রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

মন নিয়ে কথা। এক মন তাকে ভিন্ন ভিন্ন কাজে জড়িয়ে আছে। যে মন ঈশ্বরে লাগানো যায়, সেই মন দিয়ে জগতের কাজও করা যায়। যেমন লোহা— তাকে দিয়ে কেউ বাড়ি তৈরি করেন, কেউ বা দরজা, ছুরি বা মূর্তি তৈরি করেন। মন হল আমাদের, কিন্তু সমস্যা হল আমরা মনের হয়ে যাই। তখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। বিষয়বস্তু নিয়ে চিন্তা করে করে মন বিষয়ের হয়ে যায়। মন তখন বিষয় চিন্তা ত্যাগ করতে পারে না। অনেক সাধ্য সাধনা করলে তবে ঈশ্বরের কাছে মনকে অর্পণ করা যায়।
এখন কথা হচ্ছে, আমরা কীভাবে মনের উৎকর্ষতাকে বাড়াতে পারি? বাহ্যিক বিষয় ছাড়া মন থাকতে পারে না। কারণ জন্মের পর থেকেই তাকে বাহ্যিক বিষয়ে সকল চিন্তা করতে শেখানো হয়েছে। তার পর তার পূর্ব-পূর্ব সংস্কার তাকে প্রবল ভাবে চাপ দেয়। প্রথম কাজ হল, তাকে বিপরীত ভাবনায় ভাবিত করা। আমাদের বিষয়ের প্রতি বিরাগ উৎপন্ন করা। বিষয়ে প্রতি যে অনুরাগ এতদিন ধরে ছিল, তাকে পরিবর্তন করা যায় একমাত্র বিশ্লেষণের মাধ্যমেই। অনুরাগ, বিষয়ের বাহ্যিক রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দের প্রতি রয়েছে মন পরিবর্তন করে স্রষ্টার প্রতি আকর্ষণ করা। প্রতিনিয়ত বাধা আসবে, কিন্তু ক্রমাগত চেষ্টাও চালিয়ে যেতে হবে।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫৮: মনুষ্য দেবতার মধ্য দিয়েই সমাজের প্রকৃত জাগরণ সম্ভব

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫২: রামচন্দ্রের বনবাসগমনের সিদ্ধান্তে নৈতিকতার জয়? নাকি পিতার প্রতি আনুগত্যের জয় ঘোষণা?

ঠাকুরের একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি বলছেন, “এক ব্যক্তির একদিকে স্ত্রী ও অন্য পার্শ্বে সন্তান ঘুমাচ্ছে। সে দু’ জনকে দুই ভাবে আদর করে।” কথাটা লৌকিকভাবে দেখলে অর্থহীন মনে হয়। কিন্তু এর গভীর অর্থ রয়েছে। মনের যে বিষয়ের উপর ভাব বা মোহ রয়েছে তার পরিবর্তন করাই হল ভালোবাসা। বিষয় যদি এত সুন্দর হয় তবে তার স্রষ্টা কত সুন্দর। ঈশ্বরের প্রতি আকর্ষণের মোড় ফেরানো। স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন, ২৫ শতাংশ মন দিয়ে সংসারের কাজ করলে হয়ে হেউ ঢেউ; বাকি ৭৫ শতাংশ মন দিয়ে ঈশ্বর চিন্তা করা যায়।” সবসময় মনকে ঈশ্বর চিন্তায় রাখা যায় না, যখন নেমে আসবে ঈশ্বরের কাজ করা। কাজের প্রতি ভাবের পরিবর্তন করা, তবে তার প্রতি ভালোবাসা আসবে। তখন আর লৌকিক কাজ বা জাগতিক কাজ থাকবে না। তখন প্রতিটি কাজই আধ্যাত্মিক কাজ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা

আমরা ঈশ্বরকে ভালোবাসি, তার সান্নিধ্য অনুভব করার চেষ্টা করি। যেমন আমরা পিতা-মাতা, গুরুর সান্নিধ্য লাভ করি। তেমনই ঈশ্বর উপাসনার মাধ্যমে তার সান্নিধ্য লাভ করা যায়। তিনি আমাদের প্রিয়, প্রিয়ের থেকে প্রিয়। তাঁকে সবকিছু উজাড় করে দেওয়া যায়। নিজের যা কিছু রয়েছে, তা যদি আমরা দিতে পারি তখন প্রকৃত পুজো সম্পন্ন হবে। যদি জাগতিক বস্তুর কথা ভাবি, তাহলে তাঁর জিনিস তাঁকে দেওয়া। তাহলে মহত্ত্ব কি রইল! শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “ভক্তিই সার, ঈশ্বর তো সর্বভূতে আছেন। তবে ভক্ত কাকে বলি? যার মন সর্বদা ঈশ্বরেতে আছে, আর অহংকার, অভিমান থাকলে হয় না।”
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৩: ইন্দিরা দেবী—ঠাকুরবাড়ির আলো!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা

মানস পুজোর মন্ত্রতে সুস্পষ্ট ও মধুর সেই ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে। এর থেকে আর শ্রেষ্ঠ নিজেকে অর্পণের এবং রূপ উপাসনা অন্য কিছু হতে পারে না। ‘হৃদয় যখন পদ্মাসন। সহস্রার থেকে নিঃসৃত অমৃত পাদ্য স্বরূপ। মন অর্ঘ্য সদৃশ। অমৃত আচমনীয় স্বরূপ। আকাশ তত্ত্ব, বস্ত্র ও গন্ধ তত্ত্ব, গন্ধ সরূপ। চিত্ত পুষ্প সদৃশ। প্রাণ ধূপ রূপ। তেজ তত্ত্ব দীপ রূপ। সুধা নৈবেদ্য জল। অনাহত ধ্বনি ঘণ্টা স্বরূপ। বায়ু তত্ত্ব চামর সদৃশ। সহস্রার ছত্র স্বরূপ শব্দতত্ত্ব গীত স্বরূপ। মন ও ইন্দ্রিয়ের চাঞ্চল্যতা নৃত্য স্বরূপ। সুমেখলা পদ্মমালা, সহস্রারচক্র থেকে মূলধারচক্র পর্যন্ত সমস্ত পদ্ম সকল পদ্মমালা ও নানা বিধ পুষ্প। অমায়া রূপ ভাব পুষ্পের দ্বারা অর্চনা ভাবের অগোচর।

অ-মায়, ন-অহংকার, অ-রাগ, অ-মদ, অ-মোহ, অ-দম্ভ, অ-দ্বেষ, অ-ক্ষোভ, অ-মাৎসর্য, অ-লোভ এই সকল দশ পুষ্প স্বরূপ। অ-হিংসা পুষ্প, ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ পুষ্প, দয়া পুষ্প, ক্ষমা পুষ্প, জ্ঞান পুষ্প—এই আর পরম উত্তম পঞ্চপুষ্প সকল। এই পঞ্চ-দশ পুষ্পের দ্বারা হে কল্যাণকারী ঈশ্বর তোমার পূজা সম্পন্ন করি।’

মানস পুজোর সাকার রূপটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের উৎসর্গ করা সম্ভব হবে।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content