সমুদ্রের ঢেউ যেমন উঠে আর নামে, তেমনি মনের ক্ষেত্রেও বিরামহীন চিন্তা সবসময় উঠে আর নামে। চঞ্চল মন নিয়ে স্বামীজি একটি সুন্দর গল্প বলেছেন— মন হল বাঁদরের মতো। প্রথমত বাঁদরটি পাগল। তাকে আবার মদ খাওয়ানো হয়েছে, ভিমরুলেও কামড়েছে। তার যা অবস্থা হবে, আমাদের মনের অবস্থাও সেইরূপ হয়ে থাকে। তাকে যেমন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তেমনি পারদকে ধরাও ঠিক তেমনই কঠিন। তবে অসম্ভব কিছুই নয়। গীতাতে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন—অভ্যাস দ্বারা মনকে শান্ত করা যায়। বিষয়বাসনা আমাদের মনকে চঞ্চল করে, যা কখনই স্থির থাকতে দেয় না।
সাঁতার শিখতে হলে অনেকদিন জলে হাত-পা ছুঁড়তে হয়। এক বারেই সাঁতার দেওয়া যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন—“ব্রহ্ম সাগরে সাঁতার শিখতে হলেও আগে অনেকবার উঠতে পড়তে হয়। একেবারে হয় না।” একজন সন্ন্যাসী শ্রীশ্রী মাকে প্রণাম করে বলছেন—“মা মাঝে মাঝে প্রাণে এত অশান্তি আসে কেন? কেন সর্বক্ষণ আপনার চিন্তা নিয়ে থাকতে পারি না? পাঁচটা বাজে এই চিন্তা কেন এসে পড়ে মা? ছোটখাট অনেক জিনিস তো চাইলেই পাওয়া যায়। পেয়েও এসেছি, আপনাকে কি কোনওদিনই পাবো না মা? কিসে শান্তি পাবো বলে দিন। আপনার কৃপা কি কখনওই পাবো না? আজকাল দর্শন-টর্শনও বড় একটা হয় না। আপনাকেই যদি না পেলুম তবে বেঁচে থেকেই বা লাভ কি! শরীরটা গেলেই ভালো।’’ উত্তরে শ্রীমা বলছেন—“সে কি বাছা, ও কথা কি ভাবতে আছে। দর্শন কি রোজই হয়?’’
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২: অনন্তের সন্ধান আর সেই দরজার তালা ও চাবি তো তাঁর কাছেই রাখা আছে
বিচিত্রের বৈচিত্র্য: নাম রেখেছি বনলতা…/১
ঠাকুর বলতেন—“ছিপ ফেলে বসলেই কি রোজই রুই মাছ পড়ে? অনেক মাল-মশলা নিয়ে একাগ্র হয়ে বসলে, কোনওদিন বা একটা রুই এসে পড়ল, কোনওদিন বা নাই পড়ল। তাই বলে বসা ছেড়ো না। জপ বাড়িয়ে দাও।” যোগীন মা পাশেই ছিলেন, তিনি তখন বললেন—“হ্যাঁ, নামই ব্রহ্ম। প্রথম প্রথম একাগ্র না হলেও হবে নিশ্চয়ই।”
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৮: খোকা নয়, খুকি নয়
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২: গণমাধ্যমে লিঙ্গবৈষম্য এবং রাজনীতি
একাগ্র চিত্ত আর ব্যাকুলতার কথা শ্রীশ্রী ঠাকুর বলেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ একটি সুন্দর গল্প উপমা দিয়ে বলেছেন—“যাত্রার দল দেখেছ, যতক্ষণ খোল খচ মচ করছে, কৃষ্ণ এসো হে, কৃষ্ণ এসো হে বলে চিৎকার করে গান করছে। শ্রীকৃষ্ণের তখনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সে আপন মনে সাজঘরে তামাক খাচ্ছে আর গল্প করছে। যখন সকলে থামলো, নারদ ঋষি মৃদু স্বরে গান ধরলেন, শ্রীকৃষ্ণ আর থাকতে পারলেন না। অমনি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে আসরে নেমে পড়লেন। সাধকের ভিতরও সেই রূপ। যতক্ষণ সাধক, প্রভু এসো হে এসো হে বলে চিৎকার করছে ততক্ষণ জেনো প্রভু সেখানে আসেন না। প্রভু যখন আসবেন সাধক তখন ভাবে গদগদ হবে আর চেঁচাবে না। সাধক যখন গদগদ ভাবে ডাকে, তখন প্রভু আর দেরি করতে পারেন না।”
আরও পড়ুন:
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২: ন্যাড়া মাথায় ভালো চুল গজায়?
ইংলিশ টিংলিশ: মাধ্যমিকে ইংরেজিতে ভালো নম্বর পাওয়ার উপায় কি? দেখে নাও আজকের বিষয়: Seen Comprehension
ঠাকুর আরও বলেছেন—“যে জিনিস লাভ করতে চাও সেই রূপ সাধনা কর, তা না করলে কি হবে? দুধ থেকে মাখন পেতে হলে দুধ থেকে দই হয়, দই থেকে ঘোল, ঘোল থেকে মাখন পাওয়া যাবে। সাধককে সব সময় ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। শুদ্ধ মনও সাধনার পথে সাহায্য করে। যেমন প্রদীপের শিখা চঞ্চল বাতাসের প্রভাবে দুলতে থাকে, তেমনি অশুদ্ধ মন স্থির থাকতে দেয় না।” পরমহংসদেব বলছেন—“সিদ্ধি সিদ্ধি বলে চ্যাঁচালে সিদ্ধির নেশা হবে না। সিদ্ধি এনে বেটে খেতে হবে তবে তো সিদ্ধির নেশা হবে।” নিয়মিত সাধন ভজন সাধককে ঈশ্বরের স্বরূপ চিনিয়ে দেয়। নিশ্চিত আনন্দলাভের দিকে নিয়ে যায়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সহ-সচিব, রামকৃষ্ণ মিশন, ন্যন্দি (Nadi), সাউথ প্যাসিফিক (South Pacific), ফিজি (Fiji)।