রবিবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


জগতে তিন প্রকার পুতুল আছে। এক প্রকার নুনের পুতুল, দ্বিতীয় প্রকার তুলোর পুতুল, তৃতীয় প্রকার পাথরের পুতুল। প্রথম প্রকার পুতুল জলে নামলে জলের সঙ্গে মিশিয়ে যায়। দ্বিতীয় প্রকার পুতুল জলে নামলে জল শুষে নেয়। আর তৃতীয় প্রকার পুতুল জলে নামলে জল শুষে না বা জলের সঙ্গে মিশে না।

পতঙ্গ যেমন আলো দেখলে ছুটে গিয়ে তাদের প্রাণ দেয়, ভক্ত সেইরূপ ভগবানের জন্য সকলই ছেড়ে থাকেন। ঠিক ঠিক ভক্ত দ্বিতীয় প্রকার পুতুলের মতো ভগবানের সঙ্গে এমন ভাবে মিশে যায় যে, তখন তার ভিতর বাইর ভগবান ছাড়া কিছুই থাকে না। তার চিন্তা ভাবনায় শুধু ভগবানই বাস করেন।
একজন ভক্ত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করলেন, ব্রহ্ম দর্শন কী রকম?

পরমহংসদেব বললেন, ‘তাহা প্রকাশ করার জো নাই। যেমন যদি কেউ সমুদ্রের মধ্যে যায় আর যদি কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে সমুদ্র কেমন? তবে সে কী বলবে! সে কেবলই বলে জল-ই জল।’

যিনি জ্ঞানী তিনি প্রথম পুতুলের মতো ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে আর পৃথক অস্তিত্ব থাকে না। একই থাকে দুই নেই। ঠাকুরের নুনের পুতুল সমুদ্রের জল মাপতে যাওয়ার মতো আর খবর দিতে পারে না। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “কাঠ পোড়ার সময় পড়্ পড়্ শব্দ হয়। শেষ হয়ে গেলে ছাই পড়ে থাকে, আর কোনও শব্দ থাকে না।” একটি গল্প রয়েছে, বৃহস্পতির পুত্র কচের সমাধি ভঙ্গের পর যখন মন বহির্জগতে নেমে এসেছিল তখন ঋষিরা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখন তোমার কী রূপ অনুভূতি হচ্ছে? তিনি বললেন, সর্বম্ ব্রহ্মময়ম। তিনি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পারেননি।
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-২২: আমরা প্রতিক্ষণে উপলব্ধি করি মায়ার শক্তি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৭: স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা ‘সাগরিকা’

মা যেমন কারও জন্য ডাল ভাত, কারও জন্য সাগু-বার্লির ব্যবস্থা করেন। ভগবানও সে সবরকম মানুষের উপযোগী সাধনার ব্যবস্থা করেছেন। জগতে তৃতীয় পুতুলের মতো অনেক মানুষ আছে, যারা কোনও দিন ভগবৎতত্ত্ব বুঝতে বা জানতে চায় না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৪: কিশোরের শুধু কণ্ঠই নয়, তাঁর অভিনয় ক্ষমতাকেও গানের নেপথ্যে সুকৌশলে কাজে লাগাতেন পঞ্চম

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

ভক্তির অনন্য উদাহরণ হিসাবে এক গল্প প্রচলিত আছে, একজন শৈব ছিল। তার ভক্তির জোরে ভগবান শূলপানি তাকে দেখা দিয়ে বললেন, দেখো বাবু তোমার ভক্তিতে, আমায় তুমি দেখতে পেলে বটে, কিন্তু যত দিন না কমলাপতি হরির প্রতি তোমার বিদ্বেষ ভাব যাবে ততদিন আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হব না। শৈব এই কথায় ঘাড় হেট করে থাকল। ভগবান সেখান হতে চলে গেলেন। শৈব আবার সাধনা করতে লাগল। তার সাধনা ঠাকুরকে অস্থির করে তুলল এবং পুনরায় ঠাকুরকে এসে তাকে দেখা দিতে হল। কিন্তু ঠাকুর এবার অর্ধ হর মূর্তিতে তার নিকট আবির্ভূত হলেন।

শৈব হরের অর্ধ মূর্তি দেখে অর্ধ আনন্দিত ও হরির অর্ধ মূর্তি দেখে অর্ধ নিরানন্দিত হলেন। তারপর তিনি দেবতার পূজা করতে আরম্ভ করলেন এবং সর্বপ্রথমে শিব মূর্তির পা ধুয়ে দিলেন। কিন্তু হরির মূর্তির পা স্পর্শ করা দূরে থাক সেদিকে একবার ফিরেও চাইলেন না। ভগবান শূলপানি বললেন, যা প্রার্থনা করেছ তাহা পূর্ণ হবে। কিন্তু দ্বেষ ভাবের জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে। আমি কৃপা করে তোমাকে আমার হরিহর মূর্তি দেখালাম। হরিতে আর আমাতে যে অভিন্ন তা তোমায় বুঝাতে চেষ্টা করলাম তুমি কিন্তু তা বুঝিতে পারিলে না।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৮: বাঁকুড়ার রামসাগরে বিড়াই নদীকে কেন্দ্র করে প্রায় তিনশটি মাছের হ্যাচারি পূর্ণমাত্রায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

শৈব সেই কথা শুনে, এক গ্রামে গিয়ে বাস করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে অল্প দিনেই গ্রামের সকলেই তাকে চিনতে পারলে এবং অবশেষে এমন অবস্থা হল যে তাকে দেখলেই গ্রামের বালকেরা, হরি হরি বলে হাততালি দিতে আরম্ভ করিল। শৈব নিরুপায় হয়ে শেষে আপন কানে দুইটি ঘণ্টা ঝুলালেন। সেই বালকেরা হরি হরি বলে চিৎকার করলে তিনিও সেই সময়ে স্বজোরে ঘণ্টা বাজাতেন। ঘণ্টার ধ্বনিতে হরিনাম তিনি শুনতে পেতেন না। ইনিই হলেন ঘণ্টাকর্ণ।

আপন আপন ইষ্ট মূর্তির উপর বিশেষ নিষ্ঠা রাখতে হবে। কিন্তু অন্যান্য মূর্তিও সেই ইষ্ট মূর্তির ভিন্ন রূপ ভাবতে ও শ্রদ্ধা করতে হবে। দ্বেষ ভাব সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করাই প্রকৃত ভক্তের লক্ষণ।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content