আগের লেখায় উল্লেখ করেছি, পঞ্চম এই সময়ে পৌঁছে একটি বিষয় খুব ভালোভাবে অনুধাবন করেছিলেন, সেটি হল মানুষের বদলে যাওয়া পছন্দ। পঞ্চমের মনে হতে শুরু করেছিল, তাঁর পরবর্তী সৃষ্টিগুলির মধ্যে এ বার হয়তো সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন। এই মাপের একজন সুরস্রষ্টার পক্ষে নিজস্বতা জলাঞ্জলি দেওয়া যতখানি কঠিন, ঠিক ততোধিক কঠিন নতুন প্রজন্মকে নিজের একের পর এক সুরের মায়াজালে বেঁধে ফেলা। কারণ, এতদিনে অনেক নতুন সংগীত পরিচালকের আগমন ঘটেছে বলিউডে। তাঁরাও তাঁদের ঝুলি থেকে বের করে আনছেন সমসাময়িক সুর, লয় এবং ছন্দ। যেগুলি সানন্দে গ্রহণও করছেন শ্রোতা এবং দর্শককূল। তাই, নিজেকে কিছুটা বদলে, পুরনো এবং নতুন দুইয়ের কাছেই সমান মাত্রায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কাজটি যে অত্যন্ত কঠিন, সেটি বেশ বুঝতে পারছিলেন রাহুল দেব বর্মন। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করতেন তাঁর নবরত্নদের সঙ্গে। তাঁদের মতামত জানতে চাইতেন।
নতুন ছবিগুলির গানগুলি সবাই মিলে বসে শুনতেন। বোঝার প্রচেষ্টা করতেন নতুনের সঙ্গে পুরনোর সূক্ষ্ম পার্থক্য কী। কী উপায়ে সুরের মাধ্যমে এই বদলে যাওয়া সময়ে আবালবৃদ্ধবনিতার মনে একইরকমভাবে জায়গা করে নেওয়া যায়, সেটিই হয়ে উঠেছিল তাঁর দিবারাত্রির ভাবনা।
আসে ১৯৮৭ সাল। মুক্তি পায় ‘ইনাম দশ হাজার’ ছবিটি। ‘চাঁদ কই হোগা তুমসা কাহা’ গানটি শুনলেই বুঝতে পারবেন পঞ্চমের পরিবর্তন। বঙ্গের পরিবর্তে এ বার পঞ্চম ব্যবহার করেন অক্টোপ্যাড। একটু ভিন্ন স্বাদের পরকাশন, ছন্দের ক্ষেত্রে কিছুটা নতুনত্ব নিয়ে এসে গানটিকে যথাসাধ্য যুগপোযোগী করার প্রয়াস করেন তিনি। সেটি তিনি করেছিলেন মেলোডির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস না করে। মজরু সুলতানপুরির লেখা এই গানটি গাওয়ানো হয় কিশোর-আশা জুটিকে দিয়ে। লিপ দেন সঞ্জয় দত্ত এবং মীনাক্ষী শেষাদ্রি। গানটি প্রশ্নাতীতভাবে জনপ্রিয় হয় সেই সময়।
আসে ১৯৮৭ সাল। মুক্তি পায় ‘ইনাম দশ হাজার’ ছবিটি। ‘চাঁদ কই হোগা তুমসা কাহা’ গানটি শুনলেই বুঝতে পারবেন পঞ্চমের পরিবর্তন। বঙ্গের পরিবর্তে এ বার পঞ্চম ব্যবহার করেন অক্টোপ্যাড। একটু ভিন্ন স্বাদের পরকাশন, ছন্দের ক্ষেত্রে কিছুটা নতুনত্ব নিয়ে এসে গানটিকে যথাসাধ্য যুগপোযোগী করার প্রয়াস করেন তিনি। সেটি তিনি করেছিলেন মেলোডির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস না করে। মজরু সুলতানপুরির লেখা এই গানটি গাওয়ানো হয় কিশোর-আশা জুটিকে দিয়ে। লিপ দেন সঞ্জয় দত্ত এবং মীনাক্ষী শেষাদ্রি। গানটি প্রশ্নাতীতভাবে জনপ্রিয় হয় সেই সময়।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫৩: রোজ রোজ আঁখো তলে…
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?
‘হিফাজত’ ছবির ‘আজুবা আজুবা’ গানটি নায়ক অনিল কাপুরের লিপে গেয়ে ফেলেন পঞ্চম স্বয়ং। এই ক্ষেত্রে তিনি কিছুটা ফোনেটিক্সেরও ব্যবহার করেন কোরাসের সাহায্যে। আর পঞ্চমের কণ্ঠের সেই টেক্সচার। সব মিলিয়ে গানটি সেই সময়ের নবপ্রজনমের মনে জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়।
কিন্তু যদি ‘ইতিহাস’ ছবির ‘মৌসম আওয়ারা হ্যায়’ গানটি শোনেন, দেখবেন পঞ্চম এই ক্ষেত্রে কিন্তু একটু পুরনোপন্থী। ঠিক যেন ষাটের দশক অথবা তারও আগে ফিরে গিয়েছেন তিনি। গানটি গেয়েছেন আশা ভোঁসলে এবং সুরেশ ওয়াদকার। লিপ দিয়েছেন অনিল কাপুর এবং রতি অগ্নিহোত্রী। ১৯৮৭ সালে দাড়িয়ে এমন ধাঁচের একটি সুর বাণিজ্যিক ছবির কোনও গানে ব্যবহার করতে গেলে অসীম সাহসের প্রয়োজন হয় বইকি?
কিন্তু যদি ‘ইতিহাস’ ছবির ‘মৌসম আওয়ারা হ্যায়’ গানটি শোনেন, দেখবেন পঞ্চম এই ক্ষেত্রে কিন্তু একটু পুরনোপন্থী। ঠিক যেন ষাটের দশক অথবা তারও আগে ফিরে গিয়েছেন তিনি। গানটি গেয়েছেন আশা ভোঁসলে এবং সুরেশ ওয়াদকার। লিপ দিয়েছেন অনিল কাপুর এবং রতি অগ্নিহোত্রী। ১৯৮৭ সালে দাড়িয়ে এমন ধাঁচের একটি সুর বাণিজ্যিক ছবির কোনও গানে ব্যবহার করতে গেলে অসীম সাহসের প্রয়োজন হয় বইকি?
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা
পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪৯: শ্রদ্ধাঞ্জলি— প্রযোজক-গায়িকা অসীমা মুখোপাধ্যায়, অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিক ও গীতিকার মিল্টু ঘোষ
‘ডাকাইত’ ছবির ‘গাও মে মচ গেয়া শোর’ গানটি তৈরি করা হয় কিছুটা কাওয়ালির ধাঁচে। গাওয়ানো হয় কিশোর কুমার, সুরেশ ওয়াদকার এবং আশা ভোঁসলে দিয়ে। সেই আবার নতুন পঞ্চম। অথবা বলা যেতে পারে নবযুগের পঞ্চম। অর্থাৎ, পঞ্চমের সমসাময়িক মিউজিক ব্যবহারের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হতে থাকে বারেবারে।
ঠিক যেমন ‘আপনে আপনে’ ছবির তাঁর নিজেরই গাওয়া ‘তুনে কিয়া কেয়া জাদু’ গানটি। শুনলেই বুঝতে পারবেন যে গানটিকে যুগপোযোগী করে উপস্থাপিত করতে পঞ্চম কি না করেছেন। কণ্ঠের মডুলেশন, জ্যাজ এবং পারকাশনের ব্যবহারে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা এবং ছন্দটিকে যথাসম্ভব ‘ফুট ট্যাপিং’ করে তোলা। সব কিছু করেছেন সুকৌশলে। আরও যেটি উল্লেখ্য, সুরের কাঠামোটি অনেকটাই ‘সাগর’ ছবির ‘জলপরী থিমের’ আদলে তৈরি। অর্থাৎ, তাঁর অস্ত্রভাণ্ডার উজাড় করে গানটিকে সাজিয়ে তুলতে পঞ্চম যেন মরিয়া।
ঠিক যেমন ‘আপনে আপনে’ ছবির তাঁর নিজেরই গাওয়া ‘তুনে কিয়া কেয়া জাদু’ গানটি। শুনলেই বুঝতে পারবেন যে গানটিকে যুগপোযোগী করে উপস্থাপিত করতে পঞ্চম কি না করেছেন। কণ্ঠের মডুলেশন, জ্যাজ এবং পারকাশনের ব্যবহারে বৈচিত্র্য নিয়ে আসা এবং ছন্দটিকে যথাসম্ভব ‘ফুট ট্যাপিং’ করে তোলা। সব কিছু করেছেন সুকৌশলে। আরও যেটি উল্লেখ্য, সুরের কাঠামোটি অনেকটাই ‘সাগর’ ছবির ‘জলপরী থিমের’ আদলে তৈরি। অর্থাৎ, তাঁর অস্ত্রভাণ্ডার উজাড় করে গানটিকে সাজিয়ে তুলতে পঞ্চম যেন মরিয়া।
আরও পড়ুন:
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৩: ক্রোধ ও ক্ষমা, কোনটির প্রভাব বেশি? হিংসা ও প্রতিহিংসার ফল কী সুদূরপ্রসারী?
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন
মুক্তি পায় ‘ইজাজত’ ছবিটি। নির্দেশক এবং গীতিকার গুলজার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এই ছবির খানদানই আলাদা। তাই পঞ্চমও হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। গানগুলি শোনা যাবে শুধু নারীকণ্ঠে। গল্প এবং চিত্রনাট্য সেইরকমই ইঙ্গিত করছে। গুলজার যখন গানগুলি পঞ্চমকে শোনান, পঞ্চমের মনে এক নিমেষে চলে আসে আশার নাম। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। চমক তো দিতেই হবে। অভিনব কিছু তো করতে হবেই। একে একে গানগুলি সুরে সাজিয়ে এ বার গুলজারকে শোনানোর পালা। একদিন নির্দিষ্ট সময়ে গীতিকার সুরকার জুটি একত্রে বসেন গানগুলি নিয়ে। গানের কথার সঙ্গে পঞ্চমের করা সুরগুলি নিয়ে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বসুলভ কিছু বিতর্কের পর সুরগুলিতে সিলমোহর দিয়ে দেন গুলজার। তবুও পঞ্চম কিছুটা বিস্মিত হয়েই গুলজারকে জিজ্ঞেস করেন, গানগুলি নিয়ে তাঁর বক্তব্য ঠিক কী? এ বার গুলজারের উচ্ছাস দেখেই পঞ্চম তাঁর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যান। তারপরেই আশাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয় রিহার্সাল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৩: লিপ ইয়ার
‘কাতরা কাতরা মিলতি হ্যায়’ গানটি সবাই শুনেছেন। কিন্তু গানটির অভিনবত্ব কোথায় জানেন? গানটির বেশ কিছু অংশে আশা ভোঁসলের কণ্ঠকে সুপার-ইম্পজ করিয়েছেন পঞ্চম। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে ‘পেয়াসি হুঁ ম্যায় পেয়াসি রহেনে দো’ অংশটি। শুনলে বুঝতে পারবেন, উপরোক্ত অংশটি আশা শেষ করার আগেই তাঁরই কণ্ঠ ‘রহেনে দো’ কথাটির ‘রিপিটেশন’ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিধ্বনি হিসেবে নয় কিন্তু। আমাদের মনে হবে ‘রহেনে দো’ কথাটি অন্য কোনও গায়িকার কণ্ঠে শুনছি আমরা। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই গাইছেন আশা নিজেই।
এই গানের অনেক অংশেই এই ব্যাপারটি আমাদের কানে ধরা দেয়। একবার ভাবুন। সেই যুগে কোন ধরনের উন্নতমানের ডিজিটাল মিক্সার দেশে না থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের অভিনবত্ব একটি গানে নিয়ে আসা, সেটি বোধহয় রাহুল দেব বর্মণের পক্ষেই সম্ভব। তাও আবার গুলজারের লেখা গানে। ভাবা যায়? নিজের প্রতি কতখানি আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন একটি কাণ্ড ঘটানো যায়।
‘ছোটি সি কাহানি সে’ গানটির সুর তো বটেই, ছন্দটিও খেয়াল করুন। এই ক্ষেত্রে বঙ্গের কোনও ব্যবহার নেই। পঞ্চম বেছে নিয়েছেন অক্টোপ্যাড। তার সঙ্গে কাজে লাগানো হয়েছে পারকাশন এবং বাস গিটারকে। এবং অন্তরাগুলিতে সুর যখন মাইনর থেকে বেরিয়ে মেজরে প্রবেশ করছে, মনের গভীরে একটি ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে বইকি? গানটি আজও পুরনো হয়নি। এই গান আজও থেকে গিয়েছে সবার ভালোলাগার গান হয়ে। বয়স নির্বিশেষে।—চলবে।
এই গানের অনেক অংশেই এই ব্যাপারটি আমাদের কানে ধরা দেয়। একবার ভাবুন। সেই যুগে কোন ধরনের উন্নতমানের ডিজিটাল মিক্সার দেশে না থাকা সত্ত্বেও এই ধরনের অভিনবত্ব একটি গানে নিয়ে আসা, সেটি বোধহয় রাহুল দেব বর্মণের পক্ষেই সম্ভব। তাও আবার গুলজারের লেখা গানে। ভাবা যায়? নিজের প্রতি কতখানি আত্মবিশ্বাস থাকলে এমন একটি কাণ্ড ঘটানো যায়।
‘ছোটি সি কাহানি সে’ গানটির সুর তো বটেই, ছন্দটিও খেয়াল করুন। এই ক্ষেত্রে বঙ্গের কোনও ব্যবহার নেই। পঞ্চম বেছে নিয়েছেন অক্টোপ্যাড। তার সঙ্গে কাজে লাগানো হয়েছে পারকাশন এবং বাস গিটারকে। এবং অন্তরাগুলিতে সুর যখন মাইনর থেকে বেরিয়ে মেজরে প্রবেশ করছে, মনের গভীরে একটি ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে বইকি? গানটি আজও পুরনো হয়নি। এই গান আজও থেকে গিয়েছে সবার ভালোলাগার গান হয়ে। বয়স নির্বিশেষে।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।