শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


মিথিলা নগরী ছেড়ে এবার ফেরার পালা অযোধ্যায়। বিবাহ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হল। ভাঙল মিলনমেলা। এই বিবাহ মাঙ্গলিকীর মূল হোতা বিশ্বামিত্র বিদায় নিলেন সকলের কাছ থেকে। জনক রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চললেন কোশলেশ্বর ইক্ষ্বাকুকুলভূষণ অযোধ্যাপতি দশরথ। মিথিলাপতি সঙ্গে দিলেন লক্ষ লক্ষ ধেনু, চতুরঙ্গ সৈন্যদল। দশ সহস্র স্বর্ণমুদ্রা, রৌপ্যমুদ্রা, অজস্র উপঢৌকন দিলেন কন্যাধন রূপে। রাজার অগ্রভাগে যাচ্ছেন বশিষ্ঠ প্রমুখ ঋষিরা। পিছনে চলছে অনুচরের দল। চার পুত্র তাঁদের পত্নী সহ চলেছেন রাজার সঙ্গে। বড় প্রসন্ন, তুষ্ট আজ রাজার মন। বড় আকস্মিক এই আয়োজন, অথচ এর মধ্য দিয়েই তাঁর চার পুত্রের গার্হস্থ্য জীবনের সূচনা হল নির্বিঘ্নে। মিথিলাধিপতি জনকের মতো মহাত্মা রাজাকে পেলেন পরমাত্মীয় রূপে। পুত্রবধূ রূপে পেলেন রূপে গুণে ভূষিতা চার রাজকন্যাকে। এ যেন জীবনের পরম প্রাপ্তি।

হঠাৎ যাত্রাপথে ভয়ার্ত স্বরে ডেকে উঠল পাখিরা। এ কোন অমঙ্গলের ইশারা? অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল রাজার বুক। আবার দেখলেন, তাঁর ডানপাশ দিয়ে ছুটে চলে গেল হরিণের দল। এ তো মঙ্গলের সূচক! প্রশ্ন করলেন ঋষি বশিষ্ঠকে। জানলেন,পাখিদের ডাক এক আসন্ন বিপদের ইঙ্গিত বহন করছে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হবে না সে বিপদ। হরিণের দল দিয়ে গিয়েছে অমঙ্গলের মেঘ সরে যাওয়ার বার্তা। একই সঙ্গে মঙ্গল-অমঙ্গলের আলো-অন্ধকার দেখতে পেলেন রাজা। তাঁদের কথোপকথন শেষ হল না। তার আগেই প্রবল বাতাসের ধাক্কায় যেন কেঁপে উঠল ধরণীতল। চারিদিকে ঘনিয়ে এল অকাল অন্ধকার। সূর্যের কিরণ ঢাকা পড়ে গেল ধূলোর ঝড়ে। তার ঝাপটে জ্ঞান হারালেন দশরথের বিপুল সৈন্যবাহিনী, অনুচর, পরিজন।
দশরথ সামনে হঠাৎ দেখলেন, জটাধারী,পর্বতের মতো বিশালকায়, ভয়ঙ্কর এক পুরুষ। জ্বলন্ত অগ্নির মতো তেজ তাঁর। কাঁধে তাঁর কুঠার, প্রকাণ্ড এক ধনুতে একটি তীর সংযোজন করে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন রুদ্ররোষে। তিনি ক্ষত্রিয়ের সাক্ষাৎ কালান্তক যম, ভৃগুপুত্র পরশুরাম। ক্রোধ, অসহিষ্ণুতার প্রকট প্রকাশ তাঁর মুখমণ্ডলে। তাঁকে চিনতে পারলেন বশিষ্ঠ ও অন্যান্য ঋষিরা। মনে তাঁদের শঙ্কা ঘনালো, পিতার বধের প্রতিশোধ বাসনায় পৃথিবীতে বারবার ক্ষত্রিয়নাশ করেছেন পরশুরাম। আজও এমন কাজ করবেন না তো তিনি? তাঁকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করলেন শান্তিকামী ঋষিরা।

ঋষিদের পূজার্ঘ্য গ্রহণ করলেন পরশুরাম। কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না তাঁদের। তাঁর বক্তব্য সরাসরি রামের সঙ্গে। রামকে বললেন, ”তোমার বীরত্ব আর দিব্যধনু ভঙ্গের কথা শুনেই আমি এসেছি। কিন্তু আমার এই মহাধনু তার থেকেও ভয়ংকর। এ হল বৈষ্ণব ধনু। এই ধনুর দ্বারা আমি পৃথিবী জয় করেছি। এবার তুমি এতে শর সন্ধান করে তোমার প্রকৃত সামর্থ্য দেখাও। যদি তুমি এ কাজে সফল হও, তাহলে আমি তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করব।”

এ কথা শুনে বুক কেঁপে উঠল রাজা দশরথের। বহুদিন পর প্রসন্ন মনে ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ফিরছেন, পথে আবার এমন বিপদ! প্রাণপ্রিয় রামের প্রাণসংশয়ই যেন উপস্থিত। দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়লেন রাজা। বিষণ্ণ মনে পরশুরামকে বললেন, “আপনি ইন্দ্রের কাছে প্রতিজ্ঞা করে অস্ত্র ত্যাগ করে এখন ধর্মসাধনায় মন দিয়েছেন। কশ্যপকে বসুন্ধরা দান করেছেন। এখন আপনি শমগুণী, সংযতমনা ব্রাহ্মণ। ভৃগুশ্রেষ্ঠ আপনি! আপনার কি আর এমন ক্রোধের প্রকাশ সাজে? আর রাম আমার বালকপুত্র। তার এমন ক্ষতি আপনি করবেনই বা কেন? আপনি তাকে অভয় দিন। রামের বিনাশ হলে আমরাও কেউ বাঁচবো না।”
আরও পড়ুন:

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৪: অবশেষে দময়ন্তী ফিরে গেলেন পিতৃগৃহে…

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৩০: ডাঙার প্রাণীরা পর নির্ভরশীল হলেও সামুদ্রিক প্রাণীরা কিন্তু স্বনির্ভর

ত্বকের পরিচর্যায়: টানটান ত্বক চাই? বয়স ধরে রাখতে মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

পর্দার আড়ালে, পর্ব-১৫: ‘সাগর সঙ্গমে’ ছবিতে ভারতী দেবী দাক্ষায়নীর চরিত্র করলে ছবি করতে দেবো না: প্রেমেন্দ্র মিত্র

কিন্তু পরশুরাম দশরথের কথাতেও বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। পিতার কাতর প্রার্থনাকে উপেক্ষা করেই রামকে আবার আহ্বান করলেন ধনুর্ভঙ্গে। সেই সঙ্গে বললেন দুই মহাধনুর ইতিবৃত্ত। বিশ্বকর্মা সৃষ্টি করেছিলেন দুটি ত্রিভুবন বিখ্যাত ধনু। অল্পশক্তি কোনও ব্যক্তির সে ধনুর্বাণ তোলার শক্তি নেই। তার মধ্যে একটি হরধনু। দেবতারা ত্রিপুরাসুর বধের সময় মহেশ্বর শিবকে এই ধনু দিয়েছিলেন। আর অপর ধনুটি দেবতারা দিয়েছিলেন বিষ্ণুকে। দুই ধনুর সামর্থ্য নিয়ে বিষ্ণু আর শিবের মধ্যে তৈরি হয়েছিল বিরোধ। সে বিরোধ বাড়তে বাড়তে মহাযুদ্ধের রূপ নিল। সে যুদ্ধে বিষ্ণুর প্রবল হুংকারে শৈবধনুটি শিথিল হয়ে গেল।

দেবতাদের প্রার্থনায় মহাদেবের কোনো ক্ষতি করলেন না বিষ্ণু। দেবলোকে বিষ্ণুর জয় প্রতিষ্ঠিত হল। ত্রিলোকে ছড়িয়ে পড়ল বিষ্ণুধনুর অপরাজেয়ত্বের বার্তা। রুদ্রদেব সেই ধনু গচ্ছিত রাখলেন বিদেহরাজ দেবরাতের কাছে। বংশপরম্পরায় সেটির অধিকারী হয়েছিলেন মিথিলাধিপতি জনক। আর বিষ্ণু নিজের দৃঢ়তর ধনুটি ন্যাস রূপে রাখলেন ভৃগুবংশীয় ঋষি ঋচীকের কাছে। ঋচীক ছিলেন শান্তমনা অহিংসক মহাতেজস্বী তপস্বী। তিনি তাঁর পুত্র জমদগ্নিকে দিয়ে গেলেন এই দিব্য ধনু। কিন্তু মহর্ষি জমদগ্নি শস্ত্র ত্যাগ করে বৈরাগ্য ধারণ করার পর তাঁকে নীচ প্রবৃত্তির বশবর্ত্তী হয়ে হত্যা করেন কার্তবীর্যার্জুন।
পিতৃহত্যার শোক আগুনে পরিণত হয়েছিল পরশুরামের মনে। সে কথা কথাচ্ছলে জানালেন রামকে, “পিতার এই অন্যায় হত্যা আমার মনে ক্ষত্রিয়বিদ্বেষের জন্ম দেয়। এক প্রবল প্রতিশোধস্পৃহায় এই ধনুর দ্বারাই আমি একুশ বার পৃথিবীতে ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস করেছি। এই ধনুর বলেই সমগ্র পৃথিবীকে জয় করে যজ্ঞদক্ষিণা রূপে আমি সসাগরা পৃথিবী দান করেছি মহাত্মা কশ্যপকে। তারপর তপস্যার জন্য চলে গিয়েছি পৃথিবী ছেড়ে মেরুপর্বতে। হঠাৎ বার্তা পেলাম, তুমি হরধনু ভঙ্গ করেছ। তুমি যদি প্রকৃত ক্ষত্রিয় হও, তাহলে সেই সামর্থ্যবলে এই বৈষ্ণব ধনু গ্রহণ করো।”
আরও পড়ুন:

তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে, কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে…

মুড়ি মুড়কির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া কতটা ক্ষতিকর? জানুন চিকিৎসকের মতামত

হোমিওপ্যাথি: শ্বেতি ঠিক কেন হয়? এই রোগ কি পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব?

ডাবের জলের উপকারিতা কী জানেন? গরমে শরীর ঠিক রাখতে ডাবের জল খান

রাম দীর্ঘক্ষণ শুনলেন পরশুরামের বক্তব্য। এবার নম্রভঙ্গীতে, সংযত বাক্যে বললেন, “আপনি যা কিছু নৃশংস কাজ করেছেন পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, সেসব আমি আগেই শুনেছি। আপনার কীর্তির কথাও আমার অজানা নয়। কিন্তু আপনি হীনবল ক্ষত্রিয়বংশ সব নির্মূল করেছেন। এ ধরনের নৃশংস কাজে তাই গৌরব অনুভব করবেন না। আপনি বৈষ্ণব ধনু নিয়ে আসুন আর প্রকৃত ক্ষত্রিয় বীরের শক্তিকে প্রত্যক্ষ করুন।” রামের ওষ্ঠকোণে জেগে উঠল স্মিত হাসির রেখা, মুখের রেখায় বলিষ্ঠ আত্মবিশ্বাস।

পরশুরাম দাশরথি রামের হাতে তুলে দিলেন বৈষ্ণব ধনু আর শর। ধনুকে শর সন্ধান করে রাম বললেন, “বিশ্বামিত্রের সঙ্গে আপনার সম্বন্ধ রয়েছে। সে কারণে আপনিও আমার পূজনীয়। আমি আপনার প্রাণ বিনাশে সমর্থ হলেও তা করব না। কিন্তু এই নিক্ষিপ্ত শরের তেজকে আমি ব্যর্থও হতে দেব না। হয় এর দ্বারা আপনার তপস্যালব্ধ দিব্যগতিশক্তি নষ্ট হবে অথবা আপনার পুণ্যলোকের সাধন ধর্ম নষ্ট হবে। পরশুরাম নিরুপায় হয়ে মেনে নিলেন রামের অপ্রতিহত ক্ষাত্রতেজ। তিনি চেয়ে নিলেন দিব্যগতি। সেই মনোরথগতিতে তিনি যাবেন মহেন্দ্র পর্বত। বৈষ্ণবধনুর তীব্র শর বিনাশ করল তাঁর পুণ্যলোকের সাধন যত।

এ দৃশ্য দেখতে দেবতা, কিন্নর, গন্ধর্বরা এলেন, এলেন ব্রহ্মা। তাঁরা দেখলেন অপরাজেয় শক্তিধর বীর রামের প্রবল পরাক্রম। এ যেন মর্ত্যলোকে বিষ্ণুর অপর রূপ। এ রূপের আলোয় জগতের আঁধার ঘুচবে, অযোধ্যায় অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা তার।—চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content