আঁধার ছায়া বনপথ। সেই পথে তাড়কাবনে প্রবেশ করলেন বিশ্বামিত্র ঋষি। পিছনে তাঁর রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই। সে বনের আড়ালে তাড়কার বাস। গায়ে তার হাজার হাতীর বল। অগস্ত্যের শাপে তার স্বামী সুন্দকে হারিয়েছে সে। প্রতিশোধস্পৃহায় তার মধ্যে জন্ম নিয়েছে মুনির প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ। তাঁকে পরাস্ত করতে গিয়ে নিজেও হয়েছে শাপগ্রস্ত। সৌন্দর্য হারিয়ে পেয়েছে বিকৃত মুখ, রাক্ষসী স্বভাব। সে ধ্বংস করেছে অগস্ত্য মুনির পূর্ব নিবাসস্থল। তার অত্যাচারে মলজ আর করূষ দুই জনপদ থেকে মুছে গিয়েছে মানুষের ইতিহাস।
তাড়কার নিষ্ঠুরতার শিকার বহু প্রাণ। দুটি বিস্তীর্ণ জনপদ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে রয়েছে। এবার থামাতে হবে তার ধ্বংসলীলাকে। বিশ্বামিত্রের অভিপ্রায় তাড়কা বধ। প্রখর তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর তাঁর কূটনৈতিক দর্শন। প্রথমে তাড়কার গল্প শোনালেন দুই ভাইকে। তারপর আচমকাই বললেন রামকে —‘গোব্রাহ্মণহিতার্থায় জহি ঘোরপরাক্রমাম্’। ‘রাম, গোব্রাহ্মণের কল্যাণ সাধনের জন্য তুমি এই নিদারুণ পরাক্রমশালী দুর্বৃত্ত যক্ষীকে বধ করো। আপনশক্তিতে উন্মত্ত, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য রাক্ষসীকে তুমি ছাড়া আর কেউ বধ করতে পারবে না।’ চলতে চলতে গল্পে কথায় কেটে যাচ্ছিল পথের ক্লান্তি। চলার পথে নতুনের সাক্ষাৎকারে দুই কিশোরের মন ছিল উৎফুল্লতায় ভরে। এমন ঋষিপ্রস্তাব পেয়ে সংশয়ে, বিস্ময়ে বিমূঢ় রাম। আর তাড়কা ক্রূরস্বভাব রাক্ষসী হলেও নারী। নারীহত্যা মোটেও শাস্ত্রে সমর্থনীয় নয়। তাড়কাকে হত্যা করলে নারীহত্যার পাপ স্পর্শ করবে তার ঘাতককে। সে পাপের দায়ভারই বা কেন নেবেন রাম? আর তাড়কা তো নিজে আক্রমণ করেনি রামকে। তাহলে বিনা প্ররোচনায় এই হত্যার আয়োজন নৈতিক কি?
বিশ্বামিত্র জানেন কিশোরমনের অতলে এ আদেশের বিরুদ্ধভাবনা জেগে উঠবেই। কিন্তু বিশ্বামিত্র এও জানেন এই কোমল কিশোরমনকেই গড়ে নিতে হবে কঠোর রাজধর্মের উপযুক্ত আধাররূপে। এই ভয়াল বন তার যোগ্য স্থান। বিশ্বামিত্র আবার বললেন, যদিও বধ্য একজন স্ত্রী, তবুও স্ত্রীবধের জন্য মনে কোনও দয়া এনো না রাম। কারণ রাজপুত্রের প্রধান কর্তব্য প্রজাকল্যাণ। সে কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তাকে সরাতে হবে। এ হল রাজধর্ম। রাজাকে প্রজারক্ষার জন্য নৃশংস বা অনৃশংস, পুণ্য বা পাপ যে কোনো রকম কাজই করতে হতে পারে। পরিস্থিতি অনুসারে ধর্ম-অধর্মের বিচার সরিয়ে প্রজাকল্যাণ রূপ রাজকর্তব্য পালনই হয়ে ওঠে ধর্ম। রাজ্য চালনা করতে হলে এই ধর্মকেই আশ্রয় করতে হবে।
কথায় কথায় তত্ত্বের সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে, এল উদাহরণ। কিশোরমনের যুক্তি, আবেগ বড় প্রবল। তত্ত্বজ্ঞানীর শাণিত যুক্তিবাণে সেসব না খণ্ডালে আসবে না নবীনপ্রাণে উদ্যম। রামকে বোঝানোর জন্য বিশ্বামিত্র আনলেন পৌরাণিক কথাপ্রসঙ্গ। বললেন অসুর বিরোচনের কন্যা দীর্ঘজিহ্বা নামক মায়াবিনী রাক্ষসীর কথা। মুখ তার প্রলয়ের আগুন যেন। সেই রাক্ষসী পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইলে ইন্দ্র তাকে বিনাশ করেছিলেন। আবার মহর্ষি ভৃগুর পত্নী, শুক্রাচার্যের মাতা ছিলেন পরাক্রমে ইন্দ্রতুল্য। তিনি ইন্দ্রলোক অধিকার করতে চাইলে ইন্দ্র তাঁকে বধ করেছিলেন।
রাজধর্মের বজ্রকঠিন শিক্ষার আঁচে কৈশোরের ভীরু কোমলতা পুড়ে যাচ্ছে। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে নয়, রাজধর্মের কঠোরকঠিন শিক্ষা এল অরণ্যানীর ঘন-আঁধার চন্দ্রাতপের নীচে, হিংস্র বন্যপ্রাণ আর রাক্ষসী মায়া বিছিয়ে রেখেছে সেখানে প্রতি পদে বিপদের আয়োজন। তাকে গ্রহণ না করে উপায় কি?
তবুও সংশয় কাটে না, সাড়া মেলে না অন্তরের। রাম হাতজোড় করে বিশ্বামিত্র ঋষিকে বললেন, আসার সময় পিতা মাতার আদেশ ছিল আপনার কথার অন্যথা না করার। এই আদেশ স্মরণে রেখে আপনার নির্দেশ পালন করব।
ধনুকে জ্যা রোপণ করলেন রাম। তীব্র টঙ্কার ধ্বনিতে দশ দিক মুখর হয়ে উঠল। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল বনের পশুরা। তাড়কাও যেন ধনুকের বজ্র নির্ঘোষে পেয়ে গেছে ভবিতব্যের বার্তা। বিকৃত মুখে, ভয়ংকর চেহারায়, প্রচণ্ড শব্দ করে সে ছুটে এল শব্দের উৎসের দিকে। তাকে দেখতে পেয়ে লক্ষ্মণকে বললেন রাম — দেখো লক্ষ্মণ, কী ভয়ংকর আকৃতি এই রাক্ষসীর! একে দেখেই ভয়ে কাঁপবে ভীরু মানুষেরা! তবে, এর আমি শুধু কান আর নাক ছেদন করে ছেড়ে দেবো। তাতে এর শক্তি কমে যাবে। স্ত্রীজাতি বলে একে হত্যা করতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না— ‘নহ্যেনামুৎসহে হন্তুং স্ত্রীস্বভাবেন রক্ষিতাম্’। বিশ্বামিত্রের শত উৎসাহেও রামের মনের গভীরে এ হত্যাকার্যের দ্বিধাগ্রস্ততা কাটেনি।
কিন্তু এ কথা বলতে বলতেই ধূলোয় ঢেকে গেল আকাশ। শুরু হল শিলাবর্ষণ। মায়াজাল বিছিয়ে ক্রুদ্ধ রাক্ষসীর প্রবল আক্রমণ ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। নেমে আসছে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার। তার আড়ালে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে নিশাচর রাক্ষসী। রাম নিক্ষেপ করলেন তীক্ষ্ণ অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাণ। সে বাণের আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল তাড়কার বিপুল শক্তিধারী শরীর। নিথর শরীর থেকে ছড়িয়ে গেল রক্তবন্যা।
দেবতারা দেখছিলেন এই বিষম যুদ্ধ। স্বস্তি পেলেন তাঁরা। সমবেতভাবে বিশ্বামিত্রকে তাঁরা সাধুবাদ জানালেন। অমিতশক্তি রামের আরও শক্তিবৃদ্ধির জন্য রইল তাঁদের দিকনির্দেশ। বিশ্বামিত্রের অধিগত দিব্য অস্ত্রশস্ত্রের যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপে তাঁরা চিহ্নিত করে গেলেন দাশরথি রামকেই। ভয়ের ছায়া সরে গিয়ে বনের মধ্যে রাত্রি এল মায়া নিয়ে, স্নেহ নিয়ে। ঋষির সঙ্গে সে রাত কাটল অরণ্যের মাঝে।
তাড়কা নিহত হল। জন্ম নিলেন নতুন দাশরথি, ইক্ষ্বাকুকুলগৌরব রাম। ক্ষাত্রতেজে বলীয়ান নতুন সত্তা তাঁর।
আবার রামচন্দ্রকে কখনও কখনও প্রশ্নের মুখেও ঠেলে দিয়েছে তাড়কাবধ প্রসঙ্গ। হানি করেছে তাঁর মর্যাদাপুরুষোত্তম সত্তাটির। একালের তেলেগু কবি রঙ্গনায়কাম্মা যেমন প্রশ্ন তোলেন তাঁর রামায়ণবিষবৃক্ষম্ উপন্যাসে। ‘তাটকী’ সেখানে বনবাসী আদিবাসী নারী। তার মৃত্যু যেন আজন্মের বনভূমি থেকে উৎখাতের গল্পটিকে সামনে এনে দাঁড় করায়। কাহিনী এগিয়ে চলে নির্মাণ থেকে বিনির্মাণের পথে।
রামায়ণ মহাকাব্য জুড়ে মানুষী আর রাক্ষসী শক্তির দ্বৈরথ, যার সূচনা তাড়কাবধের বৃত্তান্ত দিয়ে। কিন্তু মানুষের বিপরীতে এই রাক্ষসদের প্রকৃত পরিচয় কি? রামায়ণী কথা রূপকে মোড়া বলে যাঁরা চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের কাছে কীভাবে উদ্ঘাটিত প্রতীকী রাক্ষসী সত্তার প্রকৃত স্বরূপ?
কারও কারও কাছে রামায়ণে মানুষ আর রাক্ষসের দ্বন্দ্ব-বিরোধ আসলে আর্য-অনার্য দুই ভিন্নতর সভ্যতার মানুষের যুদ্ধ, বিরোধিতার ইতিহাস। রামচন্দ্রের নেতৃত্বে আর্য সভ্যতার বিস্তার আর্যেতর সভ্যতার বিরোধিতা করেই প্রসারিত হয়েছিল ভারতের দক্ষিণ ভাগে ও সিংহল দেশে। এই ভাবনায় জারিত হয়েছে বহু বিদগ্ধ জনের রামায়ণী ভাবনা। আর কৃষিমূলক আর্য সভ্যতার বিস্তারে শক্তিশালী অনার্য রাক্ষসদের সঙ্গেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি বিরোধ। তারই প্রতিফলন রামায়ণের রাক্ষস-ভাবনায়, যুদ্ধ, বিরোধিতায়।
আবার কারও কারও চেতনায় নর-রাক্ষসের দ্বৈরথ ধরা পড়েছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্মের সংঘাতের প্রতীক অর্থে।
না কি এ ভাবেও ভাবেন কেউ কেউ, রাক্ষসদের যে কল্পকাহিনী ভারতবর্ষের মনোলোকে সুদীর্ঘ ছায়াপাত করে আছে, তার বাস্তব সত্তা আদৌ কিছু নেই। ‘রাক্ষস’ শব্দটি যেন জড়িয়েই আছে ভয়ের সঙ্গে, বিভীষিকাময় কল্পনার সঙ্গে। তারা রাত্রিচর, স্বভাবে ক্রূর, আকৃতিতে ভয়ংকর, মায়াবী, কপট আচরণে পারদর্শী। নিজেরাও ধরতে পারে কত না মায়াবী রূপ, সে রূপে ভোলাতে পারে অন্যদের। এসব শব্দ আর অর্থ মিলেমিশে তৈরি হয় রহস্য আর ভয়ের আস্তরণ রাক্ষসের চারপাশে, বেড়ে ওঠে রূপকথার মায়াবী জগতের পরিসর। রামায়ণে দেখি, রাক্ষসরা যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ, বেদবেদান্তাদি শাস্ত্রে, যজ্ঞকর্মে, রাজনীতিবিদ্যায় কুশল, স্থাপত্যবিদ্যায় উন্নত। আবার ঋষিদের যজ্ঞে বিপত্তিও বাধাতে দেখি অনেক রাক্ষসকে। তার সাথে কি তাহলে জুড়ে আছে ঋষিদের প্রতি বিদ্বেষ বা প্রতিপক্ষ ভাবনা?
পৌরাণিক আখ্যান অনুসারে, বিদ্যাধর, যক্ষ, রাক্ষস,অপ্সরা, গন্ধর্ব, কিন্নর, পিশাচ— এরা সবাই দেবযোনি। এদের সবারই রয়েছে অল্প বিস্তর অলৌকিক শক্তির অধিকার। নানান পুরাণ কথায় বিচিত্র সত্তা আর পরাক্রমের কাহিনী তাদের। বিষ্ণুপুরাণ বলে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একবার খিদেয় কাতর হয়ে অন্ধকারে ক্ষুৎক্ষামদের সৃষ্টি করলেন। তারা জন্মাল সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিরূপ মন নিয়ে। তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে তারা বলল, ‘একে রক্ষা কোরো না।’ এরাই হল রাক্ষস।
‘রাক্ষস’দের উৎপত্তির এক ভিন্নতর আখ্যান রামায়ণেই রয়েছে। ভারি সুন্দর সেই আখ্যান। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি জল সৃষ্টি করলেন। তারপর তাকে রক্ষার জন্য সৃষ্টি করলেন বেশ কিছু প্রাণী। সেই প্রাণিদের মধ্যে কেউ কেউ বলল-‘আমরা জলকে রক্ষা করব।’ প্রজাপতির অভিপ্রায়ে তারাই পরিচিত হল রাক্ষস নামে। আর কেউ কেউ বলল— ‘আমরা জলের যক্ষণ (পূজা) করব। তারা খ্যাত হল যক্ষ নামে। রাক্ষস নামের আড়ালে যত ভয় লুকিয়ে আছে, সব মনে হয় এ গল্পখানি দিয়েই মুছে দেওয়া যায়।
আবার এও দেখি যে, একই সত্তা, কখনও যক্ষ, কখনও রাক্ষস। তাড়কার মধ্যেই ঋষিশাপে এই রূপান্তর ঘটে। পালটে যায় তার স্বভাব, সেই সঙ্গে তার বহিরঙ্গের রূপও। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ রাক্ষস হয়েও স্বভাবগত তারতম্যে তারা সবাই পৃথক। আসলে এ যেন স্থূল দেহের আধারে বিচিত্র সত্তার অন্তরের স্বভাবেরই রূপচিত্রণ। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির বিচিত্র রূপদর্শন সমগ্র রামায়ণ জুড়ে এভাবেই চলতে থাকে।—চলবে
তাড়কার নিষ্ঠুরতার শিকার বহু প্রাণ। দুটি বিস্তীর্ণ জনপদ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে রয়েছে। এবার থামাতে হবে তার ধ্বংসলীলাকে। বিশ্বামিত্রের অভিপ্রায় তাড়কা বধ। প্রখর তাঁর রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর তাঁর কূটনৈতিক দর্শন। প্রথমে তাড়কার গল্প শোনালেন দুই ভাইকে। তারপর আচমকাই বললেন রামকে —‘গোব্রাহ্মণহিতার্থায় জহি ঘোরপরাক্রমাম্’। ‘রাম, গোব্রাহ্মণের কল্যাণ সাধনের জন্য তুমি এই নিদারুণ পরাক্রমশালী দুর্বৃত্ত যক্ষীকে বধ করো। আপনশক্তিতে উন্মত্ত, হিতাহিতজ্ঞানশূন্য রাক্ষসীকে তুমি ছাড়া আর কেউ বধ করতে পারবে না।’ চলতে চলতে গল্পে কথায় কেটে যাচ্ছিল পথের ক্লান্তি। চলার পথে নতুনের সাক্ষাৎকারে দুই কিশোরের মন ছিল উৎফুল্লতায় ভরে। এমন ঋষিপ্রস্তাব পেয়ে সংশয়ে, বিস্ময়ে বিমূঢ় রাম। আর তাড়কা ক্রূরস্বভাব রাক্ষসী হলেও নারী। নারীহত্যা মোটেও শাস্ত্রে সমর্থনীয় নয়। তাড়কাকে হত্যা করলে নারীহত্যার পাপ স্পর্শ করবে তার ঘাতককে। সে পাপের দায়ভারই বা কেন নেবেন রাম? আর তাড়কা তো নিজে আক্রমণ করেনি রামকে। তাহলে বিনা প্ররোচনায় এই হত্যার আয়োজন নৈতিক কি?
বিশ্বামিত্র জানেন কিশোরমনের অতলে এ আদেশের বিরুদ্ধভাবনা জেগে উঠবেই। কিন্তু বিশ্বামিত্র এও জানেন এই কোমল কিশোরমনকেই গড়ে নিতে হবে কঠোর রাজধর্মের উপযুক্ত আধাররূপে। এই ভয়াল বন তার যোগ্য স্থান। বিশ্বামিত্র আবার বললেন, যদিও বধ্য একজন স্ত্রী, তবুও স্ত্রীবধের জন্য মনে কোনও দয়া এনো না রাম। কারণ রাজপুত্রের প্রধান কর্তব্য প্রজাকল্যাণ। সে কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতা থাকলে তাকে সরাতে হবে। এ হল রাজধর্ম। রাজাকে প্রজারক্ষার জন্য নৃশংস বা অনৃশংস, পুণ্য বা পাপ যে কোনো রকম কাজই করতে হতে পারে। পরিস্থিতি অনুসারে ধর্ম-অধর্মের বিচার সরিয়ে প্রজাকল্যাণ রূপ রাজকর্তব্য পালনই হয়ে ওঠে ধর্ম। রাজ্য চালনা করতে হলে এই ধর্মকেই আশ্রয় করতে হবে।
কথায় কথায় তত্ত্বের সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে, এল উদাহরণ। কিশোরমনের যুক্তি, আবেগ বড় প্রবল। তত্ত্বজ্ঞানীর শাণিত যুক্তিবাণে সেসব না খণ্ডালে আসবে না নবীনপ্রাণে উদ্যম। রামকে বোঝানোর জন্য বিশ্বামিত্র আনলেন পৌরাণিক কথাপ্রসঙ্গ। বললেন অসুর বিরোচনের কন্যা দীর্ঘজিহ্বা নামক মায়াবিনী রাক্ষসীর কথা। মুখ তার প্রলয়ের আগুন যেন। সেই রাক্ষসী পৃথিবীকে গ্রাস করতে চাইলে ইন্দ্র তাকে বিনাশ করেছিলেন। আবার মহর্ষি ভৃগুর পত্নী, শুক্রাচার্যের মাতা ছিলেন পরাক্রমে ইন্দ্রতুল্য। তিনি ইন্দ্রলোক অধিকার করতে চাইলে ইন্দ্র তাঁকে বধ করেছিলেন।
রাজধর্মের বজ্রকঠিন শিক্ষার আঁচে কৈশোরের ভীরু কোমলতা পুড়ে যাচ্ছে। অযোধ্যার রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণে নয়, রাজধর্মের কঠোরকঠিন শিক্ষা এল অরণ্যানীর ঘন-আঁধার চন্দ্রাতপের নীচে, হিংস্র বন্যপ্রাণ আর রাক্ষসী মায়া বিছিয়ে রেখেছে সেখানে প্রতি পদে বিপদের আয়োজন। তাকে গ্রহণ না করে উপায় কি?
তবুও সংশয় কাটে না, সাড়া মেলে না অন্তরের। রাম হাতজোড় করে বিশ্বামিত্র ঋষিকে বললেন, আসার সময় পিতা মাতার আদেশ ছিল আপনার কথার অন্যথা না করার। এই আদেশ স্মরণে রেখে আপনার নির্দেশ পালন করব।
ধনুকে জ্যা রোপণ করলেন রাম। তীব্র টঙ্কার ধ্বনিতে দশ দিক মুখর হয়ে উঠল। ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল বনের পশুরা। তাড়কাও যেন ধনুকের বজ্র নির্ঘোষে পেয়ে গেছে ভবিতব্যের বার্তা। বিকৃত মুখে, ভয়ংকর চেহারায়, প্রচণ্ড শব্দ করে সে ছুটে এল শব্দের উৎসের দিকে। তাকে দেখতে পেয়ে লক্ষ্মণকে বললেন রাম — দেখো লক্ষ্মণ, কী ভয়ংকর আকৃতি এই রাক্ষসীর! একে দেখেই ভয়ে কাঁপবে ভীরু মানুষেরা! তবে, এর আমি শুধু কান আর নাক ছেদন করে ছেড়ে দেবো। তাতে এর শক্তি কমে যাবে। স্ত্রীজাতি বলে একে হত্যা করতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছে না— ‘নহ্যেনামুৎসহে হন্তুং স্ত্রীস্বভাবেন রক্ষিতাম্’। বিশ্বামিত্রের শত উৎসাহেও রামের মনের গভীরে এ হত্যাকার্যের দ্বিধাগ্রস্ততা কাটেনি।
কিন্তু এ কথা বলতে বলতেই ধূলোয় ঢেকে গেল আকাশ। শুরু হল শিলাবর্ষণ। মায়াজাল বিছিয়ে ক্রুদ্ধ রাক্ষসীর প্রবল আক্রমণ ধেয়ে এল তাঁদের দিকে। নেমে আসছে সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকার। তার আড়ালে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে নিশাচর রাক্ষসী। রাম নিক্ষেপ করলেন তীক্ষ্ণ অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাণ। সে বাণের আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল তাড়কার বিপুল শক্তিধারী শরীর। নিথর শরীর থেকে ছড়িয়ে গেল রক্তবন্যা।
দেবতারা দেখছিলেন এই বিষম যুদ্ধ। স্বস্তি পেলেন তাঁরা। সমবেতভাবে বিশ্বামিত্রকে তাঁরা সাধুবাদ জানালেন। অমিতশক্তি রামের আরও শক্তিবৃদ্ধির জন্য রইল তাঁদের দিকনির্দেশ। বিশ্বামিত্রের অধিগত দিব্য অস্ত্রশস্ত্রের যোগ্য উত্তরাধিকারী রূপে তাঁরা চিহ্নিত করে গেলেন দাশরথি রামকেই। ভয়ের ছায়া সরে গিয়ে বনের মধ্যে রাত্রি এল মায়া নিয়ে, স্নেহ নিয়ে। ঋষির সঙ্গে সে রাত কাটল অরণ্যের মাঝে।
তাড়কা নিহত হল। জন্ম নিলেন নতুন দাশরথি, ইক্ষ্বাকুকুলগৌরব রাম। ক্ষাত্রতেজে বলীয়ান নতুন সত্তা তাঁর।
আবার রামচন্দ্রকে কখনও কখনও প্রশ্নের মুখেও ঠেলে দিয়েছে তাড়কাবধ প্রসঙ্গ। হানি করেছে তাঁর মর্যাদাপুরুষোত্তম সত্তাটির। একালের তেলেগু কবি রঙ্গনায়কাম্মা যেমন প্রশ্ন তোলেন তাঁর রামায়ণবিষবৃক্ষম্ উপন্যাসে। ‘তাটকী’ সেখানে বনবাসী আদিবাসী নারী। তার মৃত্যু যেন আজন্মের বনভূমি থেকে উৎখাতের গল্পটিকে সামনে এনে দাঁড় করায়। কাহিনী এগিয়ে চলে নির্মাণ থেকে বিনির্মাণের পথে।
রামায়ণ মহাকাব্য জুড়ে মানুষী আর রাক্ষসী শক্তির দ্বৈরথ, যার সূচনা তাড়কাবধের বৃত্তান্ত দিয়ে। কিন্তু মানুষের বিপরীতে এই রাক্ষসদের প্রকৃত পরিচয় কি? রামায়ণী কথা রূপকে মোড়া বলে যাঁরা চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের কাছে কীভাবে উদ্ঘাটিত প্রতীকী রাক্ষসী সত্তার প্রকৃত স্বরূপ?
কারও কারও কাছে রামায়ণে মানুষ আর রাক্ষসের দ্বন্দ্ব-বিরোধ আসলে আর্য-অনার্য দুই ভিন্নতর সভ্যতার মানুষের যুদ্ধ, বিরোধিতার ইতিহাস। রামচন্দ্রের নেতৃত্বে আর্য সভ্যতার বিস্তার আর্যেতর সভ্যতার বিরোধিতা করেই প্রসারিত হয়েছিল ভারতের দক্ষিণ ভাগে ও সিংহল দেশে। এই ভাবনায় জারিত হয়েছে বহু বিদগ্ধ জনের রামায়ণী ভাবনা। আর কৃষিমূলক আর্য সভ্যতার বিস্তারে শক্তিশালী অনার্য রাক্ষসদের সঙ্গেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি বিরোধ। তারই প্রতিফলন রামায়ণের রাক্ষস-ভাবনায়, যুদ্ধ, বিরোধিতায়।
আবার কারও কারও চেতনায় নর-রাক্ষসের দ্বৈরথ ধরা পড়েছে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্মের সংঘাতের প্রতীক অর্থে।
না কি এ ভাবেও ভাবেন কেউ কেউ, রাক্ষসদের যে কল্পকাহিনী ভারতবর্ষের মনোলোকে সুদীর্ঘ ছায়াপাত করে আছে, তার বাস্তব সত্তা আদৌ কিছু নেই। ‘রাক্ষস’ শব্দটি যেন জড়িয়েই আছে ভয়ের সঙ্গে, বিভীষিকাময় কল্পনার সঙ্গে। তারা রাত্রিচর, স্বভাবে ক্রূর, আকৃতিতে ভয়ংকর, মায়াবী, কপট আচরণে পারদর্শী। নিজেরাও ধরতে পারে কত না মায়াবী রূপ, সে রূপে ভোলাতে পারে অন্যদের। এসব শব্দ আর অর্থ মিলেমিশে তৈরি হয় রহস্য আর ভয়ের আস্তরণ রাক্ষসের চারপাশে, বেড়ে ওঠে রূপকথার মায়াবী জগতের পরিসর। রামায়ণে দেখি, রাক্ষসরা যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ, বেদবেদান্তাদি শাস্ত্রে, যজ্ঞকর্মে, রাজনীতিবিদ্যায় কুশল, স্থাপত্যবিদ্যায় উন্নত। আবার ঋষিদের যজ্ঞে বিপত্তিও বাধাতে দেখি অনেক রাক্ষসকে। তার সাথে কি তাহলে জুড়ে আছে ঋষিদের প্রতি বিদ্বেষ বা প্রতিপক্ষ ভাবনা?
পৌরাণিক আখ্যান অনুসারে, বিদ্যাধর, যক্ষ, রাক্ষস,অপ্সরা, গন্ধর্ব, কিন্নর, পিশাচ— এরা সবাই দেবযোনি। এদের সবারই রয়েছে অল্প বিস্তর অলৌকিক শক্তির অধিকার। নানান পুরাণ কথায় বিচিত্র সত্তা আর পরাক্রমের কাহিনী তাদের। বিষ্ণুপুরাণ বলে, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা একবার খিদেয় কাতর হয়ে অন্ধকারে ক্ষুৎক্ষামদের সৃষ্টি করলেন। তারা জন্মাল সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিরূপ মন নিয়ে। তাঁর দিকে ছুটে গিয়ে তারা বলল, ‘একে রক্ষা কোরো না।’ এরাই হল রাক্ষস।
‘রাক্ষস’দের উৎপত্তির এক ভিন্নতর আখ্যান রামায়ণেই রয়েছে। ভারি সুন্দর সেই আখ্যান। সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি জল সৃষ্টি করলেন। তারপর তাকে রক্ষার জন্য সৃষ্টি করলেন বেশ কিছু প্রাণী। সেই প্রাণিদের মধ্যে কেউ কেউ বলল-‘আমরা জলকে রক্ষা করব।’ প্রজাপতির অভিপ্রায়ে তারাই পরিচিত হল রাক্ষস নামে। আর কেউ কেউ বলল— ‘আমরা জলের যক্ষণ (পূজা) করব। তারা খ্যাত হল যক্ষ নামে। রাক্ষস নামের আড়ালে যত ভয় লুকিয়ে আছে, সব মনে হয় এ গল্পখানি দিয়েই মুছে দেওয়া যায়।
আবার এও দেখি যে, একই সত্তা, কখনও যক্ষ, কখনও রাক্ষস। তাড়কার মধ্যেই ঋষিশাপে এই রূপান্তর ঘটে। পালটে যায় তার স্বভাব, সেই সঙ্গে তার বহিরঙ্গের রূপও। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ রাক্ষস হয়েও স্বভাবগত তারতম্যে তারা সবাই পৃথক। আসলে এ যেন স্থূল দেহের আধারে বিচিত্র সত্তার অন্তরের স্বভাবেরই রূপচিত্রণ। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির বিচিত্র রূপদর্শন সমগ্র রামায়ণ জুড়ে এভাবেই চলতে থাকে।—চলবে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।