শ্রীরামকৃষ্ণদেব। ছবি: সংগৃহীত।
ভগবানে মন রেখে সমস্ত কর্ম করা, তা ঈশ্বরের কৃপায় সম্ভব। তার কৃপায় বৈরাগ্য আসে, মানুষের রোগ লেগেই আছে তার উপর আসক্তি। জগতের প্রতি বিরাগ ও ঈশ্বরের অনুরাগ। সেই একই মন, কোথাও থেকে নিয়ে কোথাও লাগানো। একদিকে সন্তান, একদিকে পরিবার, পুরুষ দু’জনকে দুই রকম সোহাগ করে। সেই রকম ঈশ্বরে যাতে সমস্ত মন নির্বিশেষ রূপে অর্পণ করা যায়। কর্মফল ও কর্ম সমর্পণ করা। আমার কৃত কর্মের প্রতিদানে, তাঁর কৃপাও প্রার্থনা না করা। তিনি যা অযাচিত ভাবে দেবেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা প্রকৃত ভক্তের কর্ম।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলছেন, “যতক্ষণ না সংসারে ভোগের বাসনা শেষ হয় ততক্ষণ কর্ম করা দরকার। যেমন একটা পাখি গঙ্গার একখানা জাহাজে মাস্তুলের উপর অন্যমনস্কভাবে বসে ছিল। জাহাজ ক্রমে ক্রমে মহা সমুদ্রে এসে পড়ল। চতুর্দিকে কুল কিনারা নাই দেখে পাখিটার চমক ভাঙল, তখন ডাঙায় ফিরে যাবার জন্য সে উত্তর দিকে উড়ে গেল। অনেকদূর উড়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। কোনও কুল কিনারা দেখতে না পেয়ে ফিরে এসে আবার মাস্তুলের উপর বসলো। খানিকক্ষণ পরে পাখিটা আবার দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল। সেদিকেও কোল কিনারা দেখতে না পেয়ে, চারিদিকে কেবল জল দেখে ভারী ক্লান্ত হয়ে আবার ফিরে এসে মাস্তুলের উপর বসলো। এ বার অনেকক্ষণ জিরিয়ে ক্রমান্বয়ে আবার যখন পূর্বে ও পশ্চিম দিকে গিয়েও কোথাও কূল কিনারা দেখতে পেলে না, তখন অগত্যা সে ফিরে এসে সেই জাহাজের মাস্তুলের উপর নিশ্চেষ্ট হয়ে নিশ্চিন্ত ভাবে বসে রইল। আর উড়ল না।”
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৩৩: ধর্মাচরণ আর ধর্মলাভ মধ্যে বিস্তর পার্থক্য
কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ
এ সংসার মহাসমুদ্র। নিশ্চিন্ত হয়ে বসবার জায়গা নেই। ভগবানের উপর বিশ্বাস ও ভরসা হল ওই মাস্তুলের ন্যায় যা নিশ্চিন্ত কোন আস্থানায় পৌঁছে দেবে। শুধু তার উপর শরণাগত হয়ে থাকা। কর্ম কত দিন যতদিন না তার উপর নির্ভরশীলতা আসে। যখন নির্ভরশীলতা আসে তখন তিনি আমাদের উদ্ধার করে, পারে নিয়ে যান। শ্রী ভগবান নারায়ণের এক ভক্ত তার নাম করতে করতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। কুমোর তার মাটির হাঁড়ি শুকানোর জন্য যেখানে দিয়েছিল, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ভগবানের নামে মশগুল থেকে, না দেখতে পেয়ে কাঁচা হাঁড়ি মাড়িয়ে দিলে। সে দেখে কুমোর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাকে লাঠি হাতে তাড়া করে।
আরও পড়ুন:
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ
কুমোর তাঁর ভক্তেকে মারবে দেখে শ্রী ভগবান ভক্তকে বাঁচানোর জন্য তড়িঘড়ি করে গোলক থেকে নেমে এলেন। লক্ষ্মীদেবী তো অবাক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার ফিরে গেলেন। তখন লক্ষ্মীদেবী তাড়াতাড়ি যাওয়া ও আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আমি তো ভক্তকে বাঁচানোর জন্য গিয়েছিলাম, কিন্তু যেতে যেতে দেখলাম ভক্ত নিজেই কুমোরকে মারার জন্য লাঠি নিয়েছে। তখন আমি ফিরে এলাম।’ তাই ভগবানের উপর স্মরণাগতি ভক্তের রক্ষা কবচ। তিনি তার ভক্তকে রক্ষা করেন। সাধন করতে করতে স্মরণাগতি আসে আর সংসার আপনি ছেড়ে যায় সংসারকে জোর করে ছাড়তে হয় না।
আরও পড়ুন:
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৯: ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড কোনও ভাবেই শরীরে ঢুকছে না? অজান্তেই এই সব অসুখ ডেকে আনছেন কিন্তু
প্রথম আলো, পর্ব-২: পৃথিবীর কোথায় প্রথম হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল?
শ্রীশ্রী মা বলছেন, “যে তাঁর শরণাগত তার মুক্তি হবে না তো হবে কি?” ভগবান দেখেন মন। অন্তঃকরণের আর্তি। সর্বোপরি আত্মসমর্পণ। যে তাঁর শরনাগত তার মুক্তি নিশ্চিত। তিনি তার সমস্ত ভার গ্রহণ করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্ভগবত গীতাতে বলছেন, “সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।” ১৮|৬৬। সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার স্মরণ গ্রহণ করো, আমি তোমাকে সর্ব পাপ হতে মুক্ত করবো। তুমি শোক করো না। তিনি তাঁর শরণাগতকে কখনও বিপথগামী হতে দেন না। শুভাশুভ সমস্ত কর্ম ও কর্মফল ত্যাগ করে যিনি তার স্মরণাগত হন সমস্ত পাপের হাত থেকে মুক্ত করে তাকে মোক্ষ প্রদান করেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীমদ্ভগবত গীতাতে বলছেন, “সর্বধর্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ। অহং ত্বা সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।” ১৮|৬৬। সর্বধর্ম পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার স্মরণ গ্রহণ করো, আমি তোমাকে সর্ব পাপ হতে মুক্ত করবো। তুমি শোক করো না। তিনি তাঁর শরণাগতকে কখনও বিপথগামী হতে দেন না। শুভাশুভ সমস্ত কর্ম ও কর্মফল ত্যাগ করে যিনি তার স্মরণাগত হন সমস্ত পাপের হাত থেকে মুক্ত করে তাকে মোক্ষ প্রদান করেন।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।