আমরা যারা সাধন করে চলেছি, সাধ্য মতো ঈশ্বরের স্মরণ মনন করে থাকি। সাধনের বিভিন্ন ক্ষণে বিভিন্ন বাধা, বিপর্যয় আসে। আসে মানসিক দুর্বলতাও। মন প্রকৃতির অন্তর্গতও তিনগুণ সমন্বিত। সত্ত্বগুণের প্রাবল্যে ভগবৎমুখী হয়। রজঃগুণে প্রাবল্যে কর্মপ্রবণ হয় এবং তমঃগুণে প্রাবল্যে কাম-ক্রোধ আসে। এটা তো স্বাভাবিক যে কোনও গুণ কখনও বেশি বা কম হয়। আর সেই জন্যই তার প্রভাবে সাধারণ মনে মাত্রা দোলায়মান হয়।
কাম ক্রোধাদির প্রভাবে পড়েননি এমন ব্যক্তি বা সাধক দুর্লভ। কমবেশি সবাইকেই তার প্রাবল্য সহ্য করে এগোতে হয়েছে। মনে কেন কু-ভাব উঠে, কেন কাম যন্ত্রণা আমাদের তাড়িত করে, এ প্রায় সকলের প্রশ্ন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা যত বেশি করে সাধন ভজন করে বা ঈশ্বর প্রণিধান করে, তাদেরকে যেন বেশি করে কাম তাড়িত করে। যেন প্রাবল্য দিনকে দিন বাড়তে থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের অনেক ঘটনা নিজ মুখে বলেছেন, তা লীলা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে। “কোন যুবক এসে বিষণ্ণ মনে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহাশয় কাম কী করে যায়? এত চেষ্টা করি তবু মধ্যে মধ্যে ইন্দ্রিয় চাঞ্চল্য ও খুব ভাব মনে উপস্থিত হয়ে বড় অশান্তি আসে।’
কাম ক্রোধাদির প্রভাবে পড়েননি এমন ব্যক্তি বা সাধক দুর্লভ। কমবেশি সবাইকেই তার প্রাবল্য সহ্য করে এগোতে হয়েছে। মনে কেন কু-ভাব উঠে, কেন কাম যন্ত্রণা আমাদের তাড়িত করে, এ প্রায় সকলের প্রশ্ন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যারা যত বেশি করে সাধন ভজন করে বা ঈশ্বর প্রণিধান করে, তাদেরকে যেন বেশি করে কাম তাড়িত করে। যেন প্রাবল্য দিনকে দিন বাড়তে থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনের অনেক ঘটনা নিজ মুখে বলেছেন, তা লীলা প্রসঙ্গে বর্ণিত আছে। “কোন যুবক এসে বিষণ্ণ মনে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহাশয় কাম কী করে যায়? এত চেষ্টা করি তবু মধ্যে মধ্যে ইন্দ্রিয় চাঞ্চল্য ও খুব ভাব মনে উপস্থিত হয়ে বড় অশান্তি আসে।’
ঠাকুর উত্তরে বলেন—”ওরে ভগবত দর্শন না হলে কাম একেবারে যায় না। তা ভগবানের দর্শন হলেও শরীর যতদিন থাকে ততদিন একটু আধটু থাকে, তবে মাথা তুলতে পারে না। তুই কি মনে করিস আমারই একেবারে গেছে? এক সময়ে মনে হয়েছিল যে কামটাকে জয় করেছি। তারপর পঞ্চবটিতে বসে আছি, আর এমনি কামের তোড় এলো যে আর যেন সামলাতে পারিনি। তারপর ধুলায় মুখ ঘসড়ে কাঁদি আর মাকে বলি—মা, বড় অন্যায় করেছি। আর কখনও ভাববো না যে কাম জয় করেছি—তবে যায়। কি জানিস—তোদের এখন যৌবনের বন্যা এসেছে। তাই বাঁধ দিতে পারছিস না। বান যখন আসে তখন কি আর বাঁধটাধ মানে? বাঁধ উছলে ভেঙে জল ছুড়তে থাকে। লোকের ধানক্ষেতের উপর এক বাঁশ সমান জল দাঁড়িয়ে যায়। তবে বলে, কলিতে মনের পাপ, পাপ নয়। আর মনে এক আধবার যখন কুভাব এসে পড়ে তো— ‘কেন এল’ বলে বসে বসে তাই ভাবতে থাকবি কেন? ওগুলো যখন তখন শরীরের ধর্মে আসে যায়। শৌচ-পেচ্ছাপের চেষ্টার মতো মনে করবি। শৌচ, পেচ্ছাপের চেষ্টা হয়েছিল বলে লোকে কি মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসে? সেই রকম ভাবগুলোকে অতি সামান্য, তুচ্ছ, হেয় জ্ঞান করে,আর মনে আনবি না। আর তাঁর নিকটে খুব প্রার্থনা করবি। হরিনাম করবি ও তার কথাই ভাববি। ওই ভাব গুলো এলে কি গেল সেদিকে নজর দিবি না। এরপর ওগুলো ক্রমে ক্রমে বাঁধ মানবে।”
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৯: ভক্তিতে তন্ময় ভক্তকে ভগবান মানব শরীর ধারণ করে তার ভক্তিরস আস্বাদন করেন
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৯: কুরদার ইকো রিসর্ট—অনাবিস্কৃত এক মুক্তা
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৫: যে ছিল আমার ‘ব্রতচারিণী’
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১১: ‘কটি পতঙ্গ’ ছবিতে পঞ্চমের সুরে কিশোর নিজেকে উজাড় করে দেন
স্বামী যোগানন্দ, যোগেন স্বামীজি বলতেন, “ঠাকুর আমার প্রশ্নের উত্তরে বলিলেন, ‘খুব হরিনাম করবি তাহলেই (কাম) যাবে’। কথাটা আমার একটুও মনের মতো হল না। মনে মনে ভাবলুম উনি কোন ক্রিয়াট্রিয়া জানেন না কিনা। তাই একটা যা তা বলে দিলেন। হরিনাম করলে আবার কাম যায়! তাহলে এত লোক তো করছে, যাচ্ছে না কেন? … তারপর ভাবলুম উনি (ঠাকুর) যা বলছেন তা করেই দেখি না কেন—কী হয়? এই বলে এক মনে খুব হরিনাম করতে লাগলুম। আর বাস্তবিকই অল্পদিনেই, ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, প্রত্যক্ষ ফল পেতে লাগলুম।”
আরও পড়ুন:
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫: অল্প ক্ষতি স্বীকার করে হলেও ভবিষ্যতে বড় লাভের কথা চিন্তা করা দরকার
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০: প্রশিক্ষক গুরু বিশ্বামিত্র, নারীহত্যা না মানবধর্ম?
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪৬: ব্যর্থ প্রেমের বহ্নিশিখা
আবার তিনি কোনও অন্তরঙ্গকে বলছেন, কামকে জয় করার সহজ উপায়, আরও বাড়িয়ে দিতে, এত বাড়াতে বলছেন যে, যেন ভগবানকে চায়, কাম মানে তো কোনও কিছু প্রত্যাশা করা। শ্রীশ্রীমা বলছেন, “মনের স্বভাবই এমন, মনের দোষ দোষ নয়।” কাম ভাবনা অর্থাৎ কোনও কিছুর প্রতি আসক্তি। যার কাছে যা নেই তা অন্যের কাছ থেকে নিয়ে নিজে পূর্ণ হওয়ার ইচ্ছে। নিজের অধিকারের রেখে পূর্ণরূপে ভোগ করা। শ্রীমদ্ ভগবদ্ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে— “ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপজায়তে। সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোঽভিজায়তে।। ক্রোধাদ্ভবতি সংমোহঃ সংমোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ। স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।”
অগ্নিতে ক্রমাগত ঘি আহুতি দিলে অগ্নি কমে না বরঞ্চ বাড়তেই থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ছোট ছোট বাসনাগুলি ভোগ করে নিতে হয়। বড় বাসনাগুলো বুদ্ধি দ্বারা বিচার করে ত্যাগ করতে হয়। স্বামী অরূপানন্দ শ্রীশ্রীমাকে বলছেন, সবাই কি নির্বাসনা হতে পারে? মা বলছেন, “তা পারলে তো সৃষ্টি ফুরিয়ে যেত। পারে না বলেই তো সৃষ্টি চলছে। পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে।” স্বামী অরূপানন্দ, “যদি গঙ্গায় দেহত্যাগ হয়” শ্রীমা বলছেন, “বাসনা ফুরালেই হয়, নইলে কিছুই নয়। বাসনা না ফুরালে শেষ জন্ম হলেই বা কী হবে।”
অগ্নিতে ক্রমাগত ঘি আহুতি দিলে অগ্নি কমে না বরঞ্চ বাড়তেই থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ছোট ছোট বাসনাগুলি ভোগ করে নিতে হয়। বড় বাসনাগুলো বুদ্ধি দ্বারা বিচার করে ত্যাগ করতে হয়। স্বামী অরূপানন্দ শ্রীশ্রীমাকে বলছেন, সবাই কি নির্বাসনা হতে পারে? মা বলছেন, “তা পারলে তো সৃষ্টি ফুরিয়ে যেত। পারে না বলেই তো সৃষ্টি চলছে। পুনঃ পুনঃ জন্মাচ্ছে।” স্বামী অরূপানন্দ, “যদি গঙ্গায় দেহত্যাগ হয়” শ্রীমা বলছেন, “বাসনা ফুরালেই হয়, নইলে কিছুই নয়। বাসনা না ফুরালে শেষ জন্ম হলেই বা কী হবে।”
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?
দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১৭: দাম্পত্যজীবনের অশান্তিই দূর্ভাগ্যজনক পরিণতির কারণ?
স্বামীজির বলছেন, “যতদিন না আমরা জীবনের জন্য এই তৃষ্ণা বিসর্জন দিতে পারি, যতদিন না এই ক্ষণস্থায়ী সত্ত্বার প্রতি প্রবল আসক্তি ত্যাগ করতে পারি ততদিন জগতের অতীত এই অনন্ত মুক্তির এতোটুকু আভাসও পাইবার আমাদের আশা নেই। অতএব ইহা যুক্তিসঙ্গত যে মনুষ্য জাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষার চরম লক্ষ্য মুক্তি লাভ করিবার একটি মাত্র উপায় আছে সে উপায়—এই ক্ষুদ্র জীবন এই ক্ষুদ্র জগত এই পৃথিবী এই স্বর্গ এই শরীর এবং যাহা কিছু সীমাবদ্ধ—সব ত্যাগ করা। যদি আমরা ইন্দ্রিয় মনের দ্বারা সীমাবদ্ধ এই ক্ষুদ্র জগত ত্যাগ করিতে পারি তবে আমরা এখনই মুক্ত হইবো। বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় সমুদয় নিয়মের বাইরে যাওয়া কার্যকারণ শৃঙ্খলের বাইরে যাওয়া আর যেখানেই এই জগৎ আছে, সেইখানেই কার্যকারণ শৃংখল বর্তমান। কিন্তু এই জগতের প্রতি আসক্তি ত্যাগ করা বড় কঠিন ব্যাপার। অতি অল্প লোকেই এই আসক্তি ত্যাগ করিতে পারে।”
সর্ব প্রকার আসক্তি ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা সেই চরম স্থান পেতে পারি, যা অনন্ত মুক্তির ও চির আনন্দময়।
সর্ব প্রকার আসক্তি ত্যাগের মধ্য দিয়েই আমরা সেই চরম স্থান পেতে পারি, যা অনন্ত মুক্তির ও চির আনন্দময়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।