যে হিমালয়নন্দিনী গঙ্গা ভারতবর্ষের হৃদয় প্লাবিত করে বয়ে চলেছেন সাগর মোহনায়, তিনি ভাগীরথীও। কিন্তু কীভাবে? সে আখ্যান রয়েছে রামায়ণে, মহাভারতে, মৎস্য, ব্রহ্মাণ্ড প্রভৃতি পুরাণে। গ্রন্থভেদে আখ্যানের রূপভেদও ঘটেছে অল্পবিস্তর। রামায়ণের আদিকাণ্ডে বিশ্বামিত্র মুনির কাছে এ আখ্যান শুনছেন রাম, লক্ষ্মণ আর মিথিলাগামী সহযাত্রী মুনি-ঋষিরা।
ভগীরথ, সগর রাজার উত্তরপুরুষ। তাঁর পূর্বে পিতা-পিতামহ অযোধ্যার সিংহাসন আলো করে রাজত্ব করেছেন। রাজা সগরের পরে পৌত্র অংশুমান, তারপর তাঁর পুত্র দিলীপ। কিন্তু যে ষাট হাজার অভিশপ্ত সগরপুত্ররা কপিল মুনির রোষে ভস্ম হয়ে রইলেন, তাদের মুক্তির উপায় আর সফল হল না। অংশুমান জেনেছিলেন গরুড়ের কাছ থেকে যে, সুরনদী পুণ্যতোয়া গঙ্গার পবিত্র জলের স্পর্শে হবে তাদের মুক্তি, হবে স্বর্গলাভ। কিন্তু হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা সে নদী স্বর্গবাহিনী, তাঁকে মর্ত্যজগতে আনবেন কে? আর তিনি আসবেন নেমে এই ধূলোমাটির ধরণীতলে, সে বড় সহজ কথা নয়। কীভাবে হবে এই অসাধ্য সাধন? সে কথা ভেবে কোনও উপায় বের করতে পারেননি রাজা সগর। কেটে গিয়েছে তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকাল। শেষে কালস্রোত গ্রাস করেছে তাঁর নশ্বর দেহ। সগরের মৃত্যুর পর প্রজাদের প্রিয়জন, সগরের পৌত্র, অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান হলেন রাজা। তিনি ধর্মপরায়ণ, প্রজাহিতৈষী রাজা। গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসার ভাবনা জুড়ে ছিল তাঁরও মনোরাজ্য।
পুত্র দিলীপকে রাজ্যভার দিয়ে তিনি হিমালয়শিখরে গিয়ে মগ্ন হলেন তপস্যায়। দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ সময় কেটে গেল তপঃসাধনায়। কিন্তু যার জন্য এই কৃচ্ছসাধনা, সে কাজে সাফল্য পেলেন কোথায়? বত্রিশ সহস্র বছর এই সাধনার পর স্বর্গলাভ হল তাঁর। অংশুমানের পুত্র দিলীপ মহাতেজস্বী রাজা। বহু যজ্ঞকর্মের কর্তাও তিনি। বহু বছর রাজ্যভার বহন করে তিনিও শরীর ত্যাগ করলেন। নিজের কর্মফলে তিনি পেলেন ইন্দ্রলোক। কিন্তু গঙ্গাকে মর্ত্যে এনে পিতৃপুরুষের উদ্ধারের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল ইক্ষ্বাকু রাজবংশীয়দের। পিতার অবর্তমানে এবার রাজ্যের সঙ্গে সে কর্তব্য পূরণের দায়িত্ব পেলেন দিলীপের পুত্র ভগীরথ।
ধর্মপরায়ণ, নিঃসন্তান রাজা ছিলেন ভগীরথ, অতুলনীয় তেজস্বিতা তাঁর। মনে মনে স্থির করলেন পূর্বপূরুষের অসম্পূর্ণ কর্তব্য এবার পূর্ণ করবেন। হিমালয়ের পাদদেশে গোকর্ণ নামে এক স্থান। ভগীরথ গেলেন সেখানে একা, স্ত্রীসঙ্গ ছাড়াই। যে ভাবেই হোক গঙ্গাকে ভূতলে প্রবাহিত করতেই হবে, এই তাঁর পণ। শুরু হল উগ্র তপস্যা।
প্রখর গ্রীষ্মে পঞ্চতপা, ঊর্দ্ধবাহু হয়ে কিংবা ঘনঘোর বর্ষায় অঝোর বৃষ্টিতে উন্মুক্ত আকাশের নীচে অবিচল তিনি তপস্যায়। আহার তাঁর সব ঋতুতে একই, গাছ থেকে খসে পড়া শুকনো পাতা। এ ভাবেই কঠিন তপস্যায়, কঠোর কৃচ্ছসাধনে কেটে গেল সহস্রটি বছর। লোকপিতামহ ব্রহ্মার হৃদয় ভরে উঠল অনুকম্পায়, সন্তোষে। সমস্ত দেবতাদের নিয়ে তিনি এলেন ভগীরথের আশ্রমে। কী তাঁর অভিলাষ, প্রশ্ন করলেন তাঁকে। স্বয়ং ব্রহ্মা এসেছেন তাঁর কাছে! বিস্ময়ে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন ভগীরথ। হ্যাঁ, চাইবেন তিনি ব্রহ্মার কাছে তাঁর অভিলাষের বিষয়টি। এতো শুধু তাঁর প্রার্থনা নয়। এ যে তাঁর পূর্বজদের অপূরণীয় প্রার্থনা। একে পূরণ করবেন বলেই এমন কঠিন তপশ্চর্যা তাঁর। করজোড়ে, বিনীত কণ্ঠ ভগীরথ লোকপিতামহের কাছে জানালেন তাঁর অভিলাষ, তাঁর প্রপিতামহদের মুক্তিলাভের উপায়। গঙ্গার জল প্রবাহিত হবে সেই ষাট হাজার পূর্বপুরুষের দেহভস্মের উপর দিয়ে, তবে পাপমুক্ত হবে তারা।
এভাবেই স্বর্গবাস হবে তাদের। কিন্তু তাদের দেহভস্ম রয়েছে কপিল মুনির আশ্রমে। সেই সেখানে যেতে হবে সুরধুনী গঙ্গাকে। তবে হবে তাদের মুক্তি। এই প্রার্থনার সঙ্গে ইক্ষ্বাকুবংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখার বরও চেয়ে নিলেন ব্রহ্মার কাছ থেকে অপত্যহীন রাজা ভগীরথ। এ প্রার্থনা শুনে খুশি হয়ে বর দিলেন ব্রহ্মা— “মহাভাগ, মহারথ, ভগীরথ, তোমার প্রার্থনা অনুসারে ইক্ষ্বাকু বংশ অবিচ্ছিন্ন, অক্ষয় হোক”। কিন্তু গঙ্গা কি তাঁর বরে মর্ত্যভূমিতে নেমে আসবেন ভগীরথের মনোবাসনা চরিতার্থ করে? গঙ্গাকে ভূতলে অবতরণের অনুরোধ করেও ব্রহ্মা সতর্ক করলেন ভগীরথকে। প্রবল বেগবতী গঙ্গা স্বর্লোক থেকে বিচ্যুত হয়ে যদি একেবারে মর্ত্যে নেমে আসেন, তবে তাঁকে ধারণ করতে পারবেন না ধরিত্রী। প্রবল জলস্রোতে বিদীর্ণ হয়ে যাবে ভূমি। সৃষ্টি হবে বিনষ্ট। তাহলে উপায়? উপায় একমাত্র মহেশ্বর শিবকে তুষ্ট করা। ত্রিলোকে তিনিই পারবেন গঙ্গার এই তীব্র জলস্রোতকে ধারণ করতে। ব্রহ্মা এই বলে বিদায় নিলেন ভগীরথের আশ্রম থেকে।
শুরু হল ভগীরথের সাধনার দ্বিতীয় পর্ব। দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করার সাধনা পর্ব। পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে এক বছর স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। হাত তাঁর উপরের দিকে তোলা, মাথার উপরে নেই কোনো আচ্ছাদন। জলে, শীতে, গ্রীষ্মের তপ্ত তাপে অবিচলচিত্ত তিনি। এমন কঠিন তপস্যায় মহাদেব তুষ্ট না হয়ে পারলেন না। কথা দিলেন ভগীরথকে, — ত্রিপথগামিনী গঙ্গা যখন দেবলোক থেকে নরলোকে নামবেন, তখনই তিনি নিজের জটাজালে ধারণ করবেন তাঁকে।
ভগীরথের এত বছরের কঠোর সাধনা সফল হল এবার। গঙ্গা নামবেন মর্ত্যলোকে, তাঁর পবিত্রস্পর্শ করবে সকল কলুষ নাশন। মহেশ্বর এবার সে আয়োজন পূরণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। হিমালয়ের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে বহু যোজন বিস্তৃত গুহার মতো বিপুল জটাজাল ছড়িয়ে দিলেন। আকাশগামিনী গঙ্গা মহাবেগে নেমে এলেন স্বর্গলোক থেকে, মর্ত্যলোকে পতিত হওয়ার আগেই তিনি ধরা দিলেন সেই জটাজালের কুটিল আবর্তে। মহেশ্বর হয়ে উঠলেন গঙ্গাধর। বছর ঘুরে গেল। সে জটার জটিল ঘূর্ণাবর্তে ভ্রমণ করেও বের হওয়ার পথ খুঁজে পেলেন না গঙ্গা। নিরুপায় ভগীরথ আবার বসলেন মহাদেবের তপস্যায়। প্রসন্ন মহাদেব তাঁর একটি জটাজাল খুলে মুক্তি দিলেন গঙ্গার স্রোতোধারাকে। জটামুক্ত গঙ্গাধারা এবার তরঙ্গবিভঙ্গে এগিয়ে চললেন ভগীরথের অনুগমন করে।
ভগীরথ, সগর রাজার উত্তরপুরুষ। তাঁর পূর্বে পিতা-পিতামহ অযোধ্যার সিংহাসন আলো করে রাজত্ব করেছেন। রাজা সগরের পরে পৌত্র অংশুমান, তারপর তাঁর পুত্র দিলীপ। কিন্তু যে ষাট হাজার অভিশপ্ত সগরপুত্ররা কপিল মুনির রোষে ভস্ম হয়ে রইলেন, তাদের মুক্তির উপায় আর সফল হল না। অংশুমান জেনেছিলেন গরুড়ের কাছ থেকে যে, সুরনদী পুণ্যতোয়া গঙ্গার পবিত্র জলের স্পর্শে হবে তাদের মুক্তি, হবে স্বর্গলাভ। কিন্তু হিমালয়ের জ্যেষ্ঠা কন্যা সে নদী স্বর্গবাহিনী, তাঁকে মর্ত্যজগতে আনবেন কে? আর তিনি আসবেন নেমে এই ধূলোমাটির ধরণীতলে, সে বড় সহজ কথা নয়। কীভাবে হবে এই অসাধ্য সাধন? সে কথা ভেবে কোনও উপায় বের করতে পারেননি রাজা সগর। কেটে গিয়েছে তাঁর দীর্ঘ রাজত্বকাল। শেষে কালস্রোত গ্রাস করেছে তাঁর নশ্বর দেহ। সগরের মৃত্যুর পর প্রজাদের প্রিয়জন, সগরের পৌত্র, অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান হলেন রাজা। তিনি ধর্মপরায়ণ, প্রজাহিতৈষী রাজা। গঙ্গাকে মর্ত্যে নিয়ে আসার ভাবনা জুড়ে ছিল তাঁরও মনোরাজ্য।
পুত্র দিলীপকে রাজ্যভার দিয়ে তিনি হিমালয়শিখরে গিয়ে মগ্ন হলেন তপস্যায়। দীর্ঘ, অতিদীর্ঘ সময় কেটে গেল তপঃসাধনায়। কিন্তু যার জন্য এই কৃচ্ছসাধনা, সে কাজে সাফল্য পেলেন কোথায়? বত্রিশ সহস্র বছর এই সাধনার পর স্বর্গলাভ হল তাঁর। অংশুমানের পুত্র দিলীপ মহাতেজস্বী রাজা। বহু যজ্ঞকর্মের কর্তাও তিনি। বহু বছর রাজ্যভার বহন করে তিনিও শরীর ত্যাগ করলেন। নিজের কর্মফলে তিনি পেলেন ইন্দ্রলোক। কিন্তু গঙ্গাকে মর্ত্যে এনে পিতৃপুরুষের উদ্ধারের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল ইক্ষ্বাকু রাজবংশীয়দের। পিতার অবর্তমানে এবার রাজ্যের সঙ্গে সে কর্তব্য পূরণের দায়িত্ব পেলেন দিলীপের পুত্র ভগীরথ।
ধর্মপরায়ণ, নিঃসন্তান রাজা ছিলেন ভগীরথ, অতুলনীয় তেজস্বিতা তাঁর। মনে মনে স্থির করলেন পূর্বপূরুষের অসম্পূর্ণ কর্তব্য এবার পূর্ণ করবেন। হিমালয়ের পাদদেশে গোকর্ণ নামে এক স্থান। ভগীরথ গেলেন সেখানে একা, স্ত্রীসঙ্গ ছাড়াই। যে ভাবেই হোক গঙ্গাকে ভূতলে প্রবাহিত করতেই হবে, এই তাঁর পণ। শুরু হল উগ্র তপস্যা।
প্রখর গ্রীষ্মে পঞ্চতপা, ঊর্দ্ধবাহু হয়ে কিংবা ঘনঘোর বর্ষায় অঝোর বৃষ্টিতে উন্মুক্ত আকাশের নীচে অবিচল তিনি তপস্যায়। আহার তাঁর সব ঋতুতে একই, গাছ থেকে খসে পড়া শুকনো পাতা। এ ভাবেই কঠিন তপস্যায়, কঠোর কৃচ্ছসাধনে কেটে গেল সহস্রটি বছর। লোকপিতামহ ব্রহ্মার হৃদয় ভরে উঠল অনুকম্পায়, সন্তোষে। সমস্ত দেবতাদের নিয়ে তিনি এলেন ভগীরথের আশ্রমে। কী তাঁর অভিলাষ, প্রশ্ন করলেন তাঁকে। স্বয়ং ব্রহ্মা এসেছেন তাঁর কাছে! বিস্ময়ে আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন ভগীরথ। হ্যাঁ, চাইবেন তিনি ব্রহ্মার কাছে তাঁর অভিলাষের বিষয়টি। এতো শুধু তাঁর প্রার্থনা নয়। এ যে তাঁর পূর্বজদের অপূরণীয় প্রার্থনা। একে পূরণ করবেন বলেই এমন কঠিন তপশ্চর্যা তাঁর। করজোড়ে, বিনীত কণ্ঠ ভগীরথ লোকপিতামহের কাছে জানালেন তাঁর অভিলাষ, তাঁর প্রপিতামহদের মুক্তিলাভের উপায়। গঙ্গার জল প্রবাহিত হবে সেই ষাট হাজার পূর্বপুরুষের দেহভস্মের উপর দিয়ে, তবে পাপমুক্ত হবে তারা।
এভাবেই স্বর্গবাস হবে তাদের। কিন্তু তাদের দেহভস্ম রয়েছে কপিল মুনির আশ্রমে। সেই সেখানে যেতে হবে সুরধুনী গঙ্গাকে। তবে হবে তাদের মুক্তি। এই প্রার্থনার সঙ্গে ইক্ষ্বাকুবংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখার বরও চেয়ে নিলেন ব্রহ্মার কাছ থেকে অপত্যহীন রাজা ভগীরথ। এ প্রার্থনা শুনে খুশি হয়ে বর দিলেন ব্রহ্মা— “মহাভাগ, মহারথ, ভগীরথ, তোমার প্রার্থনা অনুসারে ইক্ষ্বাকু বংশ অবিচ্ছিন্ন, অক্ষয় হোক”। কিন্তু গঙ্গা কি তাঁর বরে মর্ত্যভূমিতে নেমে আসবেন ভগীরথের মনোবাসনা চরিতার্থ করে? গঙ্গাকে ভূতলে অবতরণের অনুরোধ করেও ব্রহ্মা সতর্ক করলেন ভগীরথকে। প্রবল বেগবতী গঙ্গা স্বর্লোক থেকে বিচ্যুত হয়ে যদি একেবারে মর্ত্যে নেমে আসেন, তবে তাঁকে ধারণ করতে পারবেন না ধরিত্রী। প্রবল জলস্রোতে বিদীর্ণ হয়ে যাবে ভূমি। সৃষ্টি হবে বিনষ্ট। তাহলে উপায়? উপায় একমাত্র মহেশ্বর শিবকে তুষ্ট করা। ত্রিলোকে তিনিই পারবেন গঙ্গার এই তীব্র জলস্রোতকে ধারণ করতে। ব্রহ্মা এই বলে বিদায় নিলেন ভগীরথের আশ্রম থেকে।
শুরু হল ভগীরথের সাধনার দ্বিতীয় পর্ব। দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করার সাধনা পর্ব। পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে এক বছর স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। হাত তাঁর উপরের দিকে তোলা, মাথার উপরে নেই কোনো আচ্ছাদন। জলে, শীতে, গ্রীষ্মের তপ্ত তাপে অবিচলচিত্ত তিনি। এমন কঠিন তপস্যায় মহাদেব তুষ্ট না হয়ে পারলেন না। কথা দিলেন ভগীরথকে, — ত্রিপথগামিনী গঙ্গা যখন দেবলোক থেকে নরলোকে নামবেন, তখনই তিনি নিজের জটাজালে ধারণ করবেন তাঁকে।
ভগীরথের এত বছরের কঠোর সাধনা সফল হল এবার। গঙ্গা নামবেন মর্ত্যলোকে, তাঁর পবিত্রস্পর্শ করবে সকল কলুষ নাশন। মহেশ্বর এবার সে আয়োজন পূরণ করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। হিমালয়ের উচ্চ শিখরে আরোহণ করে বহু যোজন বিস্তৃত গুহার মতো বিপুল জটাজাল ছড়িয়ে দিলেন। আকাশগামিনী গঙ্গা মহাবেগে নেমে এলেন স্বর্গলোক থেকে, মর্ত্যলোকে পতিত হওয়ার আগেই তিনি ধরা দিলেন সেই জটাজালের কুটিল আবর্তে। মহেশ্বর হয়ে উঠলেন গঙ্গাধর। বছর ঘুরে গেল। সে জটার জটিল ঘূর্ণাবর্তে ভ্রমণ করেও বের হওয়ার পথ খুঁজে পেলেন না গঙ্গা। নিরুপায় ভগীরথ আবার বসলেন মহাদেবের তপস্যায়। প্রসন্ন মহাদেব তাঁর একটি জটাজাল খুলে মুক্তি দিলেন গঙ্গার স্রোতোধারাকে। জটামুক্ত গঙ্গাধারা এবার তরঙ্গবিভঙ্গে এগিয়ে চললেন ভগীরথের অনুগমন করে।
দেবনদী গঙ্গার অবতরণের অপূর্ব সে দৃশ্য। ভগীরথের রথের পিছু নিয়েছে যেন আনমনা এক ছোট্ট মেয়ে। আপন খেয়ালে চলছে সে মেয়ে পথ বেয়ে; কখনও ধীরে, কখনও লাফিয়ে উঠে ঘূর্ণিপাক খেয়ে, কখনও বা এক ছুটে দ্রুতবেগে পাড়ি দিচ্ছে পথ। জগতে এমন দৃশ্য বড় দুর্লভ। এ দৃশ্য দেখতে ছুটে এলেন যত ঋষি, দেবতা, সিদ্ধ, গন্ধর্বরা। কেউ এলেন হাতির পিঠে, কেউ ঘোড়ায় চড়ে, কেউ বিশেষ বিমানে, কেউ বা এলেন শিবিকায়। লোকপিতামহ ব্রহ্মাও এলেন সেখানে, অনুগমন করলেন গঙ্গার, এ দৃশ্যের সাক্ষী রইবেন বলে। দেবতাদের উজ্জ্বল অলংকারের আভায়, দ্রুত গমনাগমনে মেঘমুক্ত আকাশে যেন শত সূর্যের বিচ্ছুরণ। গঙ্গার জলপ্রবাহে ঠাঁই নিয়েছে লীলাচঞ্চল শুশুকের দল, সরীসৃপ আর মাছের ঝাঁক। জলস্রোতের ঘূর্ণিপাকে তারা ঘুরছে, উঠছে, নামছে, যেন আকাশের গায়ে হঠাৎ ঝলসে ওঠা বিদ্যুতের চমক।
ত্রিপথগামিনী গঙ্গা নামছেন, মহাদেবের জটাপাশ থেকে মর্ত্যলোকের পথে। জগৎ জুড়ে যেন চলছে তারই আনন্দ-আয়োজন। গ্রহ, গন্ধর্বের দল, ভূতলচারী নাগ— সকলে মিলে পরিষ্কার করে দিতে লাগলেন গঙ্গার আগমনের পথটি। শিবের অঙ্গ হতে তাঁর আগমন, পবিত্র তাঁর জলধারায় স্নান করে পাপমুক্ত হলেন সেই গ্রহ-গন্ধর্বরা। দেবলোক থেকে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন তাঁদেরই কেউ কেউ। তাঁরা মুক্তি পেয়ে ফিরে গেলেন স্বর্গে। দেবর্ষি আর সিদ্ধ মহর্ষিরা মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। দেবতা আর গন্ধর্বদের সুরে গানে ভুবন ভরে উঠল। অপ্সরারা মেতে উঠলেন নৃত্যের বিভঙ্গে। রাক্ষস, দৈত্য, দানব, কিন্নর, সরীসৃপ, সকলেই তাঁর স্রোতোধারার অনুগামী। রাজর্ষি ভগীরথ চলেছেন রথে। আর শঙ্করশিরোচ্যুত গঙ্গার জলধারা প্রবল বেগে, তরঙ্গভঙ্গে যেন নৃত্যলীলাতেই মেতে উঠে চলেছেন তাঁর পিছে। সকলের মধ্যে যেন বিশ্ব জগতের আনন্দধারা বইয়ে দিয়ে মর্ত্যজগতে এলেন গঙ্গা।
অবশেষে ভগীরথের সংকল্প পূর্ণ হল। গঙ্গাকে তিনি নিয়ে এলেন সাগরের কাছে, পাতালে। সগরপুত্ররা সেই প্রকাণ্ড খাত খনন করেছিল এক সময়। সেখান থেকে পৌঁছলেন তিনি রসাতলে, যেখানে তাঁর ভস্মীভূত পূর্বপুরুষেরা রয়েছেন সুদীর্ঘকাল ধরে। গঙ্গাজলে ভগীরথ তৃপ্ত করলেন তাদের। এ জল বহু প্রতীক্ষিত, বহু সাধনার দুর্লভ ধন। উত্তরপুরুষের অক্লান্ত শ্রমে, তপস্যায় অবশেষে মুক্তির দ্বার হল উন্মোচিত। তারা দিব্যমূর্তি ধরে আনন্দিত মনে পাড়ি দিলেন স্বর্গলোকে।
হিমালয়ের এই জ্যেষ্ঠ কন্যা, নদীশ্রেষ্ঠা ভূমিতে গমনশীলা বলে পরিচিত ‘গঙ্গা’ নামে। ত্রিলোকপ্লাবিনী বলে দেবতা আর ঋষিরা দিয়েছেন এর নাম ত্রিপথগা। পিতামহ ব্রহ্মা এবার আশীর্বাদ করলেন ভগীরথকে। গঙ্গা ভগীরথকেই অনুসরণ করে এসেছেন মর্ত্যলোকে, এ যেন পিতার দেখানো পথ চিনে চিনে কন্যার পথ চলা। তাই গঙ্গা হবেন তাঁর কন্যা, তিনলোকে খ্যাতি হবে ভাগীরথী নামে। হিমালয়কন্যার এ হবে তৃতীয় নাম। যতদিন পর্যন্ত মহানদী গঙ্গা বইবেন মর্ত্যলোকে, ততদিন পর্যন্ত ভগীরথের এই অক্ষয় কীর্তি প্রচারিত হবে তিনলোকে। আশীর্বাদ করে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন ব্রহ্মা। আর সমস্ত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে গঙ্গাজলে তর্পণ করে দীর্ঘকাল পরে অযোধ্যায় ফিরলেন রাজর্ষি ভগীরথ। যিনি ছিলেন রাজা, আজ তিনিই জ্ঞানে, কর্মে, কর্তব্যচেতনায় ঋষি। তাঁকে পেয়ে প্রজাদের খুশির সীমা রইল না। —চলবে
ত্রিপথগামিনী গঙ্গা নামছেন, মহাদেবের জটাপাশ থেকে মর্ত্যলোকের পথে। জগৎ জুড়ে যেন চলছে তারই আনন্দ-আয়োজন। গ্রহ, গন্ধর্বের দল, ভূতলচারী নাগ— সকলে মিলে পরিষ্কার করে দিতে লাগলেন গঙ্গার আগমনের পথটি। শিবের অঙ্গ হতে তাঁর আগমন, পবিত্র তাঁর জলধারায় স্নান করে পাপমুক্ত হলেন সেই গ্রহ-গন্ধর্বরা। দেবলোক থেকে অভিশপ্ত জীবন কাটাতে মর্ত্যলোকে এসেছিলেন তাঁদেরই কেউ কেউ। তাঁরা মুক্তি পেয়ে ফিরে গেলেন স্বর্গে। দেবর্ষি আর সিদ্ধ মহর্ষিরা মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। দেবতা আর গন্ধর্বদের সুরে গানে ভুবন ভরে উঠল। অপ্সরারা মেতে উঠলেন নৃত্যের বিভঙ্গে। রাক্ষস, দৈত্য, দানব, কিন্নর, সরীসৃপ, সকলেই তাঁর স্রোতোধারার অনুগামী। রাজর্ষি ভগীরথ চলেছেন রথে। আর শঙ্করশিরোচ্যুত গঙ্গার জলধারা প্রবল বেগে, তরঙ্গভঙ্গে যেন নৃত্যলীলাতেই মেতে উঠে চলেছেন তাঁর পিছে। সকলের মধ্যে যেন বিশ্ব জগতের আনন্দধারা বইয়ে দিয়ে মর্ত্যজগতে এলেন গঙ্গা।
অবশেষে ভগীরথের সংকল্প পূর্ণ হল। গঙ্গাকে তিনি নিয়ে এলেন সাগরের কাছে, পাতালে। সগরপুত্ররা সেই প্রকাণ্ড খাত খনন করেছিল এক সময়। সেখান থেকে পৌঁছলেন তিনি রসাতলে, যেখানে তাঁর ভস্মীভূত পূর্বপুরুষেরা রয়েছেন সুদীর্ঘকাল ধরে। গঙ্গাজলে ভগীরথ তৃপ্ত করলেন তাদের। এ জল বহু প্রতীক্ষিত, বহু সাধনার দুর্লভ ধন। উত্তরপুরুষের অক্লান্ত শ্রমে, তপস্যায় অবশেষে মুক্তির দ্বার হল উন্মোচিত। তারা দিব্যমূর্তি ধরে আনন্দিত মনে পাড়ি দিলেন স্বর্গলোকে।
হিমালয়ের এই জ্যেষ্ঠ কন্যা, নদীশ্রেষ্ঠা ভূমিতে গমনশীলা বলে পরিচিত ‘গঙ্গা’ নামে। ত্রিলোকপ্লাবিনী বলে দেবতা আর ঋষিরা দিয়েছেন এর নাম ত্রিপথগা। পিতামহ ব্রহ্মা এবার আশীর্বাদ করলেন ভগীরথকে। গঙ্গা ভগীরথকেই অনুসরণ করে এসেছেন মর্ত্যলোকে, এ যেন পিতার দেখানো পথ চিনে চিনে কন্যার পথ চলা। তাই গঙ্গা হবেন তাঁর কন্যা, তিনলোকে খ্যাতি হবে ভাগীরথী নামে। হিমালয়কন্যার এ হবে তৃতীয় নাম। যতদিন পর্যন্ত মহানদী গঙ্গা বইবেন মর্ত্যলোকে, ততদিন পর্যন্ত ভগীরথের এই অক্ষয় কীর্তি প্রচারিত হবে তিনলোকে। আশীর্বাদ করে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন ব্রহ্মা। আর সমস্ত পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে গঙ্গাজলে তর্পণ করে দীর্ঘকাল পরে অযোধ্যায় ফিরলেন রাজর্ষি ভগীরথ। যিনি ছিলেন রাজা, আজ তিনিই জ্ঞানে, কর্মে, কর্তব্যচেতনায় ঋষি। তাঁকে পেয়ে প্রজাদের খুশির সীমা রইল না। —চলবে
*শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।