রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


দুর্গাপুজো আপামর বাঙালির একটি আবেগ। যে পুজোর জন্য বাঙালি সারাটি বছর থাকে অপেক্ষারত। নীল আকাশে পেজা তুলোর মতো উড়ে বেড়ানো মেঘের ভেলা, হালকা হাওয়ায় কাশফুলের দোলা, শিউলি ফুলের মনমাতানো সুবাস, এগুলি প্রতিটি বাঙালির উৎসব পিপাসু মনকে করে তোলে নেশাতুর। মহালয়া, অর্থাৎ দেবীপক্ষের সূচনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। কোনও কাজেই আর মন বসতে চায় না। মন শুধু প্রহর গুনে চলে, কবে কাঠি পড়বে ঢাকে। বিশেষ করে সেই যুগে, পুজোর সঙ্গে আরও একটি বিষয় নিয়ে বাঙালির উন্মাদনা থাকতো চরমে। সেটি হল পুজোর গান।

পুজোয় নতুন পরিধান উপহার হিসেবে পাওয়ার আনন্দের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতো নতুন নতুন গান শুনতে পাওয়ার বাঁধনহারা উত্তেজনা। তখনকার দিনে এখনকার মতো সারা বছর ধরে নতুন নতুন গান আত্মপ্রকাশ করার রীতি প্রচলিত ছিল না। তাই সুরকার, গীতিকার এবং গায়ক গায়িকারা এই পুজোর সময়টিকেই বেছে নিতেন শ্রোতাদের নতুন গান উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে। শ্রোতাকূলও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন পুজোর গানের ‘লং প্লেইং রেকর্ড’ সংগ্রহ করার আশায়। সে যেন ছিল একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা। কে কতগুলি নতুন রেকর্ড কিনলেন, কোন গায়ক অথবা গাইকার নতুন গানের রেকর্ড বেশি বিক্রি হল সেই নিয়ে চলত সমীক্ষা। পুরো পুজো মরশুম শ্রোতাদের কেটে যেত এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। প্রতিটি পুজো প্যান্ডেলে বাজত সদ্য প্রকাশিত পুজোর গানগুলি। রেকর্ড কেনবার সামর্থ যাদের ছিল না, তারাও সবাই সেই প্যান্ডেলে বেজে চলা নতুন গানগুলিকে উপভোগ করতেন প্রাণভরে।
পঞ্চমের ক্ষেত্রে সেই মহাযজ্ঞ শুরু হয় ১৯৬৮ সাল থেকে। সচিন ভৌমিক, স্বপন চক্রবর্তী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মতো স্বনামধন্য লেখকদের কথায় সুর দিয়ে বছরের পর বছর অসাধারণ কিছু পুজোর বাংলা গান আমাদের উপহার দেন পঞ্চম। বাণিজ্যিক ছবির পাশাপাশি পুজোর বাংলা গানগুলির ক্ষেত্রেও পঞ্চম রেখে গিয়েছেন তাঁর কালজয়ী সৃষ্টির কিছু অভাবনীয় নিদর্শন।

আশার গাওয়া ‘যাবো কি যাবো না’ গানটির মধ্যে যে আধুনিকতা লুকিয়ে রয়েছে সেটি আজকের তারিখেও প্রাসঙ্গিক। গানটি শুনলে কখনও মনে হয় না যে সেটির বয়স ৫৫ বছর। মনে হয় সেটি যেন ২০২৩ সালেই রচিত। অথবা আশার গাওয়া ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’ গানটি আজও যখন আমাদের কানে পৌঁছয়, আমরা নিজের অজান্তেই সেটি গাইতে শুরু করি। গানটির আবেদন এমনই। ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ অথবা ‘ফিরে এসো অনুরাধা’ গানদুটিতে কণ্ঠদান করেন পঞ্চম স্বয়ং। নিজের সুর এবং নিজের কণ্ঠ। তাই দুটি গানের ক্ষেত্রেই সচিন ভৌমিকের লেখার অন্তরালে থাকা আবেগটিকে যথাযত ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পঞ্চম ১০০ ভাগ সফল। এই গান দুটির বয়স আজও বাড়েনি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩২: শুধু কি গানে, আবহসঙ্গীতেও তাঁর কাজ অসামান্য

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

একবার ভাবুন, ১৯৭১ সালের পুজোয় আশা ভোঁসলে গাইছেন ‘চোখে চোখে কথা বলো মুখে কিছু বল না’। গানটি কিন্তু সেই অর্থে সেই সময় মোটেও যুগোপযোগী ছিল না। সনাতন বাঙালির কাছে তো নয়ই। গানের কথা তো বটেই, গানের সুরটিও সেই সময়ের থেকে অনেক বছর এগিয়ে রেখেছিল নিজেকে। তবু যারপরনাই জনপ্রিয় হয় গানটি। আজকের দিনেও আমরা গানটির রিমেক ভার্সন শুনতে পাই। অর্থাৎ গানটির গ্রহণযোগ্যতা ঠিক যেমনটি ছিল ৫২ বছর আগে, আজও ঠিক তেমনটিই রয়ে গিয়েছে।

সচিন ভৌমিকের লেখা আরও একটি গান ‘স্বপ্ন আমার হারিয়ে গেছে’ তে পঞ্চমের সেই হৃদয়বিদারক সুর আজও আমাদের এক অন্য মাত্রায় উদাসীন করে তোলে। তিনি যে সুরের সম্রাট, এই গানটি তার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। গানটি যখন শেষ হয়, তখন কিছুক্ষণের জন্য সেটি আমাদের মনের গভীরে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

স্বপন চক্রবর্তীর কথায় আশা এবং পঞ্চম এর সেই গান—চলো চলে যাই। দু’জনে কোরাসের মূর্ছনায় শ্রোতাদের মাতোয়ারা করে গানটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেন। এক কথায় অনবদ্য। স্বপন চক্রবর্তীর কথায় আরও একটি গান ‘যায় রে যায় রে বেলা যে বয়ে যায় রে’—শুধু সুর দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি পঞ্চম। আশার সঙ্গে তিনিও মাইক্রোফোন ধরেছেন এবং আমাদের উপহার দিয়েছেন অসম্ভব সুন্দর মেলোডি বিশিষ্ট এই গানটি।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

পরিযায়ী মন, পর্ব-১০: চটকপুরের নিরালায়

গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কলম থেকে বেরিয়ে আসা সেই বিখ্যাত গান—ফুলে গন্ধ নেই সে তো ভাবতেই পারি না। কি মিষ্টি সুর একবার বলুন তো? সুরের আকর এই মানুষটি বোধহয় এই সুরগুলি স্বপ্নে পেতেন। পরেরদিন সকালে সেই সুরগুলি কথায় ফেলে জন্ম দিতেন এক একটি মনমাতানো গানের। ওঁকে সামনে পেলে হয়তো প্রশ্নটি করেই ফেলতাম।

যেমন ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত ‘যেতে যেতে পথে হল দেরি’ গানটি। পরবর্তীকালে ‘আন্ধি’ ছবির একটি গানে (১৯৭৫ সালে) এই একই সুর ব্যবহার করেন পঞ্চম। কিন্তু এই বাংলা গানটির আবেদন সম্পূর্ণ ভিন্ন। নিজের সুর এবং কণ্ঠের দ্বারা গৌরী প্রসন্ন বাবুর লেখা গানটিকে নিজের মত করে সাজিয়ে তুলেছেন পঞ্চম।

আশার গাওয়া ‘সন্ধবেলায় তুমি আমি বসে আছি দু’ জনে’ অথবা ‘মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো’ গান দুটিকে আমরা কি আজও উপেক্ষা করতে পারি? কানে আসা মাত্র আমরা আশার গলার সঙ্গে গলা মেলাতে শুরু করি। এটাই পঞ্চমের ইন্দ্রজাল।

একটি প্রেমের কষ্ট মাখানো পরিণতিকে পঞ্চম কী অবলীলায় তুলে ধরেছেন তাঁরই গাওয়া ‘তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল’ গানটিতে। স্বপন চক্রবর্তীর অসামান্য একটি লেখায় একটি যথোপযোগী সুরপ্রদানের মাধ্যমে পঞ্চম নিজের পারদর্শিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর ক্ষমতার ব্যাপ্তি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪১: চোখ ঠিক রাখতে মাছের মুড়ো?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

একই কথা প্রযোজ্য ‘মধুমাস যায় মধুমাস’ গানটির ক্ষেত্রে। আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘না এখনি নয়’ এবং ‘কথা দিয়ে এলে না’ গান দুটির আবেদন অসাধারণ। গৌরীবাবুর লেখায় এহেন দুটি সুর প্রদান করার কাজটি কোনোমতেই সহজ কাজ ছিল না।

আশার গাওয়া ‘ময়না বলো তুমি কৃষ্ণ রাধে’, ‘ঝুম ঝুম ঝুম রাত নিঝুম’, ‘আসবো আরেকদিন আজ যাই’ প্রভৃতি গানগুলি যে সুরে সুসজ্জিত করেছেন পঞ্চম সেগুলি আজও অম্লান। অথবা যদি ধরা যায় পঞ্চমের নিজের সুরে গাওয়া ‘দার্জিলিং যাত্রা’, ‘শোনো মন বলি তোমায়’, ‘নদীর পাড়ে উঠছে ধোঁয়া’ গানগুলি আমরা খুব মন দিয়ে শুনি আমরা ঠিক বুঝতে পারবো যে পঞ্চম তাঁর নিজের সময়ের থেকে বেশ কয়েক বছর এগিয়ে ছিলেন। সাবেকি প্রথা থেকে নিজেকে সাহস করে কিছুটা সরিয়ে নিয়ে শ্রোতাদের এক নতুন দিশার সন্ধান দেওয়া এবং শ্রোতাদের মনে জায়গা করে নেওয়া, এই দুটি কাজই পঞ্চম সাফল্যের সঙ্গে করে দেখিয়েছেন।

পঞ্চমের সুরারোপিত পুজোর গানের তালিকা এতটাই দীর্ঘ যে সেই সবগুলিকে আমার এই ক্ষুদ্র লেখায় লিপিবদ্ধ করা কষ্টসাধ্য তো বটেই। বছরের পর বছর এমনই কিছু অসামান্য বাংলা আধুনিক গানের ডালি সঙ্গীতপ্রমী বাঙালি পঞ্চম এর কাছ থেকে উপহার পেয়েছে পুজো মরশুমে।

আক্ষেপের বিষয় হল এই যে ‘হিস মাস্টার্স ভয়েস’-এর সেই সারমেয় আজও একইরকম ভাবে একটি লাউড স্পিকারের সামনে বসে তার মনিবের জন্য অপেক্ষা করে চলেছে, শুধু হারিয়ে গেছে নতুন পুজোর গানের জন্য অপেক্ষারত সেই বাঙালি শ্রোতাকুল। কারণ আজকের যুগে নতুন নতুন গান জন্ম নেয় সারাটি বছর জুড়ে। তাই শরৎকালের প্রকৃতি এবং দুর্গোৎসবের বাকি আনন্দগুলি অটুট থাকলেও ম্লান হয়ে গিয়েছে পুজোতে নতুন গান উপহার পাওয়ার সেই উন্মাদনা, উদ্দীপনা এবং অপেক্ষা।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content