শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও মা সারদা। ছবি: সংগৃহীত।

ঈশ্বরের সব ধারণা কি অনুভব করা যায়?

তাঁর বিরাট ভাবের ধারণা সবাই অনুভব করতে পারে না। সব ধারণা অনুভব করার দরকারই বা কী? প্রত্যক্ষ করতে পারলেই তো হল। তবে তার অবতারকে দেখা মানেই তাঁকে দেখা হল। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “গঙ্গার জল, গঙ্গার কাছে গিয়ে স্পর্শ করে বল গঙ্গাদর্শন ও স্পর্শন করে এলুম। সব গঙ্গাটা হরিদ্বার থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত স্পর্শ করতে হয় না। যদি সাগরের কাছে গিয়ে একটু স্পর্শ কর, তাহা হলে সাগর স্পর্শ করা হল। সেই রূপ অবতরকে দেখলে ঈশ্বর দর্শন করা হয়। অগ্নির দ্বারিকা শক্তি সকল জায়গায় আছে তবে কাজটিতে বেশি ভগবান সকলখানেই আছেন। তবে তার শক্তি কোথাও বেশি কোথাও কম প্রকাশ অবতারের ভিতর তার শক্তি বেশি প্রকাশ।”
একজন আরেক জনকে চিঠি লিখেছিল, পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড় পাঠাবেন। সে চিঠি পড়ে পাঁচ সের সন্দেশ ও একখানা কাপড় মনে করে রাখলে ও চিঠি ঠিকানা ফেলে দিলে আর চিঠির দরকার নাই। শাস্ত্রাদি পাঠও সেইরূপ। শাস্ত্রে সাধন প্রণালী রয়েছে। শাস্ত্র পথ নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী আচরণ করলে জ্ঞান বা ভক্তিলাভ হয়। ঈশ্বরের দর্শন হয়। শাস্ত্র ঈশ্বরের দর্শন করিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু তা পালনে বা উপদেশের দ্বারা ঈশ্বর লাভ হয়। সাধন দ্বারা তাঁকে লাভ করতে হয়।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৭: যতক্ষণ অহংকার, ততক্ষণ কর্ম ভোগ, অহংকার পুড়ে গেলেই কর্মযোগ

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

শ্রীশ্রী ঠাকুর বলছেন, “পাঁজিতে বিশ আড়া জল লেখা আছে, কিন্তু পাঁজি নিংড়লে জল পড়ে না। সিদ্ধি সিদ্ধি বললে নেশা হয় না। বেটে খেতে হবে। তবে নেশা হবে।” সাধনের দ্বারা তাঁকে লাভ হয়। তাঁর কৃপা বাতাস সব সময় বইছে। কিন্তু গ্রহণ করার উপযুক্ত হতে হবে। তবে তাঁরা কৃপা হয়। শুধু, তিনি আছেন, তিনিই দেখবেন, বললে হয় না। সোনার গহনা গড়তে হলে কত কষ্ট করতে হয়। আগুনে পোড়াতে হয় ছাঁচে ঢালতে হয়। ঠান্ডা করতে হয়। তবে তো গহনা তৈরি হয়।

অবতার পুরুষেরা আসেন সেই প্রণালী দিয়ে দেখিয়ে দেন যাতে সহজে ঈশ্বর লাভ করা যায়। তাঁকে দেখে ভগবানের কথা মনে পড়ে, তাঁর করুণার কথা মনে হয়। যেমন মাটি তৈরি ফল দেখে আসল ফলের কথা মনে হয়। যত সাধন করা যায় তত ঈশ্বরের ভাব শরীর প্রবেশ করে। যতটা চিন্তা করা যায় তাঁর সত্ত্বা প্রবেশ করে। তৎ-ময় হয়ে যায়। গোপিনীদের সেই অবস্থা হয়েছিল।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১১: দেব-দেউল কথা ও মদনমোহন মন্দির

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’

“পুস্তক হাজার পড়, মুখে হাজার শ্লোক বল, ব্যাকুল হয়ে তাঁকে না ডুব না দিলে, তাঁকে ধরতে পারবে না।” শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “যেমন নদীর গতি সাগরের দিকে কিন্তু মানুষ খাল কেটে অন্যদিকে লয়ে যায়। তেমন আত্মার গতি ভগবানের দিকে কিন্তু জীব কাম কাঞ্চন রূপ খাল কেটে অন্যদিকে রয়ে যায়।” কামনাবাসনা আমাদের কর্মকে পরিচালিত করে। ভালো কর্ম, ভালো মন্দ কর্ম, মন্দ ফল দেয়। কিন্তু দুই বন্ধন তৈরি করে।

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর ‘অবতার’ বক্তৃতায় বলছেন, “যুক্তি মূলক ধর্মের সর্বনিম্ন স্তর দ্বৈত ভাব। আর একের মধ্যে তিনের অবস্থিতিই উচ্চতম। জগৎ ও জীব ঈশ্বরের দ্বারাই অনুস্যূত। ঈশ্বর জগৎ এবং জীব এই ‘একের মধ্যে তিন’ কেই আমরা দেখছি। আবার সঙ্গে সঙ্গে আভাস পাচ্ছি যে, এক থেকেই এই তিনটি হয়েছে। এই দেহটি যেমন জীবাত্মার আবরণ, তেমনি এই জীবাত্মা যেন পরমাত্মার আবরণ বা দেহ। ‘আমি’ যেমন বিশ্ব প্রকৃতির চেতন আত্মা, তেমনি ঈশ্বর আমার আত্মারও আত্মা-পরমাত্মা। তুমিই হচ্ছ সেই কেন্দ্র, যার মাধ্যমে তুমি বিশ্ব প্রকৃতিকে দেখছ, আবার তার মধ্যেই তুমি রয়েছ। জীব, জগৎ আর ঈশ্বর এই নিয়েই একটি সত্তা নিখিল বিশ্ব। সুতরাং, এগুলি মিলে একটি একক। তথাপি একই কালে এগুলি আবার পৃথক বটে।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২২: কামুক পুরুষের সঙ্গ ছাড়া একজন নারীও একা কোনও দুষ্কর্মে লিপ্ত হতে পারে না

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

“অবতার পুরুষকে সকলই কি ধরতে পারে? দু’ একজন চিনতে পারে মাত্র। তাঁরা জীব উদ্ধারের জন্য কত যতনাই না সহ্য করেন। ঠাকুরের গলা দিয়ে রক্ত বের হতো, তবু কথার বিরাম নেই। কিসে জীবের মঙ্গল হয়।” শ্রীশ্রী মা বলছেন। বাস্তবিক, শ্রীশ্রী মায়ের জীবনী দেখলে বোঝা যায়, কী কষ্ট না সহ্য করেছেন! আত্মীয়দের কাছ থেকে কত কষ্ট পেয়েছেন। সকলে এক যোগে মাকেই আধার মানত, আবার প্রত্যাশা করত। তার মধ্যে কখনও অসন্তোষ ছিল না। অবতার আসেন যেন অনেক খেটেখুটে যুগোপযোগী সংসার রোগের নিরাময়ের জন্য একটি মলম তৈরি করেন। সেই মলম যেন ওই কালের সংসার রোগের একমাত্র ঔষধ।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content