শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

রামায়ণী কথার কথকতা শুরু করা যাক, যাঁর কাব্য, তাঁকে সামনে রেখেই। ভারতীয় কবিগণনায় প্রথমেই তাঁর স্থান, তিনি বেদার্থবিদ, মুনিশ্রেষ্ঠ বাল্মীকি। তপস্যায়, তত্ত্বজ্ঞানে, বিচক্ষণতায় তিনি ‘মুনিসত্তম’, বাল্মীকিরামায়ণের অন্যতম চরিত্রও। সেই চরিত্র-বাল্মীকি প্রচেতার পুত্র, রামের সমকালীন। আবার, লবকুশের মুখে শুনি, তিনি ভৃগুপুত্র বা ভার্গব। তাহলে দস্যু থেকে ঋষি হলেন বলে প্রসিদ্ধি যাঁর, মরা-মরা জপ করে রাম-নাম পেয়ে নবজন্ম হয়েছিল যাঁর, যিনি ধ্যানমগ্নতায় বল্মীকের স্তূপে ঢাকা পড়ে গিয়ে, সেই স্তূপ ভেঙে উঠে এসে হলেন বাল্মীকি—তিনি কে? তিনিও তো সেই কবিই, তবে সেই সংযোজিত আখ্যান অধ্যাত্মরামায়ণের, সে আখ্যান কৃত্তিবাসের। আমাদের আখ্যানের অভিমুখ উৎসভূমির সন্ধানে, আদিকবির আদিকাব্যটিকে উপজীব্য করে।

বাল্মীকির আশ্রমে এলেন দেবর্ষি নারদ। ত্রিকালদর্শী নারদ ব্রহ্মার মানসপুত্র। জগতের খুঁটিনাটি অতিতুচ্ছ বিষয়ও দৃষ্টি এড়ায় না তাঁর। বাল্মীকি মনে মনে তখন খুঁজছেন পৃথিবীর বুকে এক নরচন্দ্রমাকে, যিনি ধর্মজ্ঞ, নিজ ব্রতে অবিচলিত; যিনি পরাক্রমী হয়েও ক্রোধবিজয়ী, আবার রুষ্ট হলে দেবতারাও ভয় পান যাঁকে; সমগ্র গুণলক্ষ্মীর আশ্রয় যিনি—মনের দর্পণে দেখবেন তাঁকে, আঁকবেন তাঁর জীবনের চলচ্ছবি, রঙে, রসে। একই মানুষে এত গুণ ধরে বুঝি! দেবতাতেও দেখা যায় না এত গুণের সমাহার। তবে কি নিরাশ হবেন? আকুল হয়ে জানতে চাইলেন নারদের কাছে—‘আছেন কি জগতে এমন দেবদুর্লভ নরশ্রেষ্ঠ?’ ত্রিকালজ্ঞ দিলেন তাঁর সন্ধান। বাল্মীকিকে আশ্বস্ত করলেন, কাঙ্ক্ষিত জন আছেন এই মর্ত্যলোকেই, ইক্ষ্বাকুরাজকুল আলো করে জন্মেছেন। পদ্মপলাশ আঁখি, আজানুলম্বিত বাহু, উন্নত দুই কাঁধ, শাঁখের মতো গ্রীবা, প্রশস্ত বক্ষদেশ, স্নিগ্ধ তাঁর গায়ের রং, দেহ জুড়ে সুলক্ষণ। ধর্মে, কর্মে, জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ সবার চেয়ে। মনস্বী, জিতেন্দ্রিয় সেই পুরুষ যেন গাম্ভীর্যে অতল সমুদ্র আর ধৈর্যে অচল হিমালয়, ক্রোধে যেন প্রলয়াগ্নি আর ক্ষমায় সর্বংসহা ধরিত্রী। তিনি মা কৌশল্যার আনন্দবর্ধন, অযোধ্যাপতি দশরথের জ্যেষ্ঠ পুত্র, রাম। নারদ সংক্ষেপে বলে চললেন রামের জীবনগাথা, তাঁর জীবনের চালচিত্রে ধরা পড়ল পিতা, মাতা, স্ত্রী, বন্ধু, স্বজন, প্রিয়জন, শত্রুজন- সকলেরই জীবনালেখ্য। রামের যৌবরাজ্যে অভিষেক, তাঁর বনবাস, দশরথের মৃত্যু, রাবণের সীতাহরণ, রামের লঙ্কাপ্রবেশ, রাবণবধ, সীতা উদ্ধার, রামের অযোধ্যায় ফিরে এসে রাজ্যগ্রহণ- এই জীবনের গতিপথ পরিক্রমা করে থামলেন নারদ। নারদের বীণার তন্ত্রীতে যেন সুখে-দুঃখে, আলোয়-ছায়ায় বাঁধা জীবনের সুর ঝংকৃত হলো। আর সেই সুরের অনুরণন পৌঁছে গেল ঋষির অন্তরে। গভীরতর তান হয়ে মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি হবে যার, শুরু হলো তার প্রস্তুতি বাগ্বিশারদ ঋষির মননে, নিদিধ্যাসনে। কথা শেষে বিস্ময়ে অভিভূত ঋষি শ্রদ্ধাভ’রে প্রণতি জানালেন, আশীর্বাদ করে দেবলোকে ফিরে গেলেন নারদ।

শত শ্লোকে গাঁথা নারদের রামায়ণকথাসূত্রে আদিকাণ্ডের ভূমিকাপর্ব এবং উত্তরকাণ্ডটি বাদ। সীতা পরিত্যাগ, বাল্মীকিরই আশ্রমে সীতার বসবাস, লবকুশের জন্মকথা কিংবা সীতার পাতালপ্রবেশের গল্প শোনান নি দেবর্ষি। বরং এ ঘটনাপর্বের উল্লেখ পাওয়া গেলো আদিকাণ্ডের তৃতীয় সর্গে, সমগ্র রামায়ণী কথার সূচীপত্রটি পাই যেখানে।। যে সকল আধুনিক বিদগ্ধ জন উত্তরকাণ্ডকে উত্তরকবিদেরই কবিকৃতি বলে মনে করেন, তাঁদের কাছে এটি অন্যতম যুক্তি-অস্ত্র। তবে সেসব অন্য প্রসঙ্গ। আমরা গল্পের পথ ধরে যাই তমসার তীরে।

বাল্মীকি চললেন বনপথ ধরে শিষ্য ভরদ্বাজকে নিয়ে তমসার তীরে। বড়ো টলটলে জল তমসার, সাধুপুরুষের মনের মতো স্বচ্ছ, প্রসন্ন। তীরের কাছে জলে নামার পথে না আছে কাদা, না আছে পাথুরে চড়াই-উৎরাই। মিহি বালিকণা বিছিয়ে আছে স্বচ্ছতোয়া জলের গভীরে। এমন পরিবেশে প্রসন্নতায় মন ভরে গেলো বাল্মীকির। আশ্রম থেকে বল্কল এনে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলেন ভরদ্বাজকে। শিষ্য ফিরে এলে রম্যসলিলা তমসায় স্নানে নামলেন তিনি। জপ, তর্পণ সেরে তীরে উঠে এলেন মনভরা প্রশান্তি নিয়ে। স্নিগ্ধ নদী আর শান্ত চরাচর। সুরম্য বনপথ ধরে ফিরছেন তাঁরা আশ্রমে। হঠাৎ চোখে পড়ল ক্রৌঞ্চমিথুন- ‘চারুদর্শন’ দুই পাখি, শুনতে পেলেন তাদের মধুর কলতান। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা দুই পাখি মগ্ন নিবিড় প্রণয়লীলায়, নেই কোনো শঙ্কা, নেই কোনো ভয়। কিন্তু নিঃশব্দে আড়ালে এসে দাঁড়ালো এক ব্যাধ, মুনির সামনেই তার নিষ্ঠুর তীর বিদ্ধ করলো পুরুষ ক্রৌঞ্চটিকে- মাথায় তার লাল ঝুঁটি, আসঙ্গলিপ্সায় তখন মেলেছে সে তার পাখা দুটি। মুহূর্তে আনন্দচঞ্চলতা গেলো থেমে, মৃত্যুর করাল ছায়া টেনে দিল করুণযবনিকা। কোমল দেহটি আছড়ে পড়লো, মাটি ভেসে গেলো রক্তে। আদিগন্ত ভেসে গেলো ক্রৌঞ্চবধূর আর্ত কান্নায়। আর প্রসন্ন স্নেহসিক্ত ঋষিহৃদয়ের তীরে এসে ধাক্কা দিল সেই কান্নার জোয়ার। করুণামথিত শোকের সাগর থেকে যেন স্বতঃস্ফূর্ত ধারায় উছলে উঠল ক্রূর নিষাদের প্রতি অমোঘ অভিশাপবাণী—

“মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।”
“ওহে নিষাদ, তুমি কোনোকালেও প্রতিষ্ঠা পাবে না, কারণ ক্রৌঞ্চমিথুনের একটিকে কামমগ্ন অবস্থায় বধ করেছ তুমি।”

আবেগের বশে এ কথা বলে যেন চমক লাগলো নিজেরই – ‘কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া’ -এ আমি কী বললাম! বিস্ময়ের ঘোর কাটলে বোধি দিয়ে জানলেন, এ তো সাধারণ অভিশাপবাক্য মাত্র নয়, এ যে ঐশ্বর্যময়ী বাক! কি নাম দেবেন এর? অপার বাঙ্ময়ের কোন সীমানায় বাঁধবেন একে? উত্তর মিললো নিজের মনেই। প্রজ্ঞাদৃষ্টি দিয়ে জানলেন তার স্বরূপটিকে- সমাক্ষর চতুষ্পাদ ছন্দোময়ী এ বাক্য। সে উঠে এসেছে অন্তর্লীন শোক থেকে, তাই সে ‘শ্লোক’। ঋষিহৃদয়ের শোক থেকে জন্ম নিল শ্লোক।

আশ্রমে ফিরে এলেন মুনিশ্রেষ্ঠ। কিছুতে ভুলতে পারছেন না হৃদমাঝার থেকে উঠে আসা সেই অপূর্ব সমমধুর বাঙ্ময়ধ্বনি। সে সব কথা ভাবতে ভাবতে বসলেন ধ্যানে। এমন সময় এলেন স্বয়ং লোকপিতামহ ব্রহ্মা। পাদ্যার্ঘ্যে, সকৃতজ্ঞ করাঞ্জলিতে অভ্যর্থনা জানালেন বিস্মিত মুনিবর। কিন্তু মুখোমুখি বসেও যেন অন্যমনা তিনি, বুকের মধ্যে কেবলই বাজছে ক্রৌঞ্চীর করুণ কান্নার সুর। অন্তরজ্ঞ অন্তরের কথাখানি বুঝে নিয়েছেন ততক্ষণে। সহাস্যে বললেন ব্রহ্মা, “মহর্ষি, আমারই ইচ্ছায় ক্রৌঞ্চবধকে আশ্রয় করে শোক রূপ পেলো তোমার সারস্বতবাণীতে, শোক থেকে জন্ম এ বাণীর, তাই এর প্রসিদ্ধি হোক ‘শ্লোক’ নামে। নারদের কাছে শুনেছো যে রামের চরিতাখ্যান, তাকে রূপ দাও, ছন্দে ছন্দে গাঁথো তাকে, মূর্ত করো শ্লোকে। সে রামকথার যা কিছু শুনেছো, লিখবে তাকে; আর যা কিছু অপ্রকাশিত, আমার অনুগ্রহে তাও আসবে তোমার জ্ঞানের সীমারেখায়। তাঁদের কাজ, কথা, ভাবনা, চিন্তা- ‘আসিতং ভাষিতং মতং যচ্চাপ্যনুষ্ঠিতম্’ সবই উদ্ভাসিত হবে তোমার মানসরাজ্যে।” তবুও যদি মনে থাকে এ বিপুল কবিকর্মে সংশয়, দোলাচলে দুলে ওঠে মন? প্রজাপতি দিলেন তাঁকে অবিচলিত সংশয়মুক্ত প্রত্যয় – নিশ্চিত আশ্বাস, যা ঝরে পড়ল অক্ষয় আশীর্বাণী হয়ে- “যা লিখবে তুমি, তাই সত্য হবে- এ কাব্যে তোমার কোনো বাক্যই মিথ্যা হবে না।” এ যুগের কবি ধরলেন তাকে আধুনিক বাণীমূর্তিতে- “সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে।” “যতদিন অবিচল থাকবে পর্বতমালা, যতদিন ভূমিতলে স্রোতস্বিনী ধারা, ততদিন লোকজগতে অবিরাম ধারায় বইবে রামায়ণী কথাপ্রবাহও, ক্ষয় হবে না, লয় হবে না তার। আর যতদিন প্রবাহিত হবে রামকথা, ততদিন তুমিও থাকবে আমার তৈরি বিশ্বলোকে।” এই বলে অন্তর্হিত হলেন ব্রহ্মা। পিছনে রেখে গেলেন আদিকাব্যের ভাবী স্রষ্টাকে, ছুঁইয়ে গেলেন সোনার কাঠি হৃদয়ের অথৈ শোকসাগরে। তা থেকে উছলে উঠবে শ্লোক, সৃষ্টি হবে মহাকাব্যগাথা। কাব্যবস্তু পেয়েছিলেন আগেই, ক্রৌঞ্চবিরহের করুণ কান্নায় পেলেন তার ভাবটিকে, দু’য়ে মিলে সৃষ্টি হবে কাব্য – ব্রহ্মার কাছে পেলেন তার আশ্বাস, পেলেন আশীর্বাণী। ঋষিকবি বসলেন ধ্যানে- বহু শতাব্দ পার করে উত্তর-আলংকারিক অভিনবগুপ্ত একেই তো বললেন, পরিপূর্ণ, উচ্ছলিত কলসের মতো মন! আর তাবড় কবি, কাব্যবিশারদ বিদগ্ধজনের কাছে তাঁর কবিসত্তার মূল অভিজ্ঞানটিই হয়ে উঠল, ‘ক্রৌঞ্চবিরহী কবি’।

ক্রৌঞ্চবধূর শোকে উদ্বেলিত মন থেকে উচ্ছলিত হয়ে উঠল শ্লোক– ধ্যানের আঁখি মেলে দেখলেন সমুদ্রের মতোই রত্নাঢ্য এক কাব্য! নারদের কাছ থেকে পেয়েছেন কাব্যবীজ, তা দিয়ে শুরু হলো মহাকাব্য নির্মাণের প্রস্তুতি। সন্তুষ্টি হলো না এতেই। জানা নেই যা, তাকে জানতে হবে যে! মহাকাব্যিক কাব্যবস্তুতে মিশে যেতে লাগলো লোকজগৎ থেকে খুঁজে আনা বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহ, রামের জীবনের অজানা দিক যত। যা কিছু ঘটেছে শুধু তাই নয়, যা কিছু ঘটবে, ত্রিকালদর্শী ঋষির দর্শনে তপোবলে ধরা দিল সবই, এ যেন হাতের মুঠোয় অনায়াসে ধরা আমলকী ফলটি। দ্রষ্টা হয়ে উঠলেন স্রষ্টা- সৃষ্টি হল চব্বিশ হাজার শ্লোকে এক রত্নপরিপূর্ণ কাব্যসাগর- রামায়ণ- তাকে শুনেও পুণ্য, বলেও পুণ্য। পুণ্য তো হবে, কিন্তু বলবে কে? সাত সুরের মূর্চ্ছনায় গাঁথা এমন সুললিত শ্লোকরাশি, ঘটনার ঘনঘটা, ভাবের গাম্ভীর্য, রসের পারিপাট্য যে কাব্য জুড়ে; উপযুক্ত পাত্র ছাড়া তার প্রচার করবে কে? চিন্তা ঘনালো কবির মনে। ভাবতে ভাবতেই বনের মধ্যে উপস্থিত দুই মুনিবেশধারী কুমার- বাল্মীকির দুই শিষ্য তারা, রাম-সীতার দুই পুত্র কুশ আর লব- দুই ভাই। রূপে গুণে তাদের জুড়ি মেলা ভার। স্বস্তিতে মন ভরে গেল কবির। পরম যত্নে শেখালেন তাদের রামায়ণ গান। গাইবে তারা ঋষি-সংসদে, রাজার সভায়, সাধুসমাগমে। আর সে মধুর গান শত শত যুগ ধরে কান পেতে শুনবে মানবপ্রাণ…।—চলবে

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে
* শাশ্বতী রামায়ণী (Saswati Ramayani – Ramayana) : ড. অমৃতা ঘোষ (Amrita Ghosh) সংস্কৃতের অধ্যাপিকা, আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহাবিদ্যালয়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও সম্পাদিত গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।

Skip to content