সংস্কার সম্বন্ধে সর্বদাই অনেক কথা হয়। মানুষের পূর্ব জন্মের বা এ জন্মের কর্ম সব একে একে সঞ্চিত হয়ে সংস্কার তৈরি করে। সংস্কারবশত ভালো বা মন্দ কত কর্মই না হতে থাকে। তার পরিবর্তন বা মোড় ফেরানো খুব শক্ত। যেমন রসুনের গন্ধ বারবার ধোয়া সত্ত্বেও যেতে চায় না। অনেক সাধ্য সাধনা করলে তবে নতুন সংস্কার তৈরি হয় বা পুরানো সংস্কার মুছে ঈশ্বরের মন যায়। কর্মযোগ বা ভক্তিসাধনা মানুষে সেই সংস্কার তৈরি করে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা করে। অনেকে ধর্ম আচরণ করে, সাধন করে কিন্তু কিছুতেই কাম-বাসনা যেতে চায় না। ইন্দ্রিয়ের উগ্র আস্ফালন সর্বদাই রয়েছে।
একটি গল্প আছে, একজন একটি কুকুর পুষে ছিল, দিনরাত তাকে নিয়ে থাকত। কোলে করত, তাকে আদর করত, কখনও মুখে মুখ দিয়ে বসে থাকত। পরে একজন বিজ্ঞ লোক তাকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দিলে কুকুরকে অত আদর দিতে নেই। পশুর জাত কোন দিন আদর করতে করতে ফট করে কামড়ে দেবে ঠিক নাই। সে সেই কথা বুঝতে পেরে আর কখনও তাকে কোলে নেবে না প্রতিজ্ঞা করলে। কিন্তু কুকুরটা তা বুঝে না। সে তাকে দেখলেই দৌড়ে যায়, কেলে উঠতে চায়। কয়েকদিন কোলে উঠতে আসলেই তাকে মারতে তবে সে নিরস্ত হয়।
একটি গল্প আছে, একজন একটি কুকুর পুষে ছিল, দিনরাত তাকে নিয়ে থাকত। কোলে করত, তাকে আদর করত, কখনও মুখে মুখ দিয়ে বসে থাকত। পরে একজন বিজ্ঞ লোক তাকে ধমক দিয়ে বুঝিয়ে দিলে কুকুরকে অত আদর দিতে নেই। পশুর জাত কোন দিন আদর করতে করতে ফট করে কামড়ে দেবে ঠিক নাই। সে সেই কথা বুঝতে পেরে আর কখনও তাকে কোলে নেবে না প্রতিজ্ঞা করলে। কিন্তু কুকুরটা তা বুঝে না। সে তাকে দেখলেই দৌড়ে যায়, কেলে উঠতে চায়। কয়েকদিন কোলে উঠতে আসলেই তাকে মারতে তবে সে নিরস্ত হয়।
মানুষের ইন্দ্রিয় সকলেরও ওই দশা। এতকাল আদর যত্নে লালিত পালিত হয়েছে, এত সহজে ছাড়ে। অনেক যত্নে সাধনায় তাকে বশে আনতে হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “মানুষের দেহটা যেন হাঁড়ি আর তার মন, বুদ্ধি প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গুলো যেন জল, চাল, আলু সকল। হাড়ির ভিতর জল, চাল, আলু দিয়ে তার নিচে আগুন জ্বেলে দিলে যেমন তেতে উঠে এবং তাদের গায়ে হাত দিলে যেমন হাত পুড়ে যায় অথচ সে শক্তিটা তাদের নয় আগুনের। সেই রকম মানুষের ভিতরে ব্রহ্মশক্তি যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ মানুষের মন, বুদ্ধি প্রভৃতি কার্য করে। সেই শক্তির অভাব হলে কার্য করতে পারে না।”
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৪১: ব্রহ্মই ঈশ্বর রূপে আমাদের জীবনের পথ দেখান
ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৪: মধুপুর ধাম, বাণেশ্বর মন্দির ও ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির
বিষয় তৃষ্ণা যেমন ইন্দ্রিয়গুলিকে কর্মে নিযুক্ত করে। অহংকার ‘আমি’র বশে মানুষ কর্ম করে, ফল ভোগ করে, ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সাধক যেমন অহংকার ত্যাগপূর্বক উপলব্ধি করে এ জগতের সমস্ত শক্তির উৎস সেই এক চৈতন্য শক্তি, এ জগত তাঁর চৈতন্যে চৈতন্যবান, তখন সে সম্পূর্ণ নিরাশক্ত হয়ে, তার উপর নির্ভরশীল হয়ে কালাতিপাত করে। বাড়ির ছাদের জল যেমন বাঘ, সিংহ বা হাতি প্রভৃতি মুখাকৃতির মধ্য দিয়ে পড়ে। কিন্তু সে জল তাদের নয়, বৃষ্টির জল বা ছাদের জল, তেমনই ধর্ম আচরণ মানুষকে ধার্মিক করে। আস্তে আস্তে সাধনায় উত্তীর্ণ হন। যদি নির্জনে ও সকলের অসমক্ষে ভগবান দেখছেন এ ভাবে ধর্ম আচরণ করে, তিনি ধার্মিক।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর
পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়
ভিজে দেশলাই যেমন জ্বালানোর জন্য অনেকবার ঘষতে হয়, তেমন আবার শুকনো দেশলায় একবার ঘষলেই জ্বলে ওঠে। তেমন ভক্ত ভগবত প্রসঙ্গ হওয়া মাত্র প্রেমাগ্নিতে জ্বলে ওঠে কিন্তু বিষয়ীর সাথে হাজার ভগবত প্রসঙ্গ করও কিছুতেই কিছু হয় না। ভক্তের ভাবের শেষ হয় না। ভগবানও তেমন। কেউ তার দিকে একটু আগে আসলেই তিনি ভক্তের জন্য তিনি এগিয়ে আসেন। যেমন মহাজনের গোলাতে ধান চাল মাপে তখন মেয়েরা ধামা ধামা করে চাল, ডাল এগিয়ে দেয়। তেমন ভগবান ভক্তের ভাব এগিয়ে দেন।
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?
রাক্ষসের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ঢুকে গেলেন বেতারকেন্দ্রে
স্বামীজীর ভক্তির লক্ষণ প্রবন্ধে, বিষ্ণুপুরাণ থেকে উদ্ধৃতি করে বলেছেন, “যা প্রীতি বিবেকানাং বিষয়েষ্বনপায়িনী। ত্বামনুস্মরতঃ সা মে হৃদয়ান্মাপসর্পতু।।” অজ্ঞলোকের ইন্দ্রিয় বিষয়ে যে রূপ তীব্র আগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় তোমাতে স্মরণ করবার সময় আমার তোমার প্রতি সেই রূপ তীব্র আসক্তি যেন আমার হৃদয় হতে অপ্রসারিত না হয়।” আসক্তি কার জন্য? আসক্তি ঈশ্বরের জন্য, যা পেলে আর পাওয়ার কিছু আর অবশিষ্ট থাকবে না। শান্ডিল্য সূত্রে তিনি ‘অনুরক্তি’ বলেছেন। তার মানে, ভগবানের স্বরূপ ও মহিমা জ্ঞানের পর তাহার প্রতি যে আসক্তি তাই ভক্তি। স্বামীজি বলছেন, “সাধারণ পূজা পাঠাদি হতে আরম্ভ করে ঈশ্বর প্রগাঢ় অনুরাগ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক অনুভূতির জন্য চেষ্টা পরম্পরার নাম ভক্তি।” দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে ঈশ্বরে সর্মপণ করলে ভক্তি মুক্তি দুই লাভ হয়।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।