শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সংসারীরা কেমন করে সংসার করবেন? শ্রীরামকৃষ্ণ সে কথাসকল অনেকবার বলেছেন। কখনও সরল কথায়, কখনও বা গল্পচ্ছলে। সংসারে থেকে ঈশ্বরলাভ করা কেমন করে সম্ভব? সে কথাই বলছেন এক হাতে সংসার করা এক হাতে ঈশ্বরকে ধরে থাকা। একদিকে যেমন দাসীর উদাহরণ দিয়েছেন সংসারে থেকে সংসারী না হওয়া; আবার যেমন উপপতির উপর স্ত্রীর মন পড়ে থাকে; তেমন ঈশ্বরের উপর মন রেখে সংসারে করার কথা বলেছেন। এ সংসার যেমন ধোকার টাঁটি আবার, তেমন মজার কুটিও। খায় দায় আর মজা লুটি। সাধকের কাছে সংসার সাধনক্ষেত্র। তেমনই কিন্তু তিনি এই জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব সকল হয়েছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সংসার থেকে ঈশ্বর লাভের কথা বলছেন, “তবে ব্যাকুল হতে হয়। এমনই আছে তিনটান একসঙ্গে হলে ঈশ্বর দর্শন হয়। সন্তানের উপর মায়ের টান, সতী স্ত্রীর স্বামীর উপর টান, আর বিষয়ীর বিষয়ের উপর টান। ঠিক ভক্তের লক্ষণ আছে। গুরুর উপদেশ শুনে স্থির হয়ে থাকে, আর ঠিক ভক্তের ধারণা শক্তি হয়। কিন্তু কাচের উপর ছবির দাগ পড়ে না, কিন্তু কালি মাখানো কাঁচের উপর ছবি উঠে। যেমন ফটোগ্রাফ। ভক্তিরূপ কালি।” “তা তোমরা সংসারে আছো, থাকলেই বা এতে সাধনের আরও সুবিধা, যেমন কেল্লা থেকে যুদ্ধ করা।”
শ্রীরামকৃষ্ণ-উক্ত, ভক্তের লক্ষণ সকলের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সাধু নাগমহাশয়। কখনও কখনও মনে হয় শ্রীরামকৃষ্ণ নাগ মহাশয়কে সংসারে নিয়ে এসেছিলেন এই সকল দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপন করার জন্য। শ্রী দুর্গাচরণ নাগ সংসারী ছিলেন, কিন্তু তার অধিক পরিচিতি সাধু নাগ মহাশয় নামে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, “জ্বলন্ত আগুন”। ভক্তির তীব্রতা থাকে ভক্ত শিরোমণি করে তুলেছিল। মন সর্বদা ঈশ্বরে থাকতো।

ঈশ্বর দর্শন করেছে কি না তার লক্ষণ সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “কখনও সে উন্মাদ বৎহাসে, কাঁদে, নাচে, গায়। কখনও বা বালক বৎ। পাঁচ বছরের বালকের অবস্থা। সরল, উদার, অহংকার নাই, কোন জিনিসে আসক্তি নাই, কোন গুণের বশ নয়। সদা আনন্দময়। কখনও বা পিশাচবৎ… কখনও বা জড়বৎ…।”

নাগ মহাশয়ের জীবন ছিল অদ্ভুত; ভক্তি ও ভক্তের গুণ সকলের জীবন্ত দৃষ্টান্ত। তার গুরু ও পিতার প্রতি এতই অনুরাগ ছিল যে, তা অকল্পনীয়। সত্যবাদন এতই প্রখর ছিল যে, যা বলতেন তাই সত্য হতো। আর শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি ও সংঘের গুরু ভাইদের প্রতি ভালোবাসা যে তার দারিদ্রতা সত্বেও তাকে খাটো করতে পারেনি। শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি, “তুমি আর তোমার এটি জ্ঞান, আমি আর আমার এইটি অজ্ঞান।” এই ‘সিদ্ধান্ত বাক্য’ জীবনে সর্বান্তকরণে পরিণত করে তিনি দেখিয়েছেন। নাগ মহাশয় শ্রীশ্রীমাকে সাক্ষাৎ ভগবতী বলেই জানতেন।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫৫: শুদ্ধ মন, শুদ্ধ আত্মা এক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

এক একাদশী দিন সবে শ্রীশ্রীমা আহারে বসেছেন, ঝি এসে খবর দিলে, “মা, নাগ মহাশয় কে? তিনি প্রণাম করছেন। কিন্তু মাথা এত জোরে ঠুকছেন মনে হয় রক্ত বেরুবে। যোগানন্দজি পিছন থেকে থামাবার জন্য বললেও তার হুশ নেই। পাগল নাকি মা?” শ্রীমা শুনেই, যোগানন্দকে নিয়ে আসতে বললেন। নাগ মহাশয়ের কপাল ফুলেছে, চোখ দিয়ে জল পড়ছে, পা এখানে পড়তে সেখানে পড়ছে। শ্রীশ্রীমাকে পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। এ জগতে যেন নেই। মুখে কেবল ‘মা’ ‘মা’ শব্দ, যেন উন্মাদ। অথচ প্রশান্ত, ধীর, স্থির। শ্রীমা অশ্রু মুছে দিয়ে, একাদশীর যে আহার সকল ছিল, লুচি, ফল, মিষ্টি কিছু নিজে খেয়ে বাকি সহাস্তে নাগ মহাশয়কে খাইয়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু নাগ মহাশের মন এই জগতে নাই। খাওয়ার খেতে পারছেন না। ‘মা’ ‘মা’ বলছেন, আর শ্রীমায়ের পায়ে হাত দিয়ে বসে আছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৫: সুন্দরবনের নদীবাঁধের অতীত

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৯: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

কিছুক্ষণ পরে শ্রীমা গায়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঠাকুরের নাম করতে করতে হুঁশ এল। তখন শ্রীমাও খেলেন ও নাগ মহাশয়ও খেলেন। যখন তাঁকে নিচে নামানো হচ্ছে, মুখে বলছেন ‘নাঽহম্ নাঽহম্ তুহুঁ তুহুঁ।’ শ্রীমা বলছেন, “দেখো কি বুদ্ধি।” শ্রীশ্রীঠাকুর একেই তো ‘জ্ঞান’ বলেছেন। শ্রীশ্রীমা বলছেন ‘বুদ্ধি’। শ্রীশ্রীমায়ের স্বহস্তে প্রসাদ পেয়ে আনন্দ আত্মহারা। বলছেন, “বাপের চেয়ে মা দয়াল, বাপের চেয়ে মা দয়াল।” আরেকবার নাগ মহাশয় বাছাই করা কিছু আম নিয়ে মায়ের দর্শনে এসেছেন। যোগানন্দজি মায়ের কাছে খবর পাঠাইলেন যে, নাগ মহাশয় এসেছেন, “মাকে বলো।” শ্রীশ্রীমা শুনেই বললেন, “এখানে পাঠিয়ে দাও।” মায়ের কাছে ঝুড়ি নামিয়ে চরণ বন্দনা করলেন। পূর্বের মতো। তাঁর চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে, তখনও ঠাকুর পূজা হয়নি।

শ্রীমা আমগুলি কেটে ঠাকুরের পুজোয় ভোগ দিলেন। পুজো শেষে একটি শাল পাতায় শ্রীমাকে প্রসাদ দেওয়া হলে তিনি কিছু খেয়ে, নাগ মহাশয়কে আর একটি শালপাতায় দিয়ে বললেন, ‘খাও’। কিন্তু খাবে কে! তার দেহে জ্ঞানই নেই। হাত যেন অবশ। অনেক করে হাত ধরে শ্রীমা বলাতে, শুধু এক টুকরো আম নিয়ে মাথায় ঘষতে লাগলেন। শ্রীমা নিরুপায় দেখে তাঁকে নিচে নিয়ে যেতে বললেন। ধীরে ধীরে একজন নিচে নিয়ে গেল। তারপর হুঁশ এলে বাড়ি ফিরলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৯: মহাকাব্যের রাক্ষস ও মানুষের কাহিনিতে আধুনিক জীবনচিত্রের প্রতিফলন রয়েছে কি?

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

এরকম একটি সময়ে শ্রীমা বাগবাজারে গুদাম বাড়িতে আছেন। নাগ মহাশয় আসলে, তাঁকে এক শাল পাতায় প্রসাদ দেওয়া হল। তিনি ভক্তির আতিশয্যে পাতাসুদ্ধ প্রসাদ খেয়ে ফেলেন। অন্য একবার শ্রীমা তাঁকে একটি কাপড় দেন। তা তিনি না পরে মাথায় জড়িয়ে রাখতেন। শ্রীশ্রীমা, তাঁর শয়ন ঘরে টাঙানো স্বামীজি, গিরিশবাবু ও নাগ মহাশয়ের ছবিগুলি মুছে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে, হাত দিয়ে মা চুমু খেতেন। একজন একদিন দেখলেন, ছবি দেখতে দেখতে শ্রীমা বলছেন, “কত
ভক্তই আসছে কিন্তু এমনটি আর দেখছি না।”

শ্রীরামকৃষ্ণের বেদ বাক্যগুলির জ্বলন্ত প্রমাণ স্বরূপে, এই ভক্তপ্রবর নাগ মহাশয় তাঁর অন্যান্য জীবনে আপনার গণ্ডী ছাড়িয়ে এতদূর বিস্তীর্ণ হয়েছিল যে, ব্রহ্মসীমা পর্যন্ত স্পর্শ করে। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ‘প্রেমা ভক্তি সকলের হয় না’। ঠিকই! কিন্তু নাগ মহাশয় এ সংসারে থেকেও ভক্তির অনন্য পরাকাষ্ঠা স্বরূপ ছিলেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content