মিথিলার আকাশে প্রভাত সঙ্গীতের সুর। প্রসন্নতায় ভরে আছে দশদিশি। রাজা জনক দেখা করতে এলেন বিশ্বামিত্রের সঙ্গে। ঋষিবর রাজাকে জানালেন রাম লক্ষ্মণ, দুই কোশলকুমারকে নিয়ে মিথিলাপুরীতে আসার অভিপ্রায়টি। রাজার কাছে আছে দিব্যধনু। সে ধনু দেখাতে চান তিনি দুই রাজকুমারকে। সেই শুনে জনক বলতে শুরু করলেন দিব্যধনু প্রাপ্তির ইতিবৃত্ত।
পুরাকালে দক্ষযজ্ঞে মহেশ্বর শিব কোনও যজ্ঞভাগ পেলেন না। ক্রুদ্ধ হলেন তিনি অন্যান্য দেবতাদের উপর। ক্রোধে রুদ্ররূপ ধারণ করে মহাদেব এই ধনু দিয়েই দেবতাদের অঙ্গ ছেদন করতে লাগলেন। ভয়ে আকুল দেবতারা করজোড়ে স্তব করতে শুরু করলেন। তুষ্ট হলেন আশুতোষ মহাদেব, ফিরিয়ে দিলেন তাঁদের ছিন্ন অঙ্গসমূহও। জনকের পূর্বপুরুষ রাজা নিমির পরে ষষ্ঠতম রাজা ছিলেন দেবরাত। তাঁকে এই মহাশক্তিশালী হরধনু রক্ষা করতে দিয়েছিলেন দেবতারা। সেই থেকে এই দিব্যধনু আজও মিথিলায় জনকের রাজকুলে সুরক্ষিত হয়ে আছে। এ যেন বিদেহ রাজবংশের শৌর্য ও সৌভাগ্যের প্রতীক।
এ বৃত্তান্ত শেষ করে জনক বললেন তাঁর নিজের জীবনের আর এক আশ্চর্য প্রাপ্তির কথা। একদিন যজ্ঞভূমিতে হলকর্ষণের সময় ধরিত্রীমায়ের কোল থেকে হলের রেখায় উঠে এলো এক কন্যা। তার দিব্যরূপে আলো হয়ে গেল চারিদিক। অশেষ গুণের আধার সেই কন্যারত্ন। তাঁকে পিতার স্নেহে, পরম আদরে পালন করলেন জনক। কালে কালে মিথিলাপতির আত্মজাই হয়ে উঠল সে। হলের সীতারেখা থেকে পেয়েছেন তাকে, তাই তার নাম রাখলেন সীতা। জনকের মনে হয়েছিল, হরধনু আর কন্যা সীতা দুইই তাঁর কুলগৌরবের প্রতীক। তিনি মনঃস্থির করলেন, এই অযোনিসম্ভূতা কন্যা তাঁর বীর্যশুল্কা হবে। এমন দুর্লভকন্যাকে পত্নীরূপে অনায়াসে পাবেন না কেউ। শিবধনুর শক্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে তাঁকে। দিব্যধনুতে জ্যারোপণ করতে হবে।
এবার জনকরাজা রাম লক্ষ্মণকে দেখাতে চাইলেন সেই দিব্যধনু। সেই সঙ্গে এও জানালেন তিনি, রাম যদি হরধনুতে জ্যা রোপণ করতে পারেন, তবে সীতাকে রামের বধূরূপে দান করবেন। নির্দেশ দিলেন অমাত্যদের, হরধনু নিয়ে আসার জন্য। সেই আশ্চর্য, অসামান্য ধনু সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করে আনাই এক দুঃসাধ্য কাজ। নগরীর কোলাহল থেকে কিছু দূরে বিশ্বামিত্র বাস করছেন। নগরী থেকে সেখানে এই দিব্যধনু আটচাকার এক শকটযানে কোনওরকমে বয়ে নিয়ে এলেন আটশ’ জন দীর্ঘকায়, মহাশক্তিশালী মানুষ। তার উপর লোহার এক সিন্দুকের মধ্যে সুরক্ষিত সেই শঙ্করধনু।
জনক বিশ্বামিত্রকে সবিনয়ে করজোড়ে বললেন, এই সেই দিব্যধনু, যাকে রাজারা এর আগে উত্তোলন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যক্ষ, রাক্ষস, উরগ কারও পক্ষেই এই ধনুর ব্যবহার সম্ভব নয়। মহেশ্বর শিব ছাড়া অন্যান্য দেবতা, এমনকি ইন্দ্রও এই ধনুতে শর সন্ধানে সমর্থ হননি। এমন অলৌকিক শিবধনু রাম লক্ষ্মণকে দেখাতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন রাজা। এবার এই দিব্যধনুর জ্যা আকর্ষণ করার জন্য বিশ্বামিত্র রামকে আহ্বান জানালেন।
সেই ধনুর কাছে গিয়ে লৌহপেটিকার আবরণ খুললেন রাম। এ দৃশ্য দেখার জন্য চারপাশে দাঁড়িয়ে আছেন দর্শককুল। তাঁদের সামনে রাম অবলীলায় হাত দিয়েই তুলে নিলেন মহাদেবের অতুলভার ধনুকটি। আনত করে জ্যা যুক্ত করলেন বিনা আয়াসে। তারপর লীলাভরে আকর্ষণ করলেন সেটি। মুহূর্তকাল সময় অপেক্ষার। বল প্রয়োগ করতেই হরধনুর মধ্য ভাগ খণ্ডিত হয়ে গেল বজ্রনিনাদ শব্দে। এ যেন মহাপর্বত ভেঙে পড়ার প্রচণ্ড আলোড়ন। সে শব্দে কেঁপে উঠল ধরাতল। বিশ্বামিত্র, রাজা জনক, রাম, লক্ষ্মণ ছাড়া সে স্থানের অন্যান্য সকলে সে শব্দে মূর্চ্ছা গেলেন।
ধীরে ধীরে প্রকৃতিস্থ হলেন দর্শককুল। বিস্ময়ের ঘোর কাটলে সকলে উপলব্ধি করলেন, কী আশ্চর্য ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তাঁরা! জনক দেখলেন ভাবী কোশলাধিপতির পরাক্রম। দেখে আশ্বস্ত হলেন। মনে মনে জানলেন, আদরণীয়া কন্যার উপযুক্ত পাত্র তিনি পেয়ে গিয়েছেন। এবার পিতার অন্তর স্বস্তি পেল।
বিশ্বামিত্রকে বললেন জনক, “দশরথপুত্র রামের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা আমি আগেই শুনেছি। আজ তা চাক্ষুষ করে খুবই আনন্দ পেলাম। আমার কন্যা সীতা রামকে পতি রূপে পেয়ে জনককুলকে কীর্তিমণ্ডিত করবে। আপনি অনুমতি দিলে দূতেরা দ্রুতগামী ঘোড়ায় চড়ে যাবে অযোধ্যায়। দশরথ ও অন্যান্য সকলকে নিয়ে আসবে শুভ পরিণয় উপলখে।”
সম্মতি দিলেন বিশ্বামিত্র। যে বালক বীরকে নিয়ে এসেছিলেন একদা তিনি পিতৃহৃদয়ের আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে, বহু অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ হয়েছে জীবন তার। সেদিনের কোমলপ্রাণ বালক আজ তেজোদীপ্ত তরুণপ্রাণ। তার গার্হস্থ্যজীবনে প্রবেশের সময় উপস্থিত। এখন আবার পিতার সান্নিধ্যে ফিরিয়ে দিতে হবে সুযোগ্য পুত্রকে।
এও তিনি জানেন, যে, মিথিলাধিপতির কন্যা অযোনিজা সীতা যেন তপস্যার, ধৈর্যের, স্থিতির মূর্ত বিগ্রহখানি। কোশলরাজকুমার রাম শক্তি আর তেজস্বিতার মূর্তি। এঁদের বিবাহ যেন তপস্যা আর তেজের সম্মিলিত রূপের পূর্ণ প্রকাশ।
বিশ্বামিত্র জানেন, মিথিলা আর অযোধ্যা— ভারতভূমির দুই ক্ষাত্রশক্তির আধার। এদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনে, মেল বন্ধনে, পূর্ণ শক্তির প্রকাশ হবে- ঋষির হৃদয় আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে তিনি তা দেখতে পাচ্ছেন।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।