গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও শ্রীরামকৃষ্ণদেব।
কথায় আছে, কষ্টিপাথরের স্পর্শে ধাতু সোনা হয়ে যায়। অবতার পুরুষরা সেই কষ্টিপাথর, যাঁরা স্পর্শ মাত্রই মানুষের পূর্বস্বভাবের পরিবর্তন করিয়ে নতুন আর এক মানুষে পরিণত করতে পারেন। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে এমন অনেকেই রয়েছেন যাঁরা পূর্ব পরিচিতি ভুলে সোনা হয়ে গিয়েছিলেন। এমন একজন ব্যক্তি হলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। তাঁকে ঠাকুর ভক্ত ভৈরবও বলতেন। গিরিশ প্রশ্ন করছেন, মনটা কখনও উঁচু, কখনও নিচু হয় কেন?
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “সংসারে থাকতে গেলে ওরকম হয়। কখনও উঁচু, কখনও নিচু। কখনও বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনী কাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা! তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখনও ঈশ্বর চিন্তা করে হরিনাম করে, কখনও বা কামিনী কাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে।” বিষয়ের সঙ্গে থাকার জন্য তার দোষ লাগেই। মন ও শারীর গুণ সকলের অধীন। আবার বলছেন, “ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাই। তবে তাতে সব মন হয়।”
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “সংসারে থাকতে গেলে ওরকম হয়। কখনও উঁচু, কখনও নিচু। কখনও বেশ ভক্তি হচ্ছে, আবার কমে যায়। কামিনী কাঞ্চন নিয়ে থাকতে হয় কিনা! তাই হয়। সংসারে ভক্ত কখনও ঈশ্বর চিন্তা করে হরিনাম করে, কখনও বা কামিনী কাঞ্চনে মন দিয়ে ফেলে।” বিষয়ের সঙ্গে থাকার জন্য তার দোষ লাগেই। মন ও শারীর গুণ সকলের অধীন। আবার বলছেন, “ঈশ্বরের অনুগ্রহ চাই। তবে তাতে সব মন হয়।”
ঈশ্বরের কৃপা ও গুরু কৃপা না হলে তা সম্ভব নয়, যে সবসময় ঈশ্বরে মন লাগিয়ে থাকা যায়। গিরিশ যে বিষয়টি ধরতেন তার শেষ নিরীক্ষণ করে ছাড়তেন। তিনি ঠাকুরকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন যে, তিনি ঈশ্বরের অবতার। আর অবতার পুরুষের পক্ষে কোনও কিছু অসম্ভব নয়। তাই তাঁর মতো অসৎসঙ্গে এত খারাপ কাজ করেছেন, এমন কেউ নেই। তবুও তার অসাধারণ মেধা, নিষ্ঠা ব্যুৎপত্তি ও অধ্যাবসার গুণে তিনি নট, নাট্যকার ও ‘মহাকবি’ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।রামকৃষ্ণ মণ্ডলেও অনন্য ভক্তির পরাকাষ্ঠার জন্য বিশেষ মান্যতা, অন্তরঙ্গের পর্যায়ে উন্নীত করেছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, গিরিশের পাঁচসিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস। তাঁর অটল বিশ্বাস যে, রামকৃষ্ণ সব পারেন। জীবের মুক্তিকল্পে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি চাইলেই তাকে সোনা করে দিতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে জোর করে কিছু ছাড়তে বলেননি। কিন্তু বলেছিলেন যা কিছু করবে তা তাঁকে স্মরণ করে করতে; আর গিরিশও কথা দিয়েছিলেন। গিরিশের ভাবের ঘরে চুরি ছিল না। মুখে ও মনে এক, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ভক্ত শ্রেষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার ভক্তি জ্বলন্ত পাবক স্বরূপ। তার ভক্তি বৈধি ভক্তির পার। তার ভক্তির উন্মাদতা শ্রী রামকৃষ্ণকে এমন ভাবে জড়িয়ে ছিল যে তার ভার নিতে বাধ্য হয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, গিরিশের পাঁচসিকে পাঁচ আনা বিশ্বাস। তাঁর অটল বিশ্বাস যে, রামকৃষ্ণ সব পারেন। জীবের মুক্তিকল্পে ধরায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি চাইলেই তাকে সোনা করে দিতে পারেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে জোর করে কিছু ছাড়তে বলেননি। কিন্তু বলেছিলেন যা কিছু করবে তা তাঁকে স্মরণ করে করতে; আর গিরিশও কথা দিয়েছিলেন। গিরিশের ভাবের ঘরে চুরি ছিল না। মুখে ও মনে এক, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ভক্ত শ্রেষ্ঠ ছিলেন তিনি। তার ভক্তি জ্বলন্ত পাবক স্বরূপ। তার ভক্তি বৈধি ভক্তির পার। তার ভক্তির উন্মাদতা শ্রী রামকৃষ্ণকে এমন ভাবে জড়িয়ে ছিল যে তার ভার নিতে বাধ্য হয়েছেন।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫৩: রঙ্গ-রস প্রিয় ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৭: পলায়নপর পঞ্চপাণ্ডব-ভীমসেনের গতিময়তায় কোন মহাভারতীয় দিগদর্শন?
গিরিশ ও অনন্যচিত্তে শ্রীরামকৃষ্ণ কে উপাসনার তেমন শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার ভার গ্রহণ করেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “যেমন পাঁকাল মাছ পাঁকের মধ্যে বাস, কিন্তু গায়ে পাঁকের দাগটি পর্যন্ত নাই।” সংসারে যেভাবে নির্লিপ্ত হয়ে থাকার কথা বলছেন কিন্তু তা থাকা সহজ নয়, তার জন্য বিচার ও ব্যাকুলতার প্রয়োজন। কালির ঘরের মধ্যে থাকলে একটু-আদটু কালি লাগবেই। গিরিশ যে সকল সঙ্গে থাকতেন তা সম্ভব ছিল না, নির্লিপ্ত থাকা। তাই তিনি আবদার করেছেন, ”মহাশয় ওসব আমি বুঝি না, আপনি মনে করলে সবাইকে নির্লিপ্ত ও শুদ্ধ করে দিতে পারেন।” কি সংসারী, কি ত্যাগী সবাইকে ভালো করে দিতে পারেন স্পর্শ মাত্রই। মলয়ের হাওয়া বইলে কলা, বাঁশটি পর্যন্ত, সবকাঠ ই চন্দন হয়ে যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “সার না থাকলে চন্দন হয় না, শিমুল আর কয়টি গাছ এরা চন্দন হয় না।” গিরিশ তা শুনবেন কেন!
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩৩: সুন্দরবনের এক অনন্য প্রাণীসম্পদ গাড়োল
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “আইনে ওরূপ আছে।” গিরিশ ভক্তির মাতাল তিনিও ছাড়ার পাত্র নয়, ”আপনার সব বেআইনি।” গিরিশের ভক্তির ভিতর এত দৃঢ়তা ও উন্মাদ ভাব দেখে সকলেই স্তব্ধ। তাঁদের হৃদয়তন্ত্রীতে তো একই কথা বাজে। তাঁরাও তো প্রত্যেকেই চায় সংসারের নিবৃত্তি কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের সে সামর্থ কোথায় যে নির্বাসনা হতে পারেন। কিন্তু সে শক্তি সমর্থ যদি ঈশ্বর স্বয়ং প্রদান করেন তবে তো হয়। পুরানো সংস্কার ত্যাগ করে নতুন সংস্কার সম্প্রসারণ করা যেন একপ্রকার সামর্থের বাইরে। যেমন দাবি করে স্বামীজিও বলেছেন, তিনি মনটিকে কাদার তালের মতো রূপ দিতে পারতেন। তিনিই অদ্বৈত, নিত্যানন্দ ও শ্রীচৈতন্য। তিনি পারেন জীবনের গতির পরিবর্তন করে দিতে মন শুদ্ধ করে তাকে সোনা তলোয়ার করে দিতে। সে দাবি যেমন গিরিশের, শম্ভুর, মহিমাচরণের, কালিপদের, মনির…তেমন আমাদের প্রত্যেকের।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৯: নিরুপমা দেবী— তাঁকে নিয়েই গল্প হোক!
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৮: কে আবার বাজায় বাঁশি
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “হ্যাঁ তা হতে পারে ভক্তি নদী ওথলালে, ডাঙ্গায় এক বাঁশ জল। যখন ভক্তি উন্মাদ হয় তখন বেদ বিধি মানে না। ভক্তি হলে আর কিছুই চাই না।” ভক্তির বিশ্বাসের আতিশয্যে গিরিশ বলছেন, ”তুমি আসবে আগে জানলে আরও বেশি করে অপচার করে নিতুম।” তার ভক্তির প্রগাঢ়ত্ব ও সর্বপরি গুরুর প্রতি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ, তাকে শিমুল বা কলা গাছ থেকে চন্দন গাছের মতো পরিবর্তন করে দিয়েছিল। গিরিশ বলছেন, ”মহাশয় কি বলব আপনাকে চিন্তা করে আমি কী ছিলাম, কী হয়েছি। আগে আলস্য ছিল, এখন সে আলস্য ঈশ্বরে নির্ভর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে পাপ ছিল, তাই এখন নিরহংকার হয়েছি। আর কী বলব!’
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।