আধ-যোজনের বেশি পথ হেঁটে এলেন তাঁরা সরযূ নদীর দক্ষিণ তটে। থামলেন সেখানে। বিশ্বামিত্রের নির্দেশে সরযূর স্নিগ্ধ শীতল জলে আচমন করে এসে স্থির পবিত্র মনে বসলেন রাম। বিশ্বামিত্র দিলেন তাঁকে ‘বলা’ আর ‘অতিবলা’ নামে দুই বিদ্যা। বললেন তিনি, — “রাম, জ্ঞান বিজ্ঞানের আকর এই দুই বিদ্যা পিতামহ ব্রহ্মার কন্যা। আয়ু এবং বল দুইই বৃদ্ধি পায় এ দুই বিদ্যার প্রভাবে। এরা আয়ত্তে থাকলে কখনও ক্লান্তি আসবে না, জরা বা অঙ্গবিকৃতি আসবে না শরীরে। ঘুমন্ত অবস্থায় বা অজ্ঞাতসারে রাক্ষসরা কখনও তোমাকে পরাস্ত করতে পারবে না। গ্রাস করবে না কখনও খিদে-তেষ্টাও। দুর্গম পথে, গভীর অরণ্যে কিংবা দুরূহ দুর্গস্থলে এ বিদ্যার প্রভাবে নিশ্চিত হবে জয়। আর বুদ্ধিতে, শাস্ত্রজ্ঞানে, বিচারশীলতায়, সৌভাগ্যে, ঔদার্যে ত্রিভুবনে তোমার সমকক্ষ কেউ থাকবে না।” রামকে কেন দিলেন বিশ্বামিত্র নিজের আয়ত্তাধীন এমন আশ্চর্য বিদ্যার উত্তরাধিকার? যে কোনও ব্যক্তি এত শক্তিশালী বিদ্যার আধার হতে পারেন না । থাকতে হবে বিদ্যা গ্রহণ ও ধারণের সামর্থ্য, তবেই হবেন তিনি অধিকারী। ঋষিপ্রজ্ঞায় বিশ্বামিত্র জানেন, বহু গুণে বিভূষিত রামই এ বিদ্যার উপযুক্ত আধার। তাঁর মধ্যে রয়েছে স্বভাবজ দয়াদাক্ষিণ্য গুণ, রয়েছে শৌর্যবীর্যরূপ কামজগুণ। আবার সত্যসংকল্পরূপ দিব্যগুণাবলিরও আধার তিনি। দুই বিদ্যা এবার তাঁর গুণের উৎকর্ষতা আরও বাড়িয়ে তুলবে। নিজের অগোচরেই কিশোর রাম যেন রঘুপতি হয়ে ওঠার পথে পা বাড়ালেন। পিতৃস্নেহের কোমল আস্তরণ আর নয় তাঁর আশ্রয়। এবার কঠোর কঠিন সংগ্রামের পথ তাঁর অপেক্ষায়। দেহে, মনে, প্রাণে, অধ্যাত্মচেতনায় উপযুক্ত হয়ে সে পথে চলার প্রস্তুতি শুরু হল এভাবেই।
সরযূর তীরে নেমে এল রাত। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার মুছিয়ে দিল দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি। সোনার পালঙ্কে, নরম বিছানায়, চামর ব্যজনে নয়, আজ ধরিত্রীমায়ের কোলে, খোলা আকাশের নিচে, পাতার বিছানায় ঘুমালো দুই রাজার কুমার। সরযূর স্নিগ্ধ বাতাস সারারাত চামর দোলাল তাঁদের। ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিশ্বামিত্রের ডাকে। এবার যাত্রাপথ পুণ্যসলিলা গঙ্গার অভিমুখে। উৎসাহী, উৎসুক দুই কিশোর চোখে সবই নতুন ঠেকে। মনে জাগতে থাকে অজস্র জিজ্ঞাসা। চলতে চলতে গল্পে-কথায় বহুদর্শী ঋষির কাছ থেকে জেনে নিচ্ছেন তাঁরা নদী-অরণ্য-গ্রাম-নগরের ইতিকথা। গঙ্গা-হৃদি ভারতভূমির সঙ্গে ধীরে ধীরে পরিচয় হচ্ছে ভবিষ্যৎ কোশলপতির। পথের সঞ্চয়ের ঝুলিতে ক্রমাগত বাড়ছে অভিজ্ঞতার ভার। সার্বভৌম রাজাধিরাজের শুধু শাস্ত্রজ্ঞান বা বিদ্যার অধ্যয়নই যথেষ্ট নয়, চাই দেশ-দর্শন, ভূয়োদর্শন।
গঙ্গার কাছে কন্দর্প-আশ্রম। সেখানে থামলেন ঋষি। রাত্রিবাস হবে সেখানেই। কথায় কথায় জেনে নিলেন দুই ভাই এ স্থানের পুরাবৃত্ত। কন্দর্প পুরাকালে কামদেব নামে দেহ ধারণ করে সর্বত্র বিরাজ করতেন। হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিবাহের পর মহাদেব এই স্থানে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। কামদেব যোগসাধনার সময় তাঁর মনে কামচাঞ্চল্য জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। মহাদেব তা বুঝতে পেরে প্রচণ্ড ক্রোধে ভস্ম করে ফেলেন কামদেবের শরীর। সেই থেকে কন্দর্পের পরিচয় অনঙ্গরূপে। আর এই সেই কন্দর্পের আশ্রমস্থল।
কন্দর্প-আশ্রমে রাত কাটল সুখেই। পরদিন ভোর হতে আবার যাত্রা শুরু। এবার পার হতে হবে নদীপথ। নৌকায় উঠলেন তাঁরা। মাঝনদীতে শুনতে পেলেন প্রবল জলকল্লোল। বিশ্বামিত্র জানালেন, সরযূ মিশেছে সেখানে গঙ্গায়। দুই নদীর জলধারার সংঘর্ষে উত্তাল ফেনিল হয়ে উঠেছে জলরাশি। রাম, লক্ষ্মণ প্রণত হলেন এই বিপুল জলশক্তির সামনে।
নৌকা থেকে নেমে আবার স্থলপথ। দ্রুত পায়ে যতটা এগিয়ে চলা যায়, এবার সে চেষ্টা। রাম লক্ষ্মণ দেখলেন সামনে এক ভয়াল অরণ্য। ধব, অশ্বকর্ণ, ককুভ, বিল্ব, তিন্দুক, পাটলী গাছের নিবিড় আচ্ছাদনে আঁধার ঘনিয়েছে সে অরণ্যে। গভীর ভীষণ তার রূপ, যেন ঘন কালো মেঘ নেমে এসেছে মাটিতে। অজস্র পাখির কলকাকলিতে আর একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকে মুখর সেই বনভূমি। ভেসে আসছে হিংস্র শ্বাপদের বিচিত্র ধ্বনি। বাঘ, বরাহ, ভালুক, গণ্ডার, হাতীদের বিচরণভূমি এই গভীর অরণ্যানী। প্রশ্ন করে রাম লক্ষ্মণ— এলাম কোথায়? কি নাম এই গহন বনের? উত্তরে বিশ্বামিত্র বলতে শুরু করেন— মলজ আর করূষ – দুই সমৃদ্ধ সুশোভিত জনপদের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি। তার সঙ্গে জুড়ে যায় যক্ষী তাড়কার ইতিবৃত্ত।
দেবরাজ ইন্দ্র ক্রোধবশত বধ করেছিলেন সখা বৃত্রাসুরকে। ফলে মিত্রদ্রোহিতার পাপ বা মলে লিপ্ত হয়েছিলেন ইন্দ্র। তখন দেবতা ও ঋষিরা এই স্থানে তাঁকে স্নান করিয়ে মল (পাপ) মুক্ত করেন। তারপর কারূষ বা ক্ষুধায় কাতর, যুদ্ধক্লান্ত ইন্দ্র এখানেই খাদ্য গ্রহণ করে ক্ষুধা মুক্তও হয়েছিলেন। ইন্দ্র খুশি হয়ে বর দিলে মলজ আর করূষ নামে প্রসিদ্ধ হল দুটি জনপদ। দেবতার বরে, সুখে সম্পদে তাদের শ্রীবৃদ্ধি। এভাবেই কাটছিল দিন। এই দুর্গম শ্বাপদসংকুল অরণ্য আজ যেখানে, সেখানেই ছিল এ দুটি জনপদ। হঠাৎ সে দেশে শুরু হল যক্ষী তাড়কার অত্যাচার। দৈত্যপতি সুন্দের পত্নী সে, পুত্র তার ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী মারীচ নামক রাক্ষস। হাজার হাতীর বল তার শরীরে, ইচ্ছামত রূপ ধারণ করতে পারে সে অনায়াসে। দুটো রমণীয় জনপদের আর চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট নেই তার অত্যাচারে। যে ভয়াল অরণ্যে পরিণত হয়েছে দুটো জনপদ, সেই অরণ্যই তার বাসস্থান।
এ কাহিনী শুনতে শুনতে সংশয় জাগল রামের মনে। সাধারণত যক্ষরা দৈহিক ভাবে খুব শক্তিশালী হয় বলে শোনা যায় না। তাহলে যক্ষনারী তাড়কা এমন হাজার হাতীর বল ধরে কীভাবে? কীভাবেই বা নিজের শক্তিতে দুটো জনপদ ধ্বংস করে দিতে পারে এই নারী? তাহলে জানতে হয় তাড়কার পূর্বজীবনের ইতিহাস। বিশ্বামিত্র বলে চললেন। শ্রোতা দুই রাজকুমার। পুরাকালে সুকেতু নামে ছিলেন এক মহাযক্ষ। শুদ্ধাচারী, তপস্বী ছিলেন তিনি। নিঃসন্তান সেই যক্ষ দুশ্চর তপস্যা করে ব্রহ্মার বরে পেলেন এক কন্যারত্ন, নাম হল তার তাড়কা। ব্রহ্মার আশীর্বাদে সেই কন্যা তার দেহে পেল হাজার হাতীর শক্তি। কালে কালে রূপলাবণ্যময়ী হয়ে উঠতে লাগল তাড়কা। পিতা সুকেতু রূপযৌবনবতী কন্যার বিবাহ দিলেন জম্ভের পুত্র সুন্দের সঙ্গে। তাদের পুত্র হল মারীচ। কিন্তু কিছুকাল পরে কোন এক অপরাধে অগস্ত্য ঋষির শাপে সুন্দ নিহত হল। স্বামী হারিয়ে প্রতিশোধস্পৃহা জাগল তাড়কার মনে। জন্ম নিল ঋষিবিদ্বেষ। অগস্ত্যকে পরাস্ত করতে উদ্যত হল তাড়কা আর মারীচ। আক্রমণ করল তাঁর আশ্রম। ক্রুদ্ধ ঋষির অভিসম্পাতে মারীচ হল রাক্ষস। আর রূপবতী তাড়কা হয়ে উঠল বিকৃতদর্শনা, ঘোররূপা, মনুষ্যভোজী রাক্ষসী। অগস্ত্য আগে এই দেশে বাস করতেন, শাপগ্রস্তা যক্ষী নিদারুণ ক্রোধে আজও এই স্থানকে বিধ্বস্ত করে চলেছে।
সামনে সেই আঁধার-কালো তাড়কাবন। গা-ছমছম, ঘনঘোর বনপথ। সেই সংকটসংকুল পথেই এবার কৌশল্যানন্দনকে ছোটাতে হবে জীবনরথ।—চলবে
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে