১৯১০ সালে জয়রামবাটিতে সাধন-ভজন প্রসঙ্গে মা জনৈক ত্যাগী ভক্তকে বলেছিলেন, “সন্ধেবেলায় বসবে আর মাথা ঠান্ডা রেখে জপ ধ্যান করবে। এর চেয়ে মাটি কোপানো সোজা কাজ।” ঠাকুরের ছবির দিকে দেখিয়ে বললেন, “ওর কৃপা না হলে কিছুই হবে না।” আশ্রমের কাজে ব্যস্ত থাকার জন্য নিয়মিত জপ ধ্যান বিঘ্ন ঘটিতে পারে, এ কথায় মা বললেন, “কাজ আর কার? কাজ তো তাঁরই।” প্রসঙ্গক্রমে এও বললেন, “এরপর মনই গুরুর হয়ে উপদেশ দেবে।”
শ্রীশ্রীমার ভাবনার প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমরা যা কিছু কাজ করি, শ্রীশ্রী ঠাকুরের কাজ জ্ঞান করে করা। তখন কাজের প্রতি নিষ্ঠা আসে। কিন্তু কাজ করতে করতে কাজের প্রতি আসক্তি ও ফলপ্রাপ্তির ইচ্ছা আমাদের ভুলিয়ে দেয়, প্রকৃত কাজের উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য ছিল, নিরাশক্ত হয়ে কর্ম থেকে বেরিয়ে আসা। কর্ম করতে করতে চিত্ত শুদ্ধি ও মুক্তি। কিন্তু তা কখনও বন্ধনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় যখন আর, কর্মের সঙ্গে জুড়ে যাই আর ছাড়তে পারি না। অনেক ক্ষেত্রে আবার বাহানা দিই, ঠাকুরের ইচ্ছায় কর্ম। কাজ করতে করতে আমাদের দেখতে হবে নিরাসক্ত হচ্ছে কি না, আর মনের শুদ্ধিকরণ হচ্ছে কি না এবং শান্তি আসছে কি না। সিংহ হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে পিছনে ফিরে দেখে। দেখে, কতটা পথ ফেলে এল। সেই রকম আমাদের চেতনায় বিচার করে দেখতে হবে কতটা পথ ফেলে এলাম। তার উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে কি না। শ্রীশ্রীমা অল্পকথায় সুন্দরভাবে বললেন। কাজটা ঈশ্বরের বা ঠাকুরের ভাবে করা। নিরাশক্ত ভাবে অহংকার ত্যাগ করে করা। অহংকার আমাদের অধিকারের ভুল সংজ্ঞা দেয়। ভুলিয়ে দেয় সীমা ও প্রাপ্তির উদ্দেশ্য। কর্ম থেকে মুক্তি কর্মের উদ্দেশ্য। যতক্ষণ অহংকার ততক্ষণ কর্ম ভোগ, অহংকার পুড়ে গেলেই কর্মযোগ।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৬: ভক্তিতেই ঈশ্বর দর্শন হয়
কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রীদেবীর দৃষ্টিতে টুকরো সময়
শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “যতক্ষণ অহংকার ততক্ষণ অজ্ঞান অহংকার থাকতে মুক্তি নেই। নিচু হলে তবে উঁচু হওয়া যায়। চাতক পাখির বাসার নিচে, কিন্তু উঠে খুব উঁচুতে। উঁচু জমিতে চাষ হয় না। খাল জমিতে জল জমে তবে চাষ হয়।” অহংকারের কারণে প্রকৃত জ্ঞান হারায়, উদ্দেশ্য ভূলে যায়। স্বামী বিবেকানন্দ কর্মের উদ্দেশ্য কী, এই প্রসঙ্গে বলছেন—“আমরা পূর্বেই দেখেছি জগতের উপকার করতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেদেরই উপকার করে থাকি। অপরের জন্য আমরা যে কাজ করি, তার মুখ্য ফল আমাদের চিত্তশুদ্ধি। সর্বদা অপরের কল্যাণ চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা নিজেদের ভুলবার চেষ্টা করছি। এই আত্মবিস্মৃতিই আমাদের জীবনের এক প্রধান শিক্ষার বিষয়। মানুষ মূর্খের মতো মনে করে, স্বার্থপর উপায়ে সে নিজেকে সুখী করতে পারে। বহুকাল চেষ্টা পর সে অবশেষে বুঝতে পারে প্রকৃত সুখ স্বার্থপরতায় নাশে। সে নিজে ব্যতীত অপর কেহই তাকে সুখী করতে পারে না। পরোপকার-মূলক প্রতিটি কাজ, সহানুভূতিসূচক প্রতিটি চিন্তা, অপরকে আমরা যেটুকু সাহায্য করি। এইরূপ প্রত্যেকটি সৎকার্য আমাদের ক্ষুদ্র ‘আমি’র গরিমা কম করছে। আমাদের ভাবতে শিখাছে। আমরা অতি সামান্য। সুতরাং, এগুলি সৎকার্য। এখানেই দেখি জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম একটি ভাবে মিলিত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদর্শ অনন্তকালের জন্য পূর্ণ আত্মত্যাগ। যেখানে কোনও ‘আমি’ নাই, সব ‘তুমি’। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কর্মযোগ মানুষকে ওই লক্ষ্যেই লয়ে যায়।”
আরও পড়ুন:
পরিযায়ী মন: নীলনদের দেশে পিরামিড মানে অপার বিস্ময়
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৮: প্যায়ার করনে ওয়ালে প্যায়ার করতে হ্যায় শান সে— আশার কণ্ঠ ও আরডি-র সুর, অনবদ্য
আমরা চাই, অনন্ত সুখ, চাই অনন্ত মুক্তি। প্রকৃতপক্ষে আমরা অনন্তকে চাই। আমরা প্রত্যেকে অনন্তকে বুঝি বা না বুঝি, ওই লক্ষ্যেই এগিয়ে চলেছি। পূর্ণ স্বরূপ কে জানি না বলে আমরা ছোট ‘আমি’ তে বদ্ধ হয়ে পড়ি। নিঃস্বার্থ কর্ম ও আত্মসমর্পণ মধ্য দিয়ে আমরা অনন্তের সঙ্গে যুক্ত হই।
আরও পড়ুন:
দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২১: এ-কালের মতো সেই পুরোনো আমল থেকেই রাজনৈতিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য নিষিদ্ধ প্রণয়-ফাঁদ পাতা হত
অনন্ত ঈশ্বরের সর্বব্যপীত্ব, সর্বশক্তিমানত্ব, সর্বমানত্ব সকলই তিনি আছেন। কিন্তু তিনি, জীবের ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য করাতে পারেন না, সে কারণে সন্দেহ থেকে যায়। অপরদিকে, সাধারণ জীব, অল্পত্ব, অভিমান ও অহংকার প্রকাশ ও অনুভব ক্ষমতা সম্পন্ন। কোনও সন্দেহ নেই তার প্রকাশে। অনন্ত ঈশ্বর ও সীমিত জীবের মধ্যে দেওয়াল তুলে আছে সংশয় ও অহংকার। তা সরে গেলেই ‘তৎ’ ও ‘তম্’ এক হয়ে যায়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।