শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


কথায় বলে যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ। দুই বন্ধুর একটি সুন্দর গল্প রয়েছে। অনেক দিন পর দুই বন্ধুর রাস্তায় দেখা হলে শুভাশুভ সংবাদ বিনিময়ের পর কে কোথায় যাবে জিজ্ঞাসা করল। এক বন্ধু বলল, সে হরিনাম শুনতে যাচ্ছে। আর অপর বন্ধু বলল, বেশ্যালয়ে যাবে। তারপর নিজের গন্তব্যস্থলে চলে গেল। প্রথম বন্ধু হরিসভাতে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হরি নামগান শোনার পর অপর বন্ধুর কথা মনে করে ভাবতে লাগলো বন্ধু কেমন আনন্দ ভোগ করছে। আর আমি কেমন ম্যাড়ম্যড়ে গান শুনছি। আবার অপরপক্ষে যে বন্ধু বেশ্যালয় গেল সে ভাবছে আমার বন্ধু কেমন হরিনাম কীর্তন শুনছে, আর আমি কেমন নোংরা জায়গাতে এসেছি। ধিক্ আমাকে। এরপর যখন তাদের মৃত্যু হল তখন প্রথম বন্ধুকে যমদূতে নিয়ে গেল আর দ্বিতীয় বন্ধুকে দেবদূত এসে নিয়ে গেল।
যমলোকে যাওয়ার পর বন্ধু জিজ্ঞাসা করল, আমি কেন এখানে এলাম, আমি তো হরি কথা শুনতাম। যমদূত তখন বললে, তুমি হরি কথা শুনতে কিন্তু তোমার মন বেশ্যালয়ে থাকতো। তাই তোমার এখানে স্থান। আর দ্বিতীয় বন্ধুকে দেবদূত বললে, তুমি বেশ্যালয়ে গেলেও তোমার মন হরিতেই থাকতো। তাই তোমার হরিধামে স্থান। মন শুদ্ধ তো সব শুদ্ধ। মনেতেই সব লাভ হয়।

যে কোন মূর্তির চিন্তা করা যায়। যার যা ভালো লাগে তাঁর চিন্তাই করা যায় বিদ্বেষ না করে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “শিব, কালী, হরি—সবাই একেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সবাই এক। যিনিই নিরাকার তিনিই আবার সাকার। বেদে যার কথা আছে, তন্ত্রে তারই কথা, সেই এক সচ্চিদানন্দের কথা, যাঁর লীলা তাঁরই নিত্য।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২৪: ‘যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখো না, দোষ দেখবে নিজের’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩: গায়ে আমার পুলক লাগে

আজকাল অনেকে প্রশ্ন করেন, সনাতন ধর্মে অনেক দেব-দেবী কেন? কাকে মান্যতা দেবো? কথা হচ্ছে, আমরা যে ভিন্ন ভিন্ন নাম বা রূপ দেখি তা এক ঈশ্বরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। যে ভক্ত ভগবানকে যে রূপ দেখতে চায়, সে রূপেই পেয়ে থাকে। ঈশ্বর আর তার শক্তির প্রকাশ, শিব আর তার শক্তি, বিষ্ণু আর শক্তি—সবই একই প্রকাশ। যেমন পরিবারের একজন কারও বাবা, দাদু, জ্যেঠু, ভাই নানা সম্পর্কের হয়ে থাকে। যেমন যার যা সম্পর্কের হয়। তেমন এক ঈশ্বর ভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়। যে যা চায়, তাই পায়। কিন্তু নাম ভেদে। অনন্ত পথ অনন্ত মত। একটা জোর করে ধরে এগোতে হয়।

ঠাকুর বলছেন, “ছাদে উঠতে গেলে পাকা সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়। একখানা মই দিয়ে ওঠা যায়। দড়ির সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়। একগাছা দড়িতে দিয়ে ওঠা যায়। একগাছা বাঁশ দিয়ে ওঠা যায়। এতে খানিকটা বা উঠে খানিকটা পা এগলে ওঠা যায় না। একটাকে দৃঢ় করে ধরতে হয়। ঈশ্বর লাভ করতে হলে একটা পথ জোর করে ধরে নিতে হয়। তারই ইচ্ছায় নানা ধর্ম ও নানা মত। যার যা প্রকৃতি যার যা ভাব সেই সেই ভাবটি নিয়ে থাকে।”

বারোয়ারি পুজোতে নানা মূর্তির পুজো হয়। নানারকম লোকও যায়। হরপার্বতী, রাধাকৃষ্ণ, সীতারাম প্রভৃতি মূর্তি থাকে আর প্রত্যেক মূর্তির কাছে ভিড়ও হয়। যাঁরা বৈষ্ণব তাঁরা বেশিক্ষণ রাধা কৃষ্ণের কাছে, যারা শাক্ত তাঁরা হরপার্বতীর কাছে যায়। যাঁরা রামভক্ত তাঁরা সীতারামের মূর্তির কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার বারোয়ারিতে বেশ্যা উপপতিকে ঝাটা মারছে এমন মূর্তিও থাকে। যাদের কোনও ঠাকুরের দিকে মন নেই, সেই সব লোক হাঁ করে দাঁড়িয়ে সেই সব দেখে। আর বন্ধু-বান্ধবদের চিৎকার করে বলে—”আরে ওসব কি দেখছিস? এদিকে আয়।”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

মনের ভাব তার আচার-আচরণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। সনাতন ধর্মে সেই স্বাধীনতা আছে। নিজের ইষ্ট ঠিক করা যায়। গুরু অবশ্য সেই বিষয়ে সাহায্য করেন। এ যেন সাত ফোকরের বাঁশি। যেমন খুশি বাজাও। যেকোনও রাগে বাজাতে পারা যায়। আবার একটাও বাজানো যায়। যেকোনও ভাবকেই আশ্রয় করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১০: রাজার আশপাশে থাকা দুষ্ট লোকেদের অতিক্রম করে তাঁর কাছ পর্যন্ত পৌঁছনোর পথ খুবই দুর্গম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১৫: কুরুপাণ্ডবদের পিতামহ প্রাজ্ঞ শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস, সর্বত্যাগীর কেন এই মায়াবন্ধন?

ধর্মলাভ করা নিয়ে কথা। ধর্ম পথ গ্রহণ করা ধর্ম লাভ করার মধ্যে অনেক পার্থক্য। আজকাল ধর্ম পথ গ্রহণ করা নিয়েও খুব হুড়োহুড়ি দেখা যায়। কিন্তু ধর্ম লাভ করা নিয়ে তেমন না। ধর্মলাভ হলে মন থেকে ভেদ ভাব চলে যায়। আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম, তীর্থযাত্রা, পুজোপাঠ, সাধন ভজন প্রত্যেকটি ধর্মপথেরই অঙ্গ। আবার তা ভিন্ন ধর্ম পথে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হতে পারে। কিন্তু উপলব্ধি হল মূল কথা। ধর্ম মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে। ধর্ম লাভ হলে পাথরের মূর্তি প্রাণবন্ত হয়, প্রতিটি জীবে ঈশ্বরের উপস্থিতি অনুভূত হয়।
* * অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content