শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


সর্বধর্ম সমন্বয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ।

রঙ্গ-রস প্রিয় শ্রীরামকৃষ্ণ সুযোগ সময় পেলেই বাক্যবাণে হাসি-মজার ফোয়ারা ছোটাতেন। একদিন ঠাকুর জিলিপি নিয়ে মেঝেতে বসেছেন। যেন অনেক কিছু খাবেন, কিন্তু একটু ভেঙে খেলেন মাত্র। বলছেন, “দেখছো আমি মায়ের নাম করি বলে এসব জিনিস খেতে পাচ্ছি।” সবায় এহেন রসিকতায় আনন্দ করছেন। আরও বর্ধিত হল সে আনন্দ। বললেন, “কিন্তু তিনি লাউ কুমড়ো ফল দেন না; তিনি অমৃত ফল দেন, জ্ঞান, প্রেম, বিবেক, বৈরাগ্য।”
শ্রীরামকৃষ্ণদেব গিয়েছেন কলকাতার শ্যামপুকুর পল্লীতে। শ্রী প্রাণকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি। এক্সচেঞ্জের বড়বাবু। নিলামের কাজ তদারক করেন। তিনি একটু স্থুলকায় ছিলেন বলে, ঠাকুর তাঁকে ‘মোটা বামুন’ বলে ডাকতেন। তিনি অতি সজ্জন ব্যক্তি। শ্রীশ্রী ঠাকুরের কাছে দক্ষিণেশ্বরে অনেক যাতায়াত ছিল। ঠাকুরও ওঁর বাড়িতে অনেকবার গিয়েছেন। সেই রকম এক দিন, ১লা জানুয়ারি, ১৮৮৩ সালে ঠাকুর গিয়েছেন। সেদিন তিনি জিলিপি নিয়ে বসছেন। কিন্তু হঠাৎ ঘরে ৬- ৭ বছরের একটি ছেলেকে আসতে দেখেন। এক ছেলে যেমন অন্য বালকের কাছ থেকে খাবার লুকিয়ে রাখতে চায় তেমন করে, শ্রীশ্রীঠাকুর, হাত দিয়ে জিলিপি ডাকছেন। বলছেন, “কলিতে অন্নগত প্রাণ, কলিতে নারদীয় ভক্তি।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৫২: শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন—যার সত্যনিষ্ঠা আছে, সেই-ই ভগবানকে পায়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩২: ইতিহাস ও বিজ্ঞানের আলোয় গঙ্গাসাগর মেলা

শ্রী প্রাণকৃষ্ণ বেদান্ত চর্চা করেন, ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’, ‘আমি সোঽহম্’ এক সকল তার ভাব। কিন্তু, শ্রীরামকৃষ্ণদেব জিলিপিতে হাত দিয়ে লুকাতে লুকাতেই সমাধিস্থ। যিনি ভক্তি রসের রসিক, যিনি বলেন, সা রে গা মা…নি তে বেশিক্ষণ থাকা যায় না, তিনি এখন জগত সংসার মায়া মোহ সমস্ত কিছু ফেলে সমাধিস্থ। এখন সেজে ভাবের বিষয় ভাব ব্যতীত ধরতে পারে! রসিক প্রিয়, শ্রীশ্রী জগতমাতার বালক রামকৃষ্ণ, এখন যেন আপনাকে আপনি থাকা।
আরও পড়ুন:

দেশের ও দশের জন্য নিবেদিত প্রাণ সুভাষ

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৮: হঠাৎ গলায় হাত দিয়ে দেখি কোনও অনুভূতি নেই!

সেদিন ঠাকুর প্রাণকৃষ্ণের বাড়িতে গিয়ে, অন্যান্য অনেক ভক্ত সঙ্গে সংসারের সুখ-দুঃখ, অশান্তি এ সকল নিয়ে কথা হচ্ছে। বলছেন “সংসার বিশালাক্ষীর দহ। নৌকা দহে একবার পড়লে আর রক্ষা নায়। সেঁকুল কাঁটার মতো এক ছাড়ে তো আর একটি জড়ায়। গোলকধান্দায় একবার ঢুকলে বেরোনো মুশকিল। মানুষ যেন ঝলসা পোড়া হয়ে যায়।” মুক্তির উপায়? ঠাকুর বলছেন, সাধুসঙ্গ আর প্রার্থনা। বৈদ্যের কাছে থাকলে যেমন নাড়ী জ্ঞান হয়, কোনটা কফের বা পিত্তের; সেরকম সাধুসঙ্গে জগতের স্বরূপ বোধ হয়। তখন সত্য পথ নির্বাচন করতে সুবিধা হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৬: কবির অসুখ-বিসুখ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬০: নতুন পথে রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন প্রানকৃষ্ণকে, “ব্রহ্ম শক্তি অভেদ। শক্তি না মানলে জগৎ মিথ্যা হয়ে যায়, আমি, তুমি, ঘরবাড়ি, পরিবার সব মিথ্যা। ওই আদ্যা শক্তি আছেন বলে জগৎ দাঁড়িয়ে আছে। কাঠামোর খুঁটি না থাকলে কাঠামোই হয় না। সুন্দর দুর্গা ঠাকুর -প্রতিমা হয় না। বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ না করলে চৈতন্য হয় না, ভগবানলাভ হয় না, বিষয়বুদ্ধি থাকলেই কপটতা হয়। সরল না হলে তাকে পাওয়া যায় না।”

কুমোরের কাঁচা হাঁড়ি, যেমন ভেঙে গেলে আবার তাকে নিয়ে তাল পাকিয়ে হাঁড়ি তৈরি করে, কিন্তু পোড়া হাঁড়ি ভেঙ্গে গেলে আর তা থেকে হাঁড়ি তৈরি করা যায় না; কুমোর ফেলে দেয়। তেমন যতক্ষণ ঈশ্বরদর্শন না হয় ততক্ষণ ফিরে ফিরে আসতে হয়। ঈশ্বর দর্শন হলে আর ফিরে আসতে হয় না। ঈশ্বর দর্শন যেমন সিদ্ধ বীজ, তা থেকে আর চারা হয় না।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content