
নারদীয় ভক্তি সূত্রে রয়েছে, যেখানে ভক্তির পরাকাষ্টা সেখানে প্রেম। যেখানে পথ এবং লক্ষ্য এক হয়ে যায়। ভক্তির সাধন, মন যখন ভগবানের জন্য ব্যাকুল হয়, তখনই শুরু করা যায়। ভক্তি পথ অন্য পথ সকল থকে সহজ। ভক্তি; “সা তু কর্ম জ্ঞান যোগেভ্যোঽপ্যধিকতরা”।
ভক্তির পথ—কর্ম, জ্ঞান ও যোগের থেকেও অধিকতর শ্রেষ্ঠ। ভক্তি, কর্ম, জ্ঞান ও যোগ সকল পথ সেই এক লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়। ভক্তিতে ভক্ত ভগবান লাভ করে; কর্মের দ্বারা কর্মী আত্মজ্ঞান লাভ করে; যোগ সাধনার দ্বারা যোগী সমাধিপথে পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়। জ্ঞানী বাহ্য জগতের অনিত্য দোষ দেখে, নিত্য শুদ্ধ ব্রহ্মকেই লাভ করে। সকল পথ, সকল সাধনা ভিন্ন ভিন্ন পথে এক অদ্বয় বস্তু কে-ই প্রাপ্ত হয়। তারা প্রত্যেকে অপৃথক অস্তিত্বকে লাভ করে। জন্মমরনাদি দুঃখের নিবৃত্তি হয়ে সে অখণ্ড আনন্দ লাভ করে। ঈশ্বরের প্রতি খুব ভালবাসা না হলে প্রেমা-ভক্তি হয় না। ঈশ্বরের প্রতি ‘আমার’ জ্ঞান না হলে তাঁকে লাভ হয় না।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তিন বন্ধু বন দিয়ে যাচ্ছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, তিন বন্ধু বন দিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪৪: ব্রহ্মের শক্তি জীবকে মুক্তি দান করে

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’
হঠাৎ এক বাঘ এসে উপস্থিত। একজন বললে ভাই আমরা সব মারা গেলাম। একজন বললে, কেন? এসো আমারা ঈশ্বরকে ডাকি। আর একজন বললেন, তাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে? এস আমারা এই গাছে উঠে পড়ি। যে লোকটি পড়লে আমরা মারা গেলাম, সে জানে না যে ঈশ্বর রক্ষা কর্তা। যে বলে এসো ঈশ্বরকে ডাকি সে জ্ঞানী। তার বোধ আছে, যে ঈশ্বর সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় করেন। আর যে বললে, তাকে কষ্ট দিয়ে কি হবে? এসো গাছে উঠে পড়ি। তার ভেতরে প্রেম জন্মেছে। ভালোবাসা জন্মেছে। তা প্রেমের স্বভাবই এই। আপনাকে বড় মনে করে। আর প্রেমের পাত্রকে ছোট মনে করে। পাছে তার কষ্ট হয় কেবল এক চিন্তা। এই ইচ্ছে যে, যাকে সে ভালবাসে তার গায়ে কাটাটি পর্যন্ত না ফোটে।
প্রকৃত প্রেম তখনই হয়, ভগবান যাদের ভালোবাসেন, যখন তাদের জন্যও ভালোবাসা হয়। তিনি তা দেখে খুশি হন, প্রীত হন। দ্বেষ শূন্যতা প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ। কলিযুগে পক্ষে ভক্তিযোগ। সহজে ভগবৎ তন্মতা লাভ করা যায়। ভগবানের নাম গুন-গান আর প্রার্থনা।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৩: টাকির ভাসানের ব্যথা

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২১: সুন্দরবনের সর্পদেবী মনসা
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ভক্তিযোগ-ই যুগও ধর্ম।” ঈশ্বর বড় চুম্বক আর ভক্ত ছোট চুম্বক। ভগবান ভক্তকে টেনে নন। ভগবান চুম্বকের পাহাড়, ভক্তি বিশ্বাস হল টান আর, তার পাশ দিয়ে জীব রূপ জাহাজ যাওয়ার সময় তার লোহার স্ক্রু সকল আলগা হয়ে গেল। জাহাজের আঁট সব ফুলে গেল। বন্ধন আর থাকলো না। তেমন ভক্ত ভগবানের কাছে যাওয়া মাত্র সব বন্ধন আলগা হয়ে যায়। সমস্ত গ্রন্থি আলগা হয়ে যায়। ভগবান ভক্তের সমস্ত বন্ধন খুলে নিজের কাছে টেনে নন। জীব মাত্রই বাসনা যুক্ত হয়েই আছে, যা দেহীকে দেহের সঙ্গে যুক্ত করে রাখে। ভগবান সেই দেহ ও দেহীর বন্ধন আলগা করে দেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এক কঠিন সমস্যার সমাধান করছেন সহজ উপায়ে। জাতি ভেদভাবনা এ জাগতের চিরকালের সমস্যা ও দ্বন্দ্বের থেকে অবসানের একমাত্র উপায়, “একমাত্র উপায়ে জাতিভেদ উঠতে পারে সে উপায় ভক্তি। ভক্তের জাতি নেই। ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা সব শুদ্ধ হয়। গৌর নিতাই হরিনাম দিতে লাগলেন আর আচণ্ডালে দিলেন। ভক্তি না থাকলে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ নয়; ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়। ভক্তি তে পবিত্র হয়,শুদ্ধ হয়।” ভক্তিই সার। ভক্তি লাভ হলে তো ভগবানকেই লাভ হল। ভক্তি ঈশ্বরের প্রিয়। বিদূরের ভক্তির কারণে ভগবান তার বাড়িতে গেলেন। তিনি ভক্ত ও ভক্তি প্রিয়। ভগবানকে শুধুমাত্র বিচারের দ্বারা পাওয়া যায় না। বিচার যেখানে শেষ সেখান থেকে ভক্তি বিশ্বাস শুরু।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৪: পানমশলা খেলে ক্যানসার হয়?

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৫: দেবদেউল কথা ও গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির
স্বামীজি ৩১ জুলাই ১৮৯৫ সহস্রদ্বীপোদ্যান এ বলছেন, “ভক্তিযোগের বিশেষ প্রয়োজন এই যে অপকটভাবে ও প্রবলভাবে ঈশ্বরের অভাব বোধ করা। আমরা ঈশ্বর ছাড়া আর সবই চাই। কারণ এই জগত থেকেই আমাদের সাধারন সব বাসনা পূরণ হয়ে থাকে। যতদিন আমাদের প্রয়োজন বা অভাববোধ জড় জগতের ভেতরেই সীমাবদ্ধ, ততদিন আমরা ঈশ্বরের জন্য কোনও অভাব বোধ করি না। কিন্তু যখন আমরা এই জীবনের চারিদিকে থেকে প্রবল ঘা খেতে থাকি আর ইহ জগতের সকল বিষয়েই হতাশ হই তখনই উচ্চতর কোন বস্তুর জন্য আমাদের প্রয়োজন বোধ হয়ে থাকে। তখনই আমরা ঈশ্বরের অন্বেষণ করে থাকি।”
ভক্তির পীড়া, এমন এক বিষম অস্থিরতা উদিত করে যে ভক্তের অন্তর অভিমান দগ্ধ হতে থাকে । সেই তাপে তৈরি হতে থাকে আনন্দ অমৃত। ভক্ত চাইলেও আর দহন পীড়া ত্যাগ করে না পরন্তু এগিয়ে চলে অমৃতের সন্ধানে।
ভক্তির পীড়া, এমন এক বিষম অস্থিরতা উদিত করে যে ভক্তের অন্তর অভিমান দগ্ধ হতে থাকে । সেই তাপে তৈরি হতে থাকে আনন্দ অমৃত। ভক্ত চাইলেও আর দহন পীড়া ত্যাগ করে না পরন্তু এগিয়ে চলে অমৃতের সন্ধানে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।