
ঈশ্বর কোথায় থাকেন? তিনি সর্বত্রই থাকেন। তবে, তাঁর প্রকাশ অযাচিত প্রেম যেখানে। তিনি আছেন তাঁর প্রকাশ ফেলিয়ে। যদিও শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন, “সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। বিষয় বুদ্ধি থেকে ঈশ্বর অনেক দূরে। বিষয় বুদ্ধি থাকলে নানা সংশয় উপস্থিত হয়। আর নানা অহংকার এসে পড়ে। পাণ্ডিতের অহংকার, ধনের অহংকার এইসব।” যেমন নিমন্ত্রিত ছেলে আর বাড়ির ছেলে। দুটি ছেলে। কিন্তু দুইয়ের ভাবের তফাত। সেই রূপ শুদ্ধ জ্ঞান ও শুদ্ধা ভক্তি। এক হইলেও জ্ঞানী যেন নিমন্ত্রিত ছেলে আর ভক্ত যেন বাড়ির ছেলে। “বালকের ন্যায় বিশ্বাস না হইলে ঈশ্বর লাভ করা যায় না। মা বলছেন, ও তোর দাদা হয়। বালকের এমনই বিশ্বাস ও আমার ষোল আনা দাদা। মা বলছেন, ওখানে জুজু আছে। বালকের বিশ্বাস যে, ওখানে সত্য সত্যই জুজু আছে। ওই রূপ বালকের ন্যায় বিশ্বাস দেখিলে ঈশ্বরের দয়া হয়। সংসারী বুদ্ধিতে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।” বলছেন ঠাকুর।
তিনি সাংসারিকতা থেকে দূরে। যেখানে হিংসা, বিদ্বেষ, রাগ, অস্মিতা ইত্যাদি সকল রয়েছে তিনি তখন দূরেই থাকেন। তিনি কারও বশ নন। তিনি প্রেমের বশ। যিনি আপন বোধে বোধ করেন তিনি তারই হয়ে যান। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি গল্প বলেছেন, “জটিল বালক রোজ বনের পথ দিয়ে একলা পাঠশালায় যেতে বড় ভয় পেতো। মাকে ভয়ের কথা বলাতে, মা বললে ভয় কি তুই রোজ মধুসূদনকে ডাকবি। বালকটি বললে মধুসূদন কে? মা বললে, মধুসূদন তোমার দাদা হয়। বালকটি নির্জনে পথে যেতে যেতে যেই ভয় পেয়েছে, এমনি মার কথা স্মরণ করে ‘দাদা মধুসূদন’ বলে ডাকতে লাগলো। কারও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। যখন বালকটি কোথায় দাদা মধুসূদন আছ, এসো আমার বড় ভয় পেয়েছে, যেই কাঁদতে লাগলো, তখন ঠাকুর আর থাকতে পারলেন না। এসে বললেন, ”এই যে আমি, তোমার ভয় কী। তুমি যখন ডাকবে তখনই আসবো” বলে সঙ্গে করে পাঠশালার রাস্তায় পৌঁছে দিলে।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৯: প্রথম প্রথম ভগবান ভক্তকে আকর্ষণ করেন, পরে ভক্তের টানে আসেন ভগবান

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৯: অনেক যতনে ‘বড়দিদি’-র পর্ব রাখিনু সেথা
তিনি তার সন্তানকে দেখেন, রক্ষণাবেক্ষণ করেন, সরল বুদ্ধিতে যিনি তার কাছে প্রার্থনা করেন তিনি তাকে পূর্ণ করেন। তাঁর শরণাগতের কখনও বিনাশ হয় না। তাঁর শরণাপন্ন হয়ে পড়ে থাকা সত্য। এই জগত সংসার থেকে যিনি উপরে, তার কাছে তিনি আসেন। সাংসারিকতা থেকে তো হওয়া যায় না। সংসারে থাকলে ক্ষতি নাই, সংসার যেন মধ্যে না থাকে। নৌকা জলে থাকে কিন্তু নৌকায় জল থাকলে ডুবে যাবে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৬: সুন্দরবনের লৌকিক দেবতা পঞ্চানন্দ বা বাবাঠাকুর

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’
শ্রীকৃষ্ণের উক্তি, গীতায় অষ্টাদশ অধ্যায়ে আছে, “মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু। মামেবৈষ্যসি সত্য তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে।।” তুমি মন্মনা, মদ্ভক্ত, মদ্ যাজী, হও। আমাকে নমস্কার কর। তা হলে আমাকেই প্রাপ্ত হবে। ইহা আমি তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি, তুমি আমার প্রিয়।
শ্রীবিষ্ণুপুরাণে আছে যে, “যে অচ্যুতে বুদ্ধি অর্পণ করলে অর্থাৎ যাঁকে চিন্তা করলে লোকে নরকে যায় না। যাঁকে চিন্তা করলে স্বর্গও বিঘ্ন বলে বোধ হয়, যাতে মনোনিবেশ করলে ব্রহ্মালোকও তুচ্ছ হয়ে যায়, অব্যয় স্বরূপ যিনি চিত্তে থাকলে নির্মল-চিত্ত মনুষ্যগণকে মুক্তি প্রদান করেন-সেই অচ্যুতের কীর্তন করলে যে পাপ বিলীন হয়ে যায়-তাতে আর আশ্চর্য কী?”
শ্রীবিষ্ণুপুরাণে আছে যে, “যে অচ্যুতে বুদ্ধি অর্পণ করলে অর্থাৎ যাঁকে চিন্তা করলে লোকে নরকে যায় না। যাঁকে চিন্তা করলে স্বর্গও বিঘ্ন বলে বোধ হয়, যাতে মনোনিবেশ করলে ব্রহ্মালোকও তুচ্ছ হয়ে যায়, অব্যয় স্বরূপ যিনি চিত্তে থাকলে নির্মল-চিত্ত মনুষ্যগণকে মুক্তি প্রদান করেন-সেই অচ্যুতের কীর্তন করলে যে পাপ বিলীন হয়ে যায়-তাতে আর আশ্চর্য কী?”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?
রথযাত্রার দিন শ্রীশ্রী মায়ের সঙ্গে সেই ইন্দুভূষণ সেনগুপ্তের কথা হচ্ছে। তিনি শ্রীমাকে বলছেন, ”মা তোমার কৃপা পেয়েছি, এই আমার বল ভরসা।” শ্রীমা বলছেন, “তোমার চিন্তা কী তুমি আমার অন্তরে রয়েছো। কোনও অভাব, প্রয়োজনে তোমাদের কথা মনে উঠে-ইন্দু টিন্দু রয়েছে। ভাবনা কী তোমার কিছু করতে হবে না। তোমার জন্য আমি করছি।” ইন্দুভূষণ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ”তোমার যেখানে যত সন্তান আছে সকলের জন্যই তোমার করতে হয়?” শ্রীমা বললেন, “সকলের জন্যই আমায় করতে হয়।” ইন্দুভূষণ আবার জিজ্ঞেস করলেন, ”এত ছেলে রয়েছে, সকলকে তোমার মনে পড়ে?” শ্রীমা বললেন, “না, সকলকে মনে আসে না।” ইন্দুভূষণ, বললেন, ”তবে যে বললে তুমি সকলের জন্যই করে থাকো।” শ্রীমা, “যার যার নাম মনে আসে তাদের জন্য জপ করি, আর যাদের নাম মনে না আসে তাদের জন্য ঠাকুরকে এই বলে প্রার্থনা করি, ঠাকুর, আমার অনেক ছেলে অনেক জায়গায় রয়েছে। যাদের নাম আমার মনে হচ্ছে না তুমি তাদের দেখো। তাদের যাতে কল্যাণ হয় তাই করো।” ঈশ্বর সব জায়গাতে আছেন, তবে সরল ভক্তি বিশ্বাস হৃদয়ে তিনি প্রকট আছেন। তিনি মুর্ত শরীর, তিনি প্রেমের শরীর ধারণ করে অবতীর্ণ হন, জগতের কল্যাণের জন্য। তিনি নিজে পীড়া সহন করেন যাতে অন্যেরা কষ্ট কম পায়। জগতের দুঃখ থেকে আত্যন্তিক মুক্তি দেন।—চলবে।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।