শ্রীরামকৃষ্ণ।
যখন সর্বত্র ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ উপস্থিত বর্তমান, যখন শাস্ত্র আমিও ঈশ্বর, তুমিও ঈশ্বর, সব-ই ঈশ্বর বলে নির্দেশিত করে, তবে প্রতিমাতে কী প্রয়োজন? আমরা সকলেই ঈশ্বরের প্রতিমা? কে কাকে পুজো করে! শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “প্রতিমা পুজোতে দোষ কি? বেদান্ত বলে যেখানে অস্থি, ভাতি আর প্রিয় সেইখানেই তার প্রকাশ। তাই তিনি ছাড়া কোনও জিনিসই নাই।”
যা সদা বিরাজমান, যা অপরিবর্তনীয়, যা অহং প্রকাশ করে, যা সৎ স্বরূপ আর যা সর্বদা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা গ্রহণীয় হয়, যা চিৎ রূপে প্রকাশিত আর, যা আনন্দ স্বরূপ প্রিয়। ভিন্ন রূপে প্রকাশিত এক সত্য।
“ব্রহ্ম সত্যং জগৎ মিথ্যা, জীব ব্রহ্মৈব না পরঃ”
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪৩: তুমিই আমি, আমিই তুমি—ইহাই তোমার স্বরূপ প্রকাশ করে, তোমাকে পবিত্র হইতে হইবে না…
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১২: ওই স্মৃতি ভুলতে কি আর পারি…
সিঁড়ির ধাপ পেরিয়ে গিয়ে ছাদে উঠে দেখার মতো যে যা দিয়ে তা দিয়ে ছাদ। তখন ভেদ শূন্য হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “দেখো মেয়েরা পুতুল খেলা কত করে যতদিন না বিবাহ হয়। আর যতদিন না স্বামী সহবাস করে। বিবাহ হলে পুতুলগুলি পেটরায় তুলে ফেলে। ঈশ্বর লাভ হলে আর প্রতিমা পুজোর কি দরকার?” যা কিছু বাহ্যিক আচরণ তা তাঁকে স্মরণ, মনন করার জন্য। তাঁর সাথে সখ্যতা স্থাপনের জন্য। তাঁকে ভালোবাসার জন্য। তাঁকে ডাকার জন্য।
“অনুরাগ হলে ঈশ্বর লাভ হয়, খুব ব্যাকুলতা চাই। খুব ব্যাকুলতা হলে সমস্ত মন তাঁতে গত হয়। একজনের এক মেয়ে ছিল। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই মেয়েটি বিধবা হয়ে গিয়েছিল। স্বামীর মুখ কখনও দেখে নাই। অন্য মেয়ের স্বামী আছে দেখে। সে একদিন বললে—বাবা, আমার স্বামী কই? তার বাবা বললে—’গোবিন্দই তোমার স্বামী। তাকে ডাকলে তিনি দেখা দেন। মেয়েটি ওই কথা শুনে ঘরে দ্বার দিয়ে গোবিন্দকে ডাকে আর কাঁদে—বলে, গোবিন্দ! তুমি এসো, আমাকে দেখা দাও, তুমি কেন আসছ না। ছোট মেয়েটির সেই কান্না শুনে ঠাকুর থাকতে পারলেন না, তাকে দেখা দিলেন।”
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৩: এক্সপায়ারি ডেটের ওষুধ খাবেন?
পরিযায়ী মন, পর্ব-১২: নেতারহাটের নাশপাতি বাগান
ঈশ্বর দেখেন ঐকান্তিক ভক্তি প্রেম। তাঁর জন্য সরল ভাবে আত্ম সমর্পণ, যা কিছু আবশ্যক সব তিনিই জুটিয়ে দেন। বালকের মতো বিশ্বাস আর বালক যেমন মাকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয় সেই রূপ ব্যাকুলতা। সংশয় বিহীন আকুল আগ্রহ। একজন শ্রীরামকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন—একজন জিজ্ঞাসা করলে ওহিক আর পারত্রিক কি তফাৎ? “সাধনের সময় নেতি নেতি করে ত্যাগ করতে হয়। তাকে লাভের পর বোঝা যায় তিনি সব হয়েছেন। যখন রামচন্দ্রের বৈরাগ্য হল দশরথ বড় ভাবিত হয়ে বৈশিষ্ট্য দেবে শরণাগত হলেন, যাতে রাম সংসার ত্যাগ না করেন। বশিষ্ঠ বললেন—রাম, তুমি সংসার ত্যাগ করবে কেন? সংসার কি তিনি ছাড়া? আমার সঙ্গে বিচার কর। রাম দেখলেন, সংসার সেই পরমব্রহ্ম থেকেই হয়েছে—তাই চুপ করে রহিলেন।”
সত্য স্বরূপ ঈশ্বরকে যিনি উপলব্ধি করেছেন তিনি জ্ঞানী, আর যিনি তার উপস্থিতি সকলের মধ্যে উপলব্ধি করেন তিনি বিজ্ঞানী। জগৎ ব্রহ্মে অনুসৃত। সৃষ্টি, স্থিতি, লয় যা কিছু সব কিছু তাতেই। যেমন যে জিনিস থেকে ঘোল সেই জিনিস থেকে মাখন। তখন গোলেরই মাখন, মাখন এরই ঘোল। অনেক কষ্টে মাখন তুললে অর্থাৎ ব্রহ্ম জ্ঞান হলে তখন দেখে যে মাখনের মধ্যে ঘোলই আছে। মাখন যেমন এই জীবজগৎ, চতুর্বিংশতি তত্ত্ব, আছে। সাধনা করলে বোঝা যায় ওহিক ভাবে জগৎ যেমন সত্য পারমাত্রিক রূপে ব্রহ্ম সত্য। জগত সত্য সমস্ত কিছু ব্রহ্ম দ্বারা যখন আচ্ছাদিত। ওহিকের জাগতিক ভাব ত্যাগ করলে পারমার্থিক সত্য প্রতিত হবে। শ্রীরামকৃষ্ণ একে বিজ্ঞানীর অবস্থা বলেছেন।
আরও পড়ুন:
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২১: আমার চোখে তো সকলই শোভন
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…
যে জগৎ মিথ্যা বলে সাধক ত্যাগ করে; সেই জগতে ব্রহ্ম রূপ সর্বত্র প্রসারিত দেখে, ঈশ্বরের এক একটি রূপ বিগ্রহ ধারণ করেছে দেখে, বিভেদ শূন্য হয়ে চৈতন্যের প্রকাশ দেখা যায়। দেখে অদ্বৈত ভাবের পূর্ণ প্রকাশ। যে শক্তি মায়া রূপে প্রতিভাত হচ্ছিল, সেই ব্রহ্মের শক্তি, জীবকে মুক্তি দান করে। সেই শক্তি, জ্ঞান লাভের সহায়ক হয়ে পরম সত্য ও আনন্দ লাভে সাহায্য করে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।