রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণদেব।

বর্ষাকালে যখন খাল বিলের জল নালা দিয়ে মাঠে ঢোকে চাষি তখন ক্ষেত তৈরি করেন। বীজ বপন করেন। হয়তো সকালবেলা ভালো করে আল তৈরি করে মাঠের জল ভরে রেখে গেলেন। কিন্তু যদি আলের মধ্যে গর্ত থাকে পরদিন এসে দেখে সব জল বেরিয়ে গিয়েছে। বৃথা তাঁর পরিশ্রম, জল থাকল না। আমাদের জীবনের ক্ষেত্রেও তাই, সাধন ভজন যতই করা হোক না কেন, বিষয় ভোগ বাসনা ওই গর্তের মতো। সমস্ত ফল বেরিয়ে যায়, সঞ্চয় আর থাকে না। যা অল্প-স্বল্প থাকে তাতে আর চলে না।
সাধন ভজন দ্বারা ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না ঠিকই। কিন্তু সাধন-ভজন করলে অহংকার কেটে যায়, ভগবানের কৃপা হয়। তাকে যে আমাদের ক্ষমতায় লাভ করব সে ক্ষমতা আমাদের নেই। তিনি সে শক্তি দেন যার দ্বারা তাঁকে লাভ করতে পারি বলা ভালো, তিনি তাঁকেই পাওয়ার উপযুক্ত করে নেন। তাঁর কাছে টেনে নেন।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২৭: গুরু ছাড়া কে নেবে শিষ্যের ভার!

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

শ্রীরামকৃষ্ণদেব একটি সুন্দর গল্প বলেছেন, “বারোশো ন্যাড়া তেরোশো নেড়ি তার সাক্ষী উদম সাড়ী।” কথিত আছে— নিত্যানন্দ গোস্বামীর এক পুত্র বীরভদ্রের ১৩০০ শিষ্য ছিল। তাঁরা যখন সিদ্ধ হয়ে গেলেন তখন বীরভদ্রের ভয় হল। তিনি ভাবতে লাগলেন যে তাঁরা সিদ্ধ হল। এখনই তাঁরা যাঁকে যাহা বলবে তা হবে, যেদিক দিয়ে যাবে সেই দিকেই ভয়। কেন না লোকে অজ্ঞানবশত যদি এদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে, তাহলেই তাদের অনিষ্ট হবে।

বীরভদ্র এরূপ চিন্তা করে তাঁদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা গঙ্গায় গিয়া ধ্যান আহ্নিক সেরে এসো। প্রবাদ এই রূপ যে, তাঁদের ক্ষমতা এমন ছিল যে, ধ্যান করতে করতেই তাঁদের সমাধি হল, জল মাথার উপর দিয়ে চলে গেল কিন্তু তাঁরা কিছুই জানতে পারলে না। পুনরায় ভাটা পড়ল। কিন্তু তথাপি তাহাদের মধ্যে ১০০ ন্যাড়া ধ্যান না করতে করতে বুঝতে পারল বীরভদ্রের অভিপ্রায় কী? গুরুর কথা লঙ্ঘন করা বিধেয় নয়, তাই তাঁরা আর সাক্ষাৎ করতে গেল না। অবশিষ্ট বারোশো ধ্যানান্তে গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেল। বীরভদ্র ১৩০০ নারী জোগাড় করে রেখেছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন, এই ১৩০০ নারী তোমাদের সেবা করবে তোমরা এদের বিয়ে করো। তাহারা বলিলেন যে, আজ্ঞে। কিন্তু আমাদের মধ্যে ১০০ জন কোথায় চলে গিয়েছে। ওই বারোশো বিয়ে করল কিন্তু তারপর আর তাহাদের সে ক্ষমতা থাকল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১৩: স্ত্রী-পুত্র-আত্মীয়-বন্ধু সকলের কাছে সব কথা না বললেই শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকে সংসারে

যেমন যে ঘরের ভিতর একটু ফাঁক আছে। সে ফাঁক দিয়ে অল্প চাঁদের আলো আসে। যে ভিতরে আছে তার আলোর জ্ঞান সেইটুকু। যার ঘরে অনেক ফাঁক আছে সে অধিক আলো দেখিতে পায়। আবার যাঁর দরজা জানলা খোলা তিনি অধিক আলো দেখতে পান। যিনি মাঠে আছেন, তাঁর কাছে আলোই আলো।

ভগবান লোকের মানসিক অবস্থা অনুযায়ী আপনার স্বরূপ প্রকাশ করেন। যে সবটুকু নিয়ে সেই বিরাট পুরুষের নিকটে যায় সে ততই তাঁর পথে নতুন নতুন আলো দেখতে পান। আনন্দ অনুভব করেন।
আরও পড়ুন:

শিলাইদহে ‘নতুন বাবুমশাই’-এর কড়া নির্দেশ, এই নিয়মের বদল না হলে আজ পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হবেই না

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

ধর্ম আচরণ কেউ জোর করে করতে পারে না। ধর্ম পিপাসা উপস্থিত হলে জীব আপন হতে ব্যাকুল হলে, ধর্ম অন্বেষণ করে এবং তা আচরণে প্রবৃত্ত হয়। কর্মসাধন করা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “শত বছরের অন্ধকার পূর্ণ ঘরে যেমন এক প্রদীপের আলোয় আলোকিত করে, ঈশ্বরের কৃপায় সেই রূপ আমাদের জীবনে সমুদয় পাপ এক মুহূর্তে দূর হয়ে যায়।”

যাঁর হৃদয়ে বিষয় বাসনা প্রভুত্ব করছে তিনি কী করে ভগবানকে হৃদয়ে বসাবেন! প্রকৃত মানুষ হৃদয় থেকে বিষয় বাসনার প্রভুত্ব নষ্ট করলে ঈশ্বরের কৃপায় তা মুহূর্তেই পবিত্র হয়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content