বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: অশোক ঘোষ।

অযোধ্যাপুরী আঁধার করে রাম, লক্ষ্মণ, সীতাকে নিয়ে রথ চলল বনের পথে। তাঁদের সঙ্গ নিলেন কতশত অযোধ্যাবাসী। পথের কষ্ট, চলার ক্লান্তি সব অক্লেশে মেনে নিয়ে রথের পিছু নিলেন তাঁরা। রাজপ্রাসাদে পড়ে রইলেন বৃদ্ধ শোকার্ত পিতা দশরথ, দুঃখিনী মা কৌশল্যা। বিলাপে আর চোখের জলে রাত নামল অযোধ্যায়।

রাতের আঁধারে রথের পথ আটকে দিল তমসা নদী। তমসার তীরে অন্ধকার অরণ্যভূমি। বনের পশুপাখিরা অন্ধকারের চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে নিজেদের বাসায়। প্রাণিদের সাড়াশব্দহীন সেই অরণ্যস্থল যেন রামলক্ষ্মণের বিচ্ছেদবেদনার সমব্যথী, বিষাদকাতর। রাম সুমন্ত্রকে জানালেন সিদ্ধান্ত, এখানেই হবে বনবাসের প্রথম রাত্রিযাপন। অযোধ্যার রাজপুত্র, রাজবধূ আজ বিলাসী কোমল সুখশয্যায় নয়, নিদ্রা যাবেন কঠিন ভূমিতলে, পাতার বিছানায়। পান করবেন শুধু জল। লক্ষ্মণ আর সুমন্ত্র তৈরি করে দিলেন পর্ণশয্যা। সীতাকে নিয়ে রাম নিদ্রা গেলেন সেখানে। পথশ্রমে ক্লান্ত প্রজারাও শুয়ে পড়লেন তমসার তীরে। জেগে রইলেন শুধু অতন্দ্র প্রহরী হয়ে সৌমিত্রি লক্ষ্মণ আর সুমন্ত্র। সামনে অজানা ভবিষ্যৎ, অচেনা বনবাসজীবন।
অর্ধেক রাত কাটল। উঠে বসলেন রাম। চারপাশে ঘুমিয়ে আছেন প্রজারা। প্রিয় রাজপুত্রের জন্য তাঁরা সহ্য করেছেন বহু ক্লেশ, ছেড়ে এসেছেন নিজেদের ঘরবাড়ি, প্রিয় পরিজন। রাম জানেন, তাঁদের অযোধ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করবেন। তিনি লক্ষ্মণকে বললেন, ”পুরবাসীরা ওঠার আগে দ্রুত এই স্থান ছেড়ে চলে যেতে হবে। না হলে তাঁরা আবার পথরোধ করবেন। নিজেদের প্রাণের বিনিময়েও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইবেন আমাদের। অন্যদিকে, রাজার কর্তব্য, প্রজাদের দুঃখ না দেওয়া। কাজেই এই স্থান থেকে এখনই চলো।”

সুমন্ত্র তাড়াতাড়ি করে রথ সাজিয়ে নিয়ে এলেন। রাতের অন্ধকার থাকতেই তাঁরা নিঃশব্দে যাত্রা করলেন অজানা পথের উদ্দেশ্যে। এমন পথে যেতে হবে, পুরবাসীরা যাতে তার আভাস না পায়। রামের নির্দেশে রথ চলল প্রথমে উত্তরদিকে, অযোধ্যার অভিমুখে। তারপর রথ ঘুরিয়ে তাঁরা তরঙ্গ সংকুল তমসা নদী অতিক্রম করে এগিয়ে চললেন অপর পারের পথ ধরে। সে পথ নিষ্কণ্টক, সুন্দর, ভয়হীন। পূব আকাশে তখন সবে আলোর রেখা দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৮: অযোধ্যাবাসীরাও কি সঙ্গী বনযাত্রায়?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৭: রামকথা শ্রবণ— তীর্থে বাসের পুণ্যলাভ করলেন পাণ্ডবেরা

ওদিকে, তমসার তীরে ঘুম ভাঙল পুরবাসীদের। চোখ মেলে দেখলেন তাঁরা, রাজপুত্ররা নেই, পড়ে আছে রথের চিহ্নটুকু। সে চিহ্ন অযোধ্যার অভিমুখে। প্রিয় রাজপুত্র রাম কি তবে আবার ফিরে গেলেন অযোধ্যায়? এ ভাবনার বশে তাঁরা আবার পথ ধরলেন অযোধ্যার।

নগরীতে এসে দেখলেন, শূন্য পুরী। রাম তো ফিরে আসেননি! শোকে, দুঃখে নুয়ে পড়লেন তাঁরা, শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর এ ভাবে রামকে না নিয়ে ফিরে আসায় পত্নীদের বাক্যবাণ বিদ্ধ করল পুরবাসীদের। কোনও কাজে আর মন বসল না তাঁদের।

দ্বিজাতিরা হোম করলেন না, বেদপাঠীর বেদ পাঠে মন বসল না। বণিকরা পণ্য সাজিয়ে বসলেন না, গৃহস্থদের ঘরে রান্না হল না। যাঁদের ঘরে প্রথম সন্তান এল, তাঁদের মুখেও ফুটল না হাসি। পুররমণীদের হতাশ্বাসে ভরে গেল অযোধ্যানগরীর আকাশ বাতাস। রাম যে ছিল তাঁদের প্রিয় পুত্রের মতো! তাঁর থেকে এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠলেন তাঁরা।

ওদিকে তমসার তীর পার হয়ে রথ ছুটেছে দক্ষিণ পথে। ভোরের আলোয় ঝলমল করছে বনের পথ। রথ এসে থামল শ্রীমতী নদীর পারে। বিশাল নদীবক্ষে তরঙ্গের ঘূর্ণিপাক। সে নদীও পার হয়ে গেলেন তাঁরা। পথে পড়ল কত গ্রাম, ছোট ছোট জনপদ। গ্রামের প্রান্তে ফসল ভরা শস্যক্ষেত, ফুলে ফলে ভরা বন। দু’চোখ ভরে সে-সব দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছেন রাম। কানে ভেসে আসছে জনপদবাসীদের বাক্যালাপ — ‘ধিক রাজা দশরথকে। এমন মহাত্মা পুত্রকে শেষে বনবাসে পাঠালেন কামনার বশে! আর কৈকেয়ীর মত এমন নৃশংস, নিষ্ঠুর নারী কি দ্বিতীয় আছে জগতে? তাকেও ধিক্কার!’ কোশল রাজকুমার এসব কথা শুনতে শুনতে পার হয়ে গেলেন কোশল দেশের সীমা।
আরও পড়ুন:

সংসারে শান্তি চাই? বেডরুম সাজানোর সময় অবশ্যই এই বিষয়গুলি মাথায় রাখুন

ডায়েট ফটাফট: নিয়ম করে খান আমন্ড? ভালো থাকবে হার্ট, এড়ানো যাবে রিঙ্কল! এর বহুমুখী পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানা আছে কি?

পথে পড়ল এবার বেদশ্রুতি নদী। বড় রমণীয় তার চলনশৈলী। সে নদী পার করে তাঁরা পৌঁছলেন গোমতী নদীর কূলে। নদীর শীতল জলে প্রাণ জুড়ালো সবার। দ্রতগামী ঘোড়া সে নদীও পার হয়ে গেল অনায়াসে। সারাদিন পথ চলার ক্লান্তিকে প্রশ্রয় না দিয়ে ছুটতে থাকল রথ। পথে সর্পিকা নদী। ময়ূরের কেকা রবে, হাঁসেদের কলস্বনে মুখরিত তার তটভূমি। এই নদী হল কোশল রাজ্যের দক্ষিণ সীমা।

রাম সীতাকে দেখালেন, কোশল দেশের সমৃদ্ধ জনপদ। দেশের সীমানা পার করে আজ সেই দেশের জন্য, পিতামাতার জন্য মন ভারাক্রান্ত স্থিতপ্রজ্ঞ দাশরথি রামেরও। সুমন্ত্র ফিরে যাবেন, ফিরে যাবে তাঁদের রথ। কিন্তু তাঁদের ফেরার পথ যে বন্ধ! আবার কবে ফিরবেন তাঁরা? কবে দেখা হবে পিতামাতার সঙ্গে? কবে সেই সরযূর তীরে ফুলে ফুলে ঢাকা কুসুমকাননে মৃগয়ায় যাবেন তিনি? তাঁর পিতার কত গুণ— কাছে বসে সে-সব অনুভব করবেন আবার কবে? ইক্ষ্বাকুকুল শ্রেষ্ঠের মনের অতলেও শূন্যতা জমে।

দিনের আলো ক্রমশ নিভে এল। ক্ষিপ্রগামী রথ তাঁদের পৌঁছে দিল শৃঙ্গবেরপুর। সুবিশাল এই নগরীর রাজা নিষাদরাজ গূহ। রামের পরম হিতৈষী, সখা তিনি। গূহেরউদার অভ্যর্থনা শ্রান্তি জুড়াল তাঁদের। হিমালয়জাতা, ত্রিপথগামিনী, পাপনাশিনী ভাগীরথী গঙ্গার পুণ্যজল প্রবাহের দর্শন পেলেন তাঁরা এখানেই। আজ রাত কাটাবেন তাঁরা গঙ্গাতটেই, সুমন্ত্রকে জানিয়ে দিলেন রাম। নদীর কাছেই এক বিশালকায় ইঙ্গুদীবৃক্ষ। তার মূলেই হবে রাত্রিবাসের বন্দোবস্ত। নিষাদপতি এসে রামকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর আত্মীয় পরিজনেরা এলেন সেখানে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে। গূহের অনুচরেরা নিয়ে এল বিশুদ্ধ অন্ন, পানীয়, উৎকৃষ্ট শয্যা, ঘোড়াদের জন্য ঘাস
আরও পড়ুন:

চলো যাই ঘুরে আসিঃ অস্ট্রিয়ার ক্রিস্টাল দুনিয়া— সোয়ার্ভস্কি

৭৮ বছর বয়সে নিভৃতে চলে গিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের ভীষ্ম পিতামহ/৩

মাদর করে গূহ বললেন রামকে— “এরাজ্য তো আপনারই। আপনি এসব নিজের ভেবে গ্রহণ করুন।” রাম গূহের আদরে, অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে গেলেন। কিন্তু তিনি এখন বল্কলধারী বনবাসী। একমাত্র ঘোড়ার জন্য ঘাসটুকু ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করলেন না তিনি। রাতের অন্ধকারে গঙ্গাতটে একসঙ্গে প্রহরায় জেগে রইলেন লক্ষ্মণ আর রাজা গূহ।

ভোরবেলা রামের ঘুম ভাঙল কোকিলের মধুরবে, ময়ূরের কেকাধ্বনিতে। রাম মনঃস্থ করলেন, এবার সাগরগামিনী গঙ্গা তাঁরা পার হবেন নৌকায়। সুমন্ত্রকে এবার বিদায় দিয়ে পদব্রজে বনগমনের পালা। অশ্রুসজল চোখে বিদায় নিলেন ইক্ষ্বাকুকুলের পরম হিতৈষী, বিশ্বস্ত অমাত্য সুমন্ত্র। চোদ্দবছর পর পুনর্মিলনের আশ্বাস বুকে নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে শূন্য রথ নিয়ে ফিরলেন তিনি অযোধ্যার পথে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content