃত কক্ষে আলোচনায় বসলেন। রাজপুত্রদের অনুপস্থিতিতে রাজার সৎকার কিছুতেই মন্ত্রিরা করবেন না বলে স্থির হল। বহুকাল হল রাজ্য ছেড়ে কেকয় দেশে কৈকেয়ীর পিতৃগৃহে বাস করছেন দুই ভাই, ভরত আর শত্রুঘ্ন। তাঁদের নিয়ে আসার ব্যবস্থায় উদ্যোগী হলেন মন্ত্রিরা।

অযোধ্যা আজ অরাজক নগরী। সিংহাসনের ভার আজ নেওয়ার মতো কোনও উত্তরাধিকারী উপস্থিত নেই এ নগরীতে। চন্দ্রশোভাশূন্য আকাশের মতো নিষ্প্রভ তার রূপ। মহাপ্রাণ রাজাধিরাজের অভাব সমগ্র নগরী জুড়েই প্রভাব ফেলেছে। পথে ঘাটে, প্রাঙ্গণে, চত্বরে শোকমগ্ন প্রজাদের হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে। ক্রয় বিক্রয় ভুলেছে ক্রেতা বিক্রেতার দল। শূন্য বিপণিতে ভিক্ষুকেরাও আজ ভিক্ষা নিতে যায়নি। শোকের আবহে মাঝে মাঝেই উঠছে কৈকেয়ীর নিন্দাপ্রসঙ্গ। ভরতজননীর অবশিষ্ট গৌরবটুকুও আজ মুছে দিয়েছে অযোধ্যাপতির মৃত্যুশোক।
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫০: পিতার দেহ থেকে মান্ধাতার জন্ম হল

ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পাওয়ার উপায় কি? দেখে নাও আজকের বিষয়: Seen Comprehension

এমন শ্রীহীন, অরাজক রাজ্য এভাবে তো চলতে পারে না। ইক্ষ্বাকু বংশের গৌরব এ ভাবে মুছে দেওয়া যায় না— রাত পোহালে প্রতিকার ভাবনায় রাজগুরু বশিষ্ঠ, বামদেব, জাবালি, কশ্যপ, মার্কণ্ডেয়, মৌদ্গল্য সভায় বসলেন অমাত্যদের সঙ্গে। রাজ্য এমন অরাজক অবস্থায় পড়ে থাকলে সহজেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, এ বিষয়ে একমত হলেন সকলে। চোর, দস্যু, অন্যায়কারীদের অত্যাচারে সে রাজ্যে অপ্রাপ্ত বিষয়ের প্রাপ্তিও হয় না, প্রাপ্ত বিষয়ের রক্ষাও হয় না। অরাজক রাজ্য হল সারথিহীন দিগভ্রষ্ট রথের মতো। রাজসভায় উপস্থিত অমাত্যরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার বশিষ্ঠের উপরই দিলেন।

সিদ্ধান্ত নিলেন কুলগুরু বশিষ্ঠ। শত্রুঘ্ন সহ ভরতকে মাতুলালয় থেকে দ্রুত নিয়ে আসার জন্য দ্রুতগামী ঘোড়ায় দূত পাঠানোর নির্দেশ দিলেন তিনি। দূতদের বুঝিয়ে দেওয়া হল, রামের নির্বাসন বা পিতৃবিয়োগের শোকসংবাদ ভরতকে কিছুই না জানিয়ে বিশেষ কার্যকারণ বশত দ্রুত নিয়ে আসতে হবে। তাঁকে বলতে হবে, এ হল রাজার আদেশ। উপঢৌকন হিসেবে কেকয়রাজ ও ভরতের জন্য পাঠানো হল উত্তম মানের বস্ত্র, অলঙ্কার।
আরও পড়ুন:

চটজলদি ওজন ঝরাতে চান? তাহলে ভরসা রাখুন এই ৫ রকম বীজে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২০: মেলা থেকে ফিরে ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’

বহু দেশ পার হয়ে সাত রাত্রি পরে দূতেরা পৌঁছলেন কেকয়দেশের গিরিব্রজ নগরীতে। দূতেরা পৌঁছনোর আগের রাত্রিতে ভরত ভীষণ দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন। বিষাদে ভরে গেল তাঁর মন। বন্ধুরা কথা, গল্প, গান-বাজনা—কিছু দিয়েই খুশি করতে পারলেন না তাঁকে। মলিন মুখে বন্ধুদের কাছে অবশেষে খুলে বললেন স্বপ্নের কথা। স্বপ্নে তিনি পিতা দশরথকে দেখেছেন। দশরথকে কয়েক জন লাল রঙের বেশধারী পুরুষ বেঁধে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আবার দেখেছেন, তাঁর পিতা তৈলাক্ত দেহে, খোলা চুলে পাহাড়ের চূড়া থেকে গোময় পূর্ণ সরোবরে পড়ে যাচ্ছেন। কিংবা তিনি রক্ত বর্ণের মালা পরে, গাধায় টানা রথে চড়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাচ্ছেন। কোথাও পাহাড় ভেঙে পড়ছে, কোথাও অশ্বত্থ গাছ ভেঙে পড়ছে।

এরকম নানা অনিষ্টসূচক ভয়ের দৃশ্য দেখে রাত কেটেছে তাঁর। এমন লক্ষণযুক্ত স্বপ্ন যাকে নিয়ে দেখা যায়, তাঁর মৃত্যু হতে পারে- এই ভয়ে শঙ্কিত হয়ে আছেন ভরত। যে সময় বন্ধুদের কাছে স্বপ্ন বৃত্তান্ত বর্ণনা করছেন ভরত, সেই সময়, অযোধ্যা থেকে পথশ্রমে ক্লান্ত দূতেরা প্রবেশ করলেন গিরিব্রজের রাজপ্রাসাদে। ভরত প্রথমেই জানতে চাইলেন— ‘আমার বৃদ্ধ পিতা, নৃপতি দশরথ কুশলে আছেন তো?’ একে একে সকলের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন তিনি। দূতেরা বশিষ্ঠের কথা স্মরণে রেখে দুঃসংবাদ গোপন রেখে কুশল বার্তাই জানালেন ভরতকে। এরপর মাতামহের অনুমতি নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ভরত, শত্রুঘ্ন যাত্রা করলেন অযোধ্যার উদ্দেশ্যে। সাত রাত্রি পরে অবশেষে গোমতী নদী পার করে ভরতের রথ শোকস্তব্ধ নগরীর দুয়ারে এসে দাঁড়ালো।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content