রবিবার ১৭ নভেম্বর, ২০২৪


যদিও সকল ধর্মের ভেতর এক ঈশ্বরের কথায়ই লেখা আছে, তবুও প্রত্যেক ধর্ম ঈশ্বরকে ভিন্ন ভিন্ন দেখায় কেন? শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, “ঈশ্বর এক কিন্তু তার ভাব বিভিন্ন। যেমন বাটির কর্তা এক ব্যক্তি, কিন্তু তিনি কাহারো পিতা, কাহার ভাতা, কাহার পতি— ভাব ভিন্ন ভিন্ন কিন্তু ব্যক্তি এক ঈশ্বর সেই রকম। যেমন কুমোরের দোকানের হাঁড়ি, গামলা, জালা, প্রদীপ প্রভৃতি বিভিন্ন দ্রব্য থাকে কিন্তু সকলকার ভেতরে সেই এক মাটি। ঈশ্বর সেই রকম এক হয়ে দেশ ভেদে ভিন্ন হবে প্রকাশিত হয়েছেন।”

এক হয়েও তিনিই ভিন্ন ভিন্ন রূপে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ভগবান ভক্তের জন্য আসেন ও তিনি যেমন রূপে চান, তেমন ভাবে প্রকাশিত হন। যিনি ঈশ্বরের দর্শন করেন তিনি সম্পূর্ণ অহংকার শূন্য হয়ে যান। অভিমানহীনতা ভক্তের লক্ষণ। সমস্ত মন ঈশ্বরে সর্মপণ করে থাকেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, “পদ্মের পাপড়ি খসে যায় কিন্তু দাগ থাকে, অহংকারও সেই রকম গিয়েও যায় না। একটু না একটু দাগ থাকে। ঈশ্বর দর্শন না হলে জীবের অহংকার যায় না। যদি কারও অহংকার গিয়ে থাকে তার অবশ্য ঈশ্বর দর্শন হয়েছে।
যতদিন অবিদ্যার লেজ না খসে লোকে ততদিন সংসার জলে পড়ে থাকে। তার ল্যাজ খসলে জ্ঞান হলে, তবে মুক্ত হয়ে বেরোতে পারে। আবার ইচ্ছা হলে সংসারেও থাকতে পারে। যার জ্ঞান লাভ হয়েছে তার এখান সেখানে নেই, তার সব সমান।” মনেতেই সব। যেমন রাখা যায় তেমন থাকে। ধোবির গামলা। যে যা রঙ চায় তাই পাবে।

শ্রীশ্রীমা বলছেন, “মন না মত্ত হস্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোটে। তাই সদাসদ বিচার করে সব দেখতে হয়। আর খুব খাটতে হয় ভগবানের জন্য, তখন আমার মন এমন ছিল দক্ষিণেশ্বরে রাতে কে বাঁশি বাজাতো শুনতে শুনতে মন ব্যাকুল হয়ে উঠতো। মনে হতো সাক্ষাৎ ভগবান বাঁশি বাজাচ্ছেন এমনি সমাধি হয়ে যেত। আহা, বেলুড়ে ও কেমন ছিলাম কি শান্ত জায়গাটি ধ্যান লেগেই থাকতো।”
আরও পড়ুন:

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১৭: ভগবানকে ভুলে আমরা থাকতে পারি কিন্তু তিনি কখনওই আমাদের ভুলে থাকেন না

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৩: বায়োফ্লক পদ্ধতিতে সফলভাবে মাছচাষ করছে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও তামিলনাড়ু

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম

প্রকৃত ভক্ত সুযোগ করেন কেমন করে ভগবানের কৃপা পাওয়া যায়। যেন তেন তার সান্নিধ্য ও সন্তোষ লাভ করা। পুজো, পাঠ, আচার, আচরণ, নিয়ম, নিষ্ঠা এ সব কিছু তাকে ধরার বাঁধার দড়ি মাত্র। বেলুড় মঠের একটি ঘটনা,

১৯১৬ খ্রিস্টাব্দ মঠে দুর্গাপুজো। শ্রীশ্রীমা, সপ্তমী পুজোর দিনে দুপুরে মাঠে এসে উত্তর দিকের বাগান বাড়িতে আছেন। অষ্টমীর দিন সকাল বেলা আটটা নয়টার সময় মাঠে ও প্রতিমা দর্শন করতে এসেছেন। রান্নাঘরের পাশের হলঘরে ভক্তেরা ও সাধু ব্রহ্মচারীগণ অনেকে সবজি কাটতে ছিলেন মা দেখে বলছেন, “ছেলেরা তো বেশ কুটনো কাটতে পারে।” স্বামী জগদানন্দজি নেচে বলে উঠলেন, “বহ্মময়ীর প্রসন্নতা লাভ করাই উদ্দেশ্য তা সাধন ভজন করেই হোক আর কুটনো কুটেই হোক।”
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৭: অর্থনীতির প্রান্তিকতায় নারী এবং তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

স্বামী বিবেকানন্দ ভক্তের কেমন ভাব হবে তা পরিষ্কার করে বলেছেন, “যে ভক্ত হইতে চায় তাহার জানা উচিত যত মত, তত পথ। তাহার জানা উচিত বিভিন্ন সম্প্রদায় সেই একই ভগবানের মহিমা বিভিন্ন বিকাশ মাত্র। ‘হে ভগবান লোকে তোমাকে কত বিভিন্ন নামে ডাকিয়া থাকে, লোকে তোমাকে বিভিন্ন নামে যেন ভাগ করিয়া ফেলিয়াছে। কিন্তু প্রত্যেকটি নামেই তোমার পূর্ণ শক্তি বর্তমান। যে উপাসক যে নামে উপাসনা করিতে ভালোবাসে তাহার নিকট তুমি সেই নামের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হও। তোমাকে ডাকিবার কোনও নির্দিষ্টকাল নাই। তোমার নিকট এত সহজেই যাওয়া যায় কিন্তু আমার দূর্দৈব তোমার প্রতি অনুরাগ জন্মিল না।’
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৭: কোরবা হয়ে সাতরেঙ্গা

বিমল মিত্র: এক অসামান্য প্রতিভার অবমূল্যায়ন

স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী

শুধু তাই নয়, স্বামী বিবেকানন্দ এও বলেছেন, ভক্ত যেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা জ্যোতির তনয়গণকে ঘৃণা না করেন। এমনকি তাহাদের সমালোচনা বিষয়েও যেন বিশেষ সতর্ক থাকেন। তাহাদের নিন্দা শোনাও তাহার উচিত নয়। অবশ্য এমন লোক অতি অল্পই আছেন। যাহারা উদার সহানুভূতি সম্পন্ন অপরের গুণগ্রহণে সমর্থক, আবার গভীর ভগবত প্রেম সম্পন্ন। সচরাচর দেখা যায় উদারভাব সম্পন্ন সম্প্রদায়গুলি আধ্যাত্মিক গভীরতা হারিয়ে ফেলে। ধর্ম তাহাদের নিকট একপ্রকার রাজনৈতিক সামাজিক ভাবাপন্ন সমিতির কার্যে পরিণত হয়। আবার খুব সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিগণের আদর্শের প্রতি খুব ভালোবাসা আছে বটে। কিন্তু তাহাদের এই ভালোবাসার প্রতিটি বিন্দু অপর সকল সম্প্রদায়ের যেগুলির মতের সহিত তাহাদের এতটুকু পার্থক্য আছে। সেগুলির উপর ঘৃণা হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। ঈশ্বর ইচ্ছায় জগৎ যদি পরম অথচ গভীর প্রেম সম্পন্ন জনগণে পূর্ণ হইয়া যাইত বড় ভালো হইত। কিন্তু এইরূপ মহাত্মার সংখ্যা অতি বিরল তথাপি আমরা জানি জগতের অনেককে এই আদর্শে শিক্ষিত করা সম্ভব আর ইহার উপায় এই ইষ্ট নিষ্ঠা।”

স্বামীজীর এই দৃঢ় অথচ সত্য বাক্যগুলি বিচার করার দরকার। আমারা ধর্ম লাভ ও উপাসনার জন্য যে পথ অবলম্বন করি তা কতটা উদার ও সঙ্গে সঙ্গে গভীর প্রেম যুক্ত তা নিশ্চিত হওয়া দরকার।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন, ফিজি (Fiji)।

Skip to content