রবিবার ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অযোধ্যার রাজকূলবধূ সীতা কেন বল্কল বসন ধারণ করে বনবাসে যাবেন? —এ প্রশ্নে, ধিক্কারে, আর্তকান্নায় নিজের জীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ আজ অযোধ্যার রাজাধিরাজ দশরথ। কৈকেয়ীকে তীব্র ভর্ৎসনা করলেন তিনি—“পাপীয়সি, নৃশংসবুদ্ধি, রামকে বনবাসে পাঠানোর জন্য বর প্রার্থনা করেছিলে তুমি। এখন সীতা আর লক্ষ্মণকেও বল্কল পরতে দিচ্ছ? ধিক্কার তোমার পাপচিন্তাকে। সীতা এই কুশঘাসের চীরবস্ত্র পরবে না।”

এ ঘটনায় ক্রোধে ফেটে পড়লেন কুলগুরু বশিষ্ঠও। কৈকেয়ীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলে উঠলেন, “দুঃশীলা, কুলকলঙ্কিনী কৈকেয়ী, রাজাকে বঞ্চনা করে তোমার স্পর্ধা বেড়ে গিয়েছে। সীতাকে চীর বস্ত্র পরতে দিয়েছ কোন সাহসে? শোনো তুমি, রাম বনবাসে গেলে সীতা বসবেন অযোধ্যার সিংহাসনে, তোমার ছেলে ভরত নয়। আর সীতা যদি বনবাসে যান তবে আমরা সবাই ওদের সঙ্গে যাবো। ভরত যদি দশরথের পুত্র হয়, সে কখনওই রাজ্যভার গ্রহণ করবে না। তোমার সঙ্গে পুত্রের মতো ব্যবহার করবে না। তুমি ভালো চাও তো সীতার চীর বসন খুলে এখনই তাকে উৎকৃষ্ট বসন-ভূষণ দাও।” বশিষ্ঠের সঙ্গে সেই প্রতিবাদে সুর মেলালেন উপস্থিত সকলে।
কিন্তু এরপরও সীতা বল্কলবসনখানি পরেই রইলেন। ক্ষুব্ধ, রুষ্ট প্রজাদের ধিক্কার ধ্বনিতে ক্লান্ত, অসুস্থ বোধ করতে লাগলেন দশরথ। কৈকেয়ীকে উপেক্ষা করে তিনি আদেশ দিলেন, রাজকন্যা, রাজবধূ সীতা সমস্ত অলঙ্কারে সুসজ্জিত হয়ে রামের সঙ্গে যাবেন। তিনি ডেকে পাঠালেন কোষাধ্যক্ষকে। রাজনির্দেশে কোষাধ্যক্ষ কোষাগার থেকে সীতার জন্য নিয়ে এলেন চোদ্দ বছরের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ উৎকৃষ্ট বস্ত্র, আভূষণ। সীতা বসনে ভূষণে সুসজ্জিত হয়ে নির্মেঘ আকাশে উজ্জ্বল সূর্যরশ্মির মতো রাজপুরী আলো করে এসে দাঁড়ালেন কৌশল্যার সামনে। কৌশল্যাও তাঁকে স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে ধরে, মাথায় আশিসচুম্বন করলেন। উপদেশ দিলেন তাঁকে, “যে স্বামীর কাছে স্নেহে, সমাদরে তোমার দিন কেটেছে, তার দুরবস্থায়, নির্ধন অবস্থায় তাঁকে তুমি কখনো অবজ্ঞা কোরো না বৈদেহী।”

সীতা কৌশল্যাকে প্রণাম করে বললেন, “মা, স্ত্রীর ধর্ম, কর্তব্য আমি জানি। আপনি আমাকে সাধারণ নারীর মতো মনে করবেন না। আপনি আপনার পুত্রের মঙ্গল বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। বিবাহের সময়ই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, স্বামীর কল্যাণের জন্য প্রয়োজনে প্রাণও বিসর্জন দেব। আজ আপনার কথায় আমার এই শুভচেতনা আরো গভীর হল।” কৌশল্যা সীতাকে কাছে টেনে নিলেন—“সীতা, আমি ধন্য। আমার ঘরে তোমার মতো গুণজ্ঞ, কৃতজ্ঞচিত্ত, ধর্মজ্ঞ, যশস্বিনী মেয়েকে বধূরূপে পেয়েছি।” আসন্ন বিচ্ছেদকালে কৌশল্যার মনে নানা রকম ভয়ভাবনার আলোড়ন চলতে থাকে। রামকে কাছে ডেকে কৌশল্যা বললেন, “রঘুনন্দন, বনবাসকালে তুমি সীতা আর লক্ষ্মণের কাছে কাছে থাকবে সবসময়। বড় বড় গাছপালায় ঢাকা গভীর বনজঙ্গলে এদের সঙ্গে নিয়ে খুব সাবধানে চলাচল করবে।” “মা, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন এ বিষয়ে। লক্ষ্মণ আমার ডান হাত আর সীতা হল আমার জীবনে জ্ঞানী মানুষের কীর্তির মতো অবিচ্ছেদ্য। এদের ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। আপনি দুঃখ পাবেন না মা, পিতার আশীর্বাদে চোদ্দ বছরের বনবাস এক দিনের মতো করে কেটে যাবে অনায়াসে। আপনার অশেষ পুণ্যের জোরে নিশ্চয়ই আমরা সুস্থ দেহে আবার ফিরে আসব অযোধ্যায়।”
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ২৭: পিতৃসত্য রক্ষা, নাকি পিতার অনুনয়ে রাজ্যভার গ্রহণ?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৪৬: ভৃগুবংশে জন্ম নিলেন পরশুরাম— চরুবদলের ভুলে ক্ষত্রতেজ পেলেন তিনি

দশরথ জলভরা চোখে এবার সুমন্ত্রকে আদেশ দিলেন ভালো জাতের ঘোড়ায় টানা রথে রাম, লক্ষ্মণ, সীতাকে জনপদের বাইরে কোনও মুনিজনসেবিত বনভূমিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুমন্ত্র নিয়ে এলেন রাজরথ, মণিমাণিক্যে সাজানো সেই রথে যুক্ত করা হয়েছে উৎকৃষ্ট শ্রেণির ঘোড়া।

বিদায়বেলায় রাম করজোড়ে পিতাকে বললেন, “আমার বৃদ্ধা মা কৌশল্যা অত্যন্ত উদারচেতা। তিনি কখনও আপনাকে অসম্মান করেননি, দুঃখ দেননি। আমি চলে গেলে আমার বিচ্ছেদব্যথায় তিনি যেন যমালয়ে চলে না যান। আপনি আমার এই চিরদুঃখিনী মাকে যত্নে রাখবেন।”

এরপর রাম তাঁর তিনশ পঞ্চাশ বিমাতার কাছে গেলেন। করজোড়ে সবিনয়ে তাঁদের বললেন, “একসঙ্গে থাকার সময় যদি অজান্তেই কোনও অপরাধ কারও সঙ্গে করে থাকি, তবে আপনারা ক্ষমা করবেন।” এ মহাকাব্যের সূচনা ক্রৌঞ্চবিচ্ছেদের শোকে, রামের কথা শুনে রাজপত্নীদের সমবেত করুণ কান্নায় সেই বিরহব্যথাই যেন আবার উছলে উঠল। যে রাজপ্রাসাদ বাঁশি,মুরজের মধুর ধ্বনিতে আনন্দমুখরিত হয়ে থাকত সব সময়, আজ সেখানে আসন্ন বিচ্ছেদের করুণ কান্না আর শোককাতর করুণ রব ছাড়া আর কিছুই ধ্বনিত হল না। কবি মনে করিয়ে দিলেন পাঠককে, ধরিয়ে দিলেন রামায়ণের মূল সুরটিকে—‘ক্রৌঞ্চীনামিব সংক্রন্দ এবং ব্রুবতি রাঘবে’।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৪: কবির দরজা সাধারণজনের জন্য সারাক্ষণই খোলা থাকত

শীতের সময় কেন বিট-গাজর রস খাবেন? দুই সব্জিতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ছাড়া আর কী গুণ রয়েছে জানেন?

প্রণামের পালা সেরে রাজপ্রাসাদ থেকে একে একে বেরিয়ে এলেন রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। রেখে এলেন শোকদীর্ণ পিতা, বিচ্ছেদকাতর মায়েদের। সামনে সুসজ্জিত রথ। রথের সামনে বিনীতভঙ্গিতে অপেক্ষারত সুযোগ্য সারথি সুমন্ত্র, যেন ইন্দ্রের সারথি মাতলি — “বলুন রাজকুমার, কোথায় নিয়ে যাবো আপনাদের। আজ থেকে শুরু চোদ্দ বছরের বনবাস জীবন। আপনার যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই নিয়ে যাবো এই মহারথে।” সুমন্ত্রের কথায় রথে উঠলেন তাঁরা। সঙ্গে উঠল সীতাকে দশরথের দেওয়া বসন, ভূষণ, দুই ভাইয়ের অস্ত্র-শস্ত্র, খন্তা, পেটিকা, মাটির বাসন। সুমন্ত্র মনকে শক্ত করে বেঁধে রথে উঠলেন। সবচেয়ে দুরূহ কাজের ভার যে তাঁর উপরেই ন্যস্ত। সকলের প্রিয় রাজকুমারকে তাঁর অভিষেকের শুভ লগ্নে রেখে আসতে হচ্ছে নির্বাসনে। এর চেয়ে নির্মম কাজ আর কী বা হতে পারে।
আরও পড়ুন:

সপ্তাহান্তে শরীরচর্চা? ভাবছেন এতে আদৌ লাভ হবে কি না?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-১৬: সংসার সুখের হয় ‘চাঁপাডাঙার বৌ’-র গুণে

চারপাশে জনতার ভিড়। তারই মধ্যে সুমন্ত্র করুণ কঠিন মুখে রথ চালনা শুরু করেন। দিকে দিকে আর্ত নরনারীর কান্নার রোল ওঠে-‘হায় রাম!’। গ্রীষ্মের দুপুরে তপ্ত ক্লান্ত লোক যেমন জলের দিকে ছুটে যায়, অযোধ্যার বালক, বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ শোকে কাতর হয়ে ছুটতে থাকে রথের পিছু পিছু। দু’হাত তুলে রথ থামাতে চায় তারা —“ওগো সারথি, ধীরে ধীরে চালাও তোমার রথ, আমাদের প্রিয় রাজকুমারের মুখখানি ভালো করে দেখতে দাও। সে যে আমাদের বড় প্রিয়। আবার কবে দেখতে পাবো তাকে জানিনা”। “রাঘব, এভাবে আমাদের ছেড়ে তুমি কোথায় চলে যাচ্ছো?— কান্নায় ভেঙে পড়ে তারা। রথ চলে, জনতাও চলে। খিদে, তেষ্টা, পথের ক্লান্তি— কিছুই থামাতে পারে না তাদের।
আরও পড়ুন:

বাইরে দূরে: পাহাড়ের উপর ছবির মতো সুন্দর শ্রবণবেলাগোলা— চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক অজানা অধ্যায়

খাই খাই: চিতল মাছের তো খেয়েছেন, এবার চিংড়ির মুইঠ্যার স্বাদ নিন, রইল সহজ রেসিপি

প্রজাদের কান্না আর রাজার হাহাকার আজ মিলেমিশে এক। রাজা রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এসেছেন অশক্ত পায়ে। শ্রীহীন, দীন, ধ্বস্ত তাঁর চেহারা। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন রাজপত্নীরা। অনভ্যস্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন তাঁরাও রথের পিছনে। উচ্চস্বরে ডাকছেন, “হে পুত্র, রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, একবার ফিরে চাও।” “সুমন্ত্র,রথ থামাও”- সমবেত বিলাপ আর কান্নার ধ্বনি অবশ করে দিচ্ছে রথে আসীন বনযাত্রীদের মন। এ বড় কঠিন মুহূর্ত। একটানে নির্মমভাবে ছিন্ন করতে হবে এ সংযোগটুকু। ‘সুমন্ত্র, আরও দ্রুত চালাও তোমার রথ। পিতার সঙ্গে দেখা হলে বলবে তাঁর আদেশ তুমি শুনতে পাওনি।”রাম বলতে বাধ্য হলেন।

সুমন্ত্র বেদনায় ভরা দৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন রামের দিকে। সে মুখও ব্যথার দুঃসহ ভারে যেন পাথর। মুখ ফিরিয়ে রথের গতি বাড়িয়ে দিলেন সুমন্ত্র। দৃষ্টিপথের বাইরে ক্রমশ রথ চলে যাচ্ছে—রাজার দৃষ্টি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে, হতশ্রী রাজপুরীতে অন্তঃপুরিকাদের আর্ত বিলাপ শুনতে শুনতে তিনি তলিয়ে গেলেন সংজ্ঞাহীনতার গাঢ় অন্ধকারে।—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content