মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


কোন এক সময় নারদের মনে অভিমান হয়েছিল যে, বুঝি তার মতো ভক্ত আর নেই। ঠাকুর তাহা জানতে পেরে একদিন তাঁকে সঙ্গে করে বেড়াতে বেরোলেন। খানিক দূরে গিয়ে নারদ এক ব্রাহ্মণকে দেখতে পেলেন। তাঁর কোমরে একখানা শাণিত তলোয়ার রয়েছে। অথচ ব্রাহ্মণ শুকনো ঘাস খাচ্ছেন। নারদ বুঝতে পারলেন, তিনি পরম বৈষ্ণব, অহিংস তাঁর ধর্ম। তাই যে সকল ঘাসে জীবন আছে সে সকল ঘাসও তিনি খান না। শুকনো ঘাস খান। কিন্তু বৈষ্ণবের কোমরে তলোয়ার কেন? নারদ তা বুঝতে না পেরে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এ আবার কেমন, একদিকে ঘোর অহিংসা অপরদিকে ঘোর হিংসা। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” ঠাকুর বললেন, “তুমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করে দেখো না।”
নারদ ঠাকুরের কথা মতো ব্রাহ্মণকে গিয়ে বললেন, “আপনি তো হিংসা করেন না, শুকনো ঘাস খান। তবে আপনার কোমরে তলোয়ার কেন?” ব্রাহ্মণ বললেন, “তলোয়ার রেখেছি তিনজনকে কাটবার তরে।” নারদ বললেন, “কাকে কাকে?” ব্রাহ্মণ বললেন— “প্রথম অর্জুন শালাকে।” নারদ বললেন, “কেন?” ব্রাহ্মণ বললে, “আমার ঠাকুরকে কি না শালা সারথি করে।” নারদ বললেন, “আর কাকে?” ব্রাহ্মণ বললে, “দ্রৌপদী শালীকে।” নারদ বললেন, “কেন?” ব্রাহ্মণ বললেন, “শালীর এত বড় আস্পর্দ্ধা যে, আমার ঠাকুরকে পাতের এঁঠো খাওয়ায়।” নারদ বললে, “আর কাকে?” ব্রাহ্মণ বললে, “আর নারদ শালাকে।” নারদ বললেন, “কেন?” ব্রাহ্মণ বললে, “শালার এত বড় আর্স্পদ্ধা যে, দিন নেই রাত নেই যখন তখন আমার ঠাকুরকে জাগায়।” নারদ স্তম্ভিত হলেন। ব্রাহ্মণের এত ভক্তি দেখে আপন অভিমান ত্যাগ করলেন।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৬: যে কোনও ভাবে নিজেকে উৎসর্গ করাই ঈশ্বর লাভের উপায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৪: কাশীর পথে-ঘাটে

ভগবানের কাছে ভক্তের ভক্তি খুব প্রিয়, যেমন গরুর প্রিয় জাব মেশানো খাওয়ার। “আমি মুক্তি দিতে কাতর নই ভক্তি দিতে কাতর হই”, রামপ্রসাদী গানে রয়েছে। স্বামী অরূপানন্দের কথায়, “মা একমনে শুনিতে ছিলেন, উহাতে মাস্টারমশাইয়ের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতের কিয়দংশ পাঠ করা হইয়াছে। আর কেহ তথায় ছিল না। এক স্থানে পড়িতেছিলাম, গিরিশ—“একটি সাধ।” ঠাকুর— “কী”? গিরিশ— “অহেতুকী ভক্তি”। ঠাকুর— “অহেতুক ভক্তি ঈশ্বরকোটির হয়, জীবকোটির হয় না”। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “মা, জীবকোটির হয় না ঈশ্বরকোটি হয়, এর মানে কী? মা, ঈশ্বরকোটি পূর্ণকাম কি না। তাই অহেতুক। কামনা থাকতে অহেতুক ভক্তি হয় না।” কোন কিছুর জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনাকে ভক্তি বলা যাবে না। পূর্ণ সমর্পণ থেকে অনুরাগ থেকে ভক্তি আসে। তখন ভগবান তার ভার ও গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন:

ইংলিশ টিংলিশ, মাধ্যমিক ২০২৩: ইংরেজি বিষয়ে লাস্ট মিনিট সাজেশনের খুঁটিনাটি জানতে দেখে নাও ভিডিয়ো

আপনার সন্তানের কোনও কাজেই মন বসে না? কী দেখে বুঝবেন? কী করণীয়?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৬: কানে খোল, তেল দেন?

শ্রীমদ্ভগবদগীতায় উল্লেখ আছে, “অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তোমাং যে জনা পর্য্যূপাসতে, তেষাং নিত্যা ভি যুক্তানাং যোগক্ষেম বহাম্যহম্।” অনন্যচিত্তে আমাকে চিন্তা করতে করতে যে সকল লোকেরা আমার উপাসনা করে থাকে সেই নিত্য আমাতে অভিযুক্তদের “যোগ” অর্থাৎ অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি এবং “ক্ষেম” অর্থাৎ প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষণ রূপ ভার আমি গ্রহণ করে থাকি।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের কিছু মূল্যবান মাছ যেগুলো আজ লুপ্তপ্রায়

খাই খাই: রোজ রোজ এক রকম খাবারে অরুচি? খুদের জন্য রইল ভিন্ন স্বাদের এই রেসিপি

দশভুজা: দু’শো বছর আগে হলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারের বদলে সতী হতেন

স্বামী বিবেকানন্দ “ভক্তি” বক্তব্যে তাই বলেছেন, “ভক্তকে সর্বদাই এই কথা বলবার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। প্রভু আমি তোমার নিকট কিছু চাহি না। কিন্তু যদি তোমার কিছু প্রয়োজন থাকে আমি দিতে প্রস্তুত। প্রেমে ভয় থাকে না। প্রেমই প্রেমের লক্ষ্য। ভক্ত অবশেষে এভাবে উপনীত হন যে, শুধু প্রেমই ঈশ্বর, অন্য কিছু নয়। ভগবানের অস্তিত্ব প্রমাণ করিতে মানুষ আর কোথায় যাইবে? সকল দৃশ্য বস্তুর মধ্যে তিনিই সর্বাপেক্ষা স্পষ্ট। তিনি সেই শক্তি, যাহা চন্দ্র সূর্য তারকা রাশি পরিচালিত করিতেছে এবং নরনারী ও ইতর প্রাণিগণের মধ্যে সকল বস্তুতে সর্বত্রই প্রকাশ পাইতেছে। জড়রাজ্যে মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি শক্তিরূপে তিনিই প্রকাশিত। তিনি সকল স্থানেই রহিয়াছেন। প্রতি পরমাণুতে রহিয়াছেন, সকল স্থানেই তাঁহার প্রকাশ। তিনি সেই অনন্ত প্রেম, যাহা জগতের একমাত্র প্রেরণা শক্তি এবং সর্বত্র প্রত্যক্ষ স্বয়ং ভগবান।”

ঈশ্বরের ভালোবাসায় আমাদের ডুব দিতে হবে। তাঁর ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিয়ে ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাবো।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সহ-সচিব, রামকৃষ্ণ মিশন, ন্যন্দি (Nadi), সাউথ প্যাসিফিক (South Pacific), ফিজি (Fiji)।

Skip to content