রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


লতা, পঞ্চম, কিশোর, আশা ও গুলজার।

পঞ্চমের রাগ রাগিণীর প্রতি চূড়ান্ত দখলের পরিচয় আমরা এতদিনে বহুবার পেয়েছি। রাগ পিলুকে আশ্রয় করে জন্ম নেওয়া ‘ইজাজত’ ছবির ‘খালি হাত শাম আই হ্যায়’ গানটির মধ্যে দিয়ে যে এক চরম একাকীত্বকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, সেটির কৃতিত্ব আধাআধি ভাগ করে নেওয়ার দাবি গীতিকার সুরকার জুটি গুলজার এবং পঞ্চম নির্দ্বিধায় পেশ করতে পারেন। যেমন গুলজারের লেখনী, তেমনই পঞ্চমের সুরের গভীরতা। ঠিক যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুনের যৌথ অংশগ্রহণ। যে যুদ্ধে জয় সুনিশ্চিত। সেটিই ঘটেছে বাস্তবে। আশাকণ্ঠের সঙ্গে বেজে চলা বাঁশির করুন ছোঁয়া আমাদের ক্রমাগত নাড়া দিতে থাকে। হাতে গোনা কিছু বাদ্যযন্ত্র এবং রাগের সাহায্যে শ্রোতাদের এই মাত্রায় প্রভাবিত করার ক্ষমতা সারা বিশ্বে হয়তো খুব কম সুরকারেই ছিল এবং থাকে।
‘মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়’ গানটি গুলজার সাহেব যখন পঞ্চমকে প্রথমবার শুনিয়ে তাতে সুর প্রদান করতে বলেন, তখন প্রবল চটে গিয়েছিলেন পঞ্চম। সেটি একটি আধুনিক কবিতা হিসেবে এক কথায় অসাধারণ। কিন্তু তাই বলে সেটিকে গানের রূপ দেওয়া? পঞ্চম কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে গুলজার সাহেবকে বলেছিলেন, এ বার তো কোনওদিন তিনি কোনও এক দৈনিকে প্রকাশিত একটি খবর নিয়ে এসে সেটিতে পঞ্চমকে সুরারোপ করতে বলবেন! তবে হাল ছাড়েননি গুলজার। তিনি অতি কষ্টে রাজি করান পঞ্চমকে। তিনি এও বলেন, এই কথায় সুর বসানোর ক্ষেত্রে পঞ্চম ব্যতীত আর কারও কথা অন্তত তাঁর মাথায় আসছে না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৪: কাতরা কাতরা মিলতি হ্যায়…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪০: স্বভাবে অনন্য সুন্দরবনের বাঘ

যাই হোক, শুরু হল গবেষণা। দৃশ্যের দাবি অনুযায়ী এবং গানের কথাগুলিকে সুরে বসিয়ে সৃষ্টি করতে হবে এই গান। যে গান, নায়িকার কষ্ট এবং অভিমান—দুটিকেই সুরের মাধ্যমে পৌঁছে দেবে মানুষের হৃদয়ে। কাজটি নেহাত সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি যে পঞ্চম। তাই তিনি যে সুরের জন্ম দিলেন সেটি গুলজারের মতো একজন গীতিকারের আঁখিযুগলকেও হয়তো অশ্রুসিক্ত করে তুলেছিল। তাই গানটি আজও চলে যায়নি বিস্মৃতির আড়ালে। গানটি আজও স্বমহিমায় বেঁচে আছে মানুষের হৃদয়ে। তবু পুরস্কারের ঝুলি খালিই থেকে যায় পঞ্চমের। গুলজার এবং আশা দু’জনেই জাতীয় পুরস্কার পান যথাক্রমে গানটির কথা এবং ‘প্লে-ব্যাক সিঙ্গার’ হিসেবে। কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে পঞ্চম থেকে যান ব্রাত্য। তবু কোনওদিন মুখফুটে কাউকে কিছু বলেননি পঞ্চম। কোথাও কোনও অভিযোগ করেননি। মানুষের ভালো লেগেছে তো—ব্যাস, তাতেই তিনি খুশি। কে বলতে পারে, হয়তো একরাশ অভিমান তাঁর সেই মলিন হাসি দিয়ে ঢেকে এই কথাটিই তাঁর ঘনিষ্ঠদের বলতেন তিনি। আসলে মানুষ পঞ্চম এমনই।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২: রাজমালা অনুসারে রত্ন মাণিক্যের পিতা হলেন ডাঙ্গর ফা, তিনিই ধর্ম মাণিক্য

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৪: রাজনীতিতে, যুগান্তরেও স্বার্থচিন্তার আবহমান প্রভাব

আরও একটি বিষয় উল্লেখ্য। খুব ভালো করে যদি একদম শুরু থেকে ১৯৮৭ সাল অবধি পঞ্চম এর কর্মজীবনের প্রবাহটি লক্ষ্য করা যায়, দেখা যাবে অত্যাবধি বহু গুণী শিল্পী তাঁর সুরে গান গেয়েছেন। মোহাম্মদ রফি, মান্না দে, মুকেশ, মেহমুদ, ভুপিন্দর সিং, এস পি বালসুব্রহ্মণ্যম, জেসু দাস, সুরেশ ওয়াদকর, অমিত কুমার, শৈলেন্দ্র সিং, এন্ড্রু কিশোর, মুহাম্মদ আজিজ, হরিহরণ, সাব্বির কুমার, চন্দ্রশেখর গাদগিল, বাণী জয়রাম, পিনাজ মাসানি, সুষমা শ্রেষ্ঠা, অনেট পিন্টো, ঊষা মঙ্গেশকর, আরতী মুখোপাধ্যায়, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সালমা আগা এবং অনুরাধা পোড়ওয়ালের
মতো বিখ্যাত গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে পঞ্চমের সুর প্রতিফলিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৭: শ্যামাসুন্দরী দেবীর লোকান্তর গমন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৬: রবীন্দ্রনাথ চা নয়, প্রতিদিন সকালে কফি খেতেন

তবে সিংহভাগ ক্ষেত্রে তাঁর সুরে আমরা বিশেষভাবে তিনজন ক্ষণজন্মাকে গাইতে শুনেছি। তাঁরা হলেন—লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে এবং কিশোর কুমার। তাঁর সহধর্মিণী আশার কথা যদি বাদই দেওয়া যায়, দেখা যাবে লতা এবং কিশোরের সঙ্গে পঞ্চমের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। আগেই বলেছি, লতাকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করতেন পঞ্চম। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের বহু সমস্যা, বিশেষ করে নিজের বৈবাহিক জীবনের বহু জটিলতার অবসান ঘটিয়েছিলেন তাঁর লতাদিদির পরামর্শে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৫: রবি ঠাকুরের বড় মেয়ে— যিনি লেখক হতে চেয়েছিলেন!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

কিশোর কুমার ছিলেন পঞ্চমের জীবনের বিরাট একটি অংশ জুড়ে। দু’জনের মধ্যে যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল সেটিকে কোনও একটি বিশেষ নামে নামাঙ্কিত করা হয়তো বেশ কঠিন। কিশোর এবং পঞ্চমের বয়েসের ফারাক ছিল বছর দশেকের। তাই পঞ্চম কিশোরকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান তো দিতেন বটেই। তবু ব্যক্তিগত স্তরে তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন কিশোর। সুর অথবা গান নিয়ে আলোচনা বা গবেষণা তো চলতই। নিজেরা নিজেদের ব্যাক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটিও একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন। এই সম্পর্কটিকে আপনারা কি নাম দেবেন জানি না, কিন্তু এই সম্পর্ক যেন ছিল জন্মজন্মান্তরের। কিশোর এবং পঞ্চম—এঁরা দু’জন অবিচ্ছেদ্য। একজনের নাম উচ্চারণ করলে আরেকজনের নাম, অজান্তেই উচ্চারিত হয়। কী মহিমা এই জুটির!—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content