উপনিষদে বলা হয়েছে, ব্রহ্মের উপস্থিতি হেতুই সকলে যে যার কর্মে প্রেরিত হয়। সূর্য, চন্দ্র, অগ্নি, বায়ু, আদি সকলে আপন আপন কাজে নিয়োজিত হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ সহজ করে বলেছেন “ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া গাছের পাতাটিও পর্যন্ত নড়ে না।” ব্রহ্মের শক্তি ছাড়া এই সৃষ্টি চালিত হতে পারে না। তিনি সবার অন্তরে, বাহিরে, পূর্বে, পশ্চিমে, উপরে, নিচে সর্বত্র বর্তমান। কেহ তাহার বাহিরে নয়, কেহই তাহাকে লঙ্ঘন করতে পারে না।
শ্রীরামকৃষ্ণকে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, সন্ধ্যাদি কর্ম কতদিন করতে হবে? উত্তরে পরমহংসদেব বলেন, “যখন একবার হরি বা একবার রাম নাম করলে শরীরে রোমাঞ্চ হয়, তখন নিশ্চয়ই জেনো সে সন্ধ্যাদি কর্ম আর করতে হবে না। তখন কর্ম ত্যাগের অধিকার হয়েছে। তখন কেবল রাম নাম কি হরি নাম, কি শুদ্ধ ওঁ, কারও জপ করলেই হল।” অর্থাৎ সাধক এতটাই তন্ময়তা প্রাপ্ত হন যে তাঁর স্মরণ করামাত্রই মন তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করে, পৃথকত্বের অস্তিত্ব হারায়। তখন আর তাঁর নাম ধরে ডাকার প্রয়োজন হয় না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আছে, গোপীরা শ্রীকৃষ্ণের আহ্বান মাত্রই সমস্ত কর্ম ত্যাগ করে তাঁর সান্নিধ্য হওয়ার জন্য গমন করতেন। যাঁদের যেতে দেওয়া হতো না, তাঁরা রুদ্ধ দ্বারে শরীরটা যেন ত্যাগ করে কৃষ্ণ সান্নিধ্যে মনকে বিলীন করতেন। শরীরটা পড়ে থাকতো মাত্র।
আরও পড়ুন:
অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-১২: প্রকৃত অর্থে পুজোর মধ্যমে ভগবান লাভের শর্তই হল চিত্তশুদ্ধি
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’
হেলদি ডায়েট: দাঁতকে অবহেলা নয়, শিশুর দাঁতের যত্ন নিন গোড়া থেকেই, সতর্ক হন এই সব খাবারে
‘কৃষ্ণসুখ’ পাওয়ার প্রত্যাশায় অন্য সকল সুখ তাঁরা ত্যাগ করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অন্য এক জায়গায় বলেছেন, “সন্ধ্যা গায়ত্রীতে লয় হয়, গায়ত্রী প্রণব লয় হয়, প্রণব সমাধিতে লয় হয়। যেমন ঘণ্টার শব্দ টং ট অম্। যোগী নাদ ভেদ করে, পরম ব্রহ্মে লয় হয়। সমাধির মধ্যে সন্ধ্যাদি কর্মের লয় হয়। এরূপে জ্ঞানীদের কর্ম ত্যাগ হয়। যোগীদের কর্ম ত্যাগ হয়।” কর্ম বা জ্ঞান বা ভক্তি এক ব্রহ্মে চরম অবস্থা লাভ করে। গোপীদের ভক্তি, জ্ঞান দুই লাভ হয়েছিল। জ্ঞানলাভ হলে দেহবুদ্ধি থাকে না। ব্রহ্মের সঙ্গে পৃথক অস্তিত্ব না থাকায় তিনি সর্বত্র প্রকাশিত দেখেন। সর্ব চৈতন্যময় দেখেন।
আরও পড়ুন:
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১২: বাইগা রিসর্ট ও বস্তি
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা
স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী
পরমহংসদেব বলেছেন, “জ্ঞানযোগ এ যুগে ভারী কঠিন। জীবের অন্য গত প্রাণ তারপর আবার দেহবুদ্ধি কোনও মতে যায় না। এদিকে দেহ বুদ্ধি না গেলে একেবারে জ্ঞান হবে না। জ্ঞানী বলে আমি সেই ব্রহ্মা, আমি শরীর নই, আমি খুদা, তৃষ্ণা, রোগ, শোক, জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ এর সকলের পার।” এই অবস্থা হলে সাধক অদ্বৈত ভাবে সমস্ত বিপরীত ভাবনা থেকে নিজেকে পৃথক করে। কিন্তু তা কঠিন সাধারণের পক্ষে। তা সাধন সাপেক্ষ।
শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, “যদি রোগ শোক, সুখ দুঃখ এসব থাকে তবে জ্ঞানী কেমন করে হবে? এদিকে কাটায় হাত কেটে যাচ্ছে দর দর করে রক্ত ঝরছে। অথচ বলছে কই হাত তো কাটে নাই, আমার কী হয়েছে।” যতক্ষণ না পর্যন্ত জ্ঞান লাভ হয়, ততক্ষণ এ অবস্থা হয় না। না হলে নিজেকে বা অন্যদের ভুল পথে পরিচালিত করে।
শ্রীরামকৃষ্ণের কথায়, “যদি রোগ শোক, সুখ দুঃখ এসব থাকে তবে জ্ঞানী কেমন করে হবে? এদিকে কাটায় হাত কেটে যাচ্ছে দর দর করে রক্ত ঝরছে। অথচ বলছে কই হাত তো কাটে নাই, আমার কী হয়েছে।” যতক্ষণ না পর্যন্ত জ্ঞান লাভ হয়, ততক্ষণ এ অবস্থা হয় না। না হলে নিজেকে বা অন্যদের ভুল পথে পরিচালিত করে।
আরও পড়ুন:
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১০: রেমন্ড কোপা এক কিংবদন্তি ফুটবল বাদশা
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৩: আর্ষ মহাকাব্যদ্বয়ের আদি প্রচারমাধ্যম
স্বামী বিবেকানন্দ জ্ঞানের প্রসঙ্গ বলেছেন, “জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি অবস্থায় অনির্বচনীয় কেবল আনন্দ স্বরূপ, উপমা রোহিত, অপার নিত্য মুক্ত, নিষ্ক্রিয়, অসীম আকাশ তুলল অংশহীন ও ভেদাশুন্য পূর্ণব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি অবস্থায় প্রকৃতির বিকারহীন অচিন্ত্য তত্ত্ব স্বরূপ, সমভাবাপন্ন অথচ যাঁহার সমান কেউ নাই, যাঁহাতে কোনওরূপ পরিণামের সম্বন্ধ নাই। যিনি অপরিমেয়, যিনি বেদ বাক্যের দ্বারা সিদ্ধ এবং সর্বদা আমাদের ব্রহ্মতত্ত্ব অভ্যাসশীলগণের নিকট প্রসিদ্ধ এই রূপ পূর্ণব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন। জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধি অবস্থায় জরামৃত্যুশূন্য, যিনি বস্তু স্বরূপ এবং যাঁহাতে কিছুই অভাব নাই। স্থির জল রাশি সদৃশ্য, নাম-রহিত, সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই ত্রিবিধ গুণবিকার রহিত, ক্ষয়হীন শান্ত এক পূর্ণব্রহ্মকে হৃদয়ে অনুভব করেন। মানবের এমন অবস্থাও আসিয়া থাকে তখন তাহার পক্ষে জগত অন্তর্হিত হইয়া যায়। তুমি সকল বস্তুতে বিদ্যমান আমিই তুমি তুমিই আমি।”
জ্ঞানের আলো আপনার অন্ধকারকে মুছে অদ্বৈত আনন্দ উপভোগ করায়।
জ্ঞানের আলো আপনার অন্ধকারকে মুছে অদ্বৈত আনন্দ উপভোগ করায়।
* অনন্ত এক পথ পরিক্রমা (Ananta Ek Patha Parikrama) : স্বামী তত্ত্বাতীতানন্দ (Swami Tattwatitananda), সচিব, রামকৃষ্ণ মিশন, নন্দী (Nadi), সাউথ প্যাসিফিক (South Pacific), ফিজি (Fiji)।