শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


আরডি।

বিগত বছরগুলোর মতোই, ১৯৮৫ সালে বেশ কিছু ধামাকেদার সুর রচনা করেন পঞ্চম। একের পর এক। সেই ছবিগুলির কথা বলতে গিয়ে যে নামটি সর্বপ্রথম মনে আসে, সেটি হল ‘সাগর’ ছবিটি। জিপি সিপ্পি প্রযোজিত এবং রমেশ সিপ্পি নির্দেশিত এই ছবির গীতিকার হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জাভেদ আখতারকে। গান লেখার কাজ শেষ করে তিনি পঞ্চমের সঙ্গে বসে প্রতিটি গান সুরে ফেলে একটিবার শোনার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁর সেই ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ এগোতে থাকে। এক একটি গানে সুর বসিয়ে সেগুলিকে জাভেদ আখতারকে শোনান পঞ্চম।

কোনও কোনও গানে সুর এবং কথার সামঞ্জস্য আনতে গানের কথার কিছু পরিবর্তনও ঘটান জাভেদ। তারপর ভূমিষ্ঠ হয় ছবির গানগুলি। ‘চেহেরা হ্যায় ইয়া চাঁদ খিলা হ্যায়’ গানটির শুরুতে, অর্থাৎ ইন্টারলুডে, রমেশ আইয়ার এবং সুনীল কৌশিকের গিটারের যুগলবন্দি ইঙ্গিত করে এ বার কোনও এক ধামাকা শুরু হতে চলেছে। হয়ও তাই। তারপর যখন কিশোর কণ্ঠের প্রবেশ ঘটে, তখন তো আর কথাই নেই। দর্শক অথবা শ্রোতা, দুইয়েরই বাকরুদ্ধ হওয়ার জোগাড়। গানটির সঙ্গে সঙ্গে গলা মেলানোর লোভ সম্বরণ করার কাজটিকে নেহাতই কঠিন বলে মনে হতে থাকে।
‘সাগর কিনারে, দিল ইয়ে পুকারে’ গানটি আমাদের কলেজ জীবনে তো বটেই, এমনকি আজও একইভাবে নাড়া দিয়ে যায়। কিশোর-লতার আবেগঘন কণ্ঠ, সঙ্গে পঞ্চমের সেই মেলোডি আবেগতাড়িত না হয়ে যাই কোথায়? গানের প্রতি অদ্ভুত এক আকর্ষণ অনুভূত হয়।

‘সচ মেরে ইয়ার হ্যায়’। কমল হাসানের লিপে গাইছেন প্রয়াত এসপি বালসুব্রহ্মণ্যম। নিজের ভালোবাসাকে পরম বন্ধুর হয়ে যেতে দেখার যন্ত্রণা হাসি দিয়ে ঢেকে গানটি গাইছেন নায়ক। ছবিতে কমল হাসানের অভিব্যক্তি কি অসামান্য পারদর্শিতার সঙ্গে নিজের কণ্ঠের সাহায্য ফুটিয়ে তুলেছেন বালসুব্রহ্মণ্যম! আর যে কথাটি এই ক্ষেত্রে উল্লেখ করা অত্যন্ত জরুরি, সেটি হল সুরকে আশ্রয় করে বেরিয়ে আসা এক নিদারুণ প্যাথস। দৃশ্যের বিষয়বস্তুকে কতখানি গভীরভাবে জানলে তবে এমন একটি উপযোগী সুর তৈরি করা সম্ভব সেটি একবার ভেবে দেখুন।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫১: পঞ্চমের মিউজিক-ম্যাজিক—অ্যায়সা সামা না হোতা…

এই দেশ এই মাটি, পর্ব-৩৭: সুন্দরবনের নদীবাঁধের ভবিতব্য

একটি ভারী মজার দৃশ্যে ‘ও মারিয়া, ও মারিয়া’ গানটি, যেটিতে মূলত লিপ দিয়েছেন ডিম্পল কাপাডিয়া এবং কমল হাসান, সেটিই বা কম কিসে? কি মিষ্টিমধুর মেলোডি! একটি বিবাহের অনুষ্ঠানে নায়ক-নায়িকা দু’জনে মিলে নবদম্পতিকে এই গানটির মাধ্যমে মজার ছলে উত্যক্ত করে চলেছেন। একটি আনন্দের আবহ বিরাজমান। কি অসাধারণ একটি গান। গেয়েছেন আশা এবং এসপি। বলাই বাহুল্য, সবকিছুর আড়ালে সেই একজনেরই কারিকুরি।

এসপি এবং কিশোরের কণ্ঠে আর একটি মন মাতানো গান ‘ইঁউহি গাতে রহ’। গানটির প্রেলুড শুরু হয় একটি নির্দিষ্ট ছন্দকে আশ্রয় করে। কিন্তু এসপি গানটি শুরু করার ঠিক আগের মুহূর্তে বদলে যায় গানের ছন্দ। এসপি এবং তার কিছু পরে কিশোর, দু’জনেই নিজেদের কণ্ঠ একেবারে খাদ থেকে তুলে নিয়ে ক্রেসেন্ডোতে পৌঁছে যান মিরের মাধ্যমে। কি ‘পারফেকশন’! তবলা ব্যতীত বাকি সব বাদ্যযন্ত্রই অত্যাধুনিক। দৃশ্যের দাবি মেনে পঞ্চমের এই প্রচেষ্টা। তাতে তিনি পুরোপুরি সফল।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৩: ‘সুরের পরশে’ তুমি-ই যে শুকতারা

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: ঠাকুরবাড়ির বাঙালিয়ানা‌

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৪: মা সারদার সন্তানসম শিষ্যের দেহরক্ষা

যেটির কথা উল্লেখ না করলে ‘সাগর’ ছবির গানগুলির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তা হল ‘জলপরী থিম’। ভাবছেন তো কিসের কথা বলতে চাইছি? মনে পড়ে? নায়িকা ডিম্পল যখন একটি নির্জন স্থানে কোনও এক জলাশয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন, তখন হঠাৎই, নায়ক ঋষি কাপুরের চোখ পড়ে তাঁর দিকে। সম্পূর্ণ নায়িকার অজান্তে। নায়কের সেই মুহূর্তের অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন পঞ্চম স্বয়ং। নিজের কণ্ঠের সাহায্যে। যেমন ইলেকট্রিক গিটারের মাদকতা, তেমন পঞ্চমের উদাত্ত কণ্ঠ। বিস্ময়কর, যুগান্তকারী, চিরনবীন, সবগুলি বিশেষণই নির্দ্বিধায় ব্যবহার করা যেতে পারে। বস্তুত, সুরটি পঞ্চম বহুপূর্বে তাঁরই সুরারোপিত একটি বাংলা গান ‘তুমি কত যে দূরে’ থেকেই নিয়েছিলেন। কিন্তু ‘জলপরী’র আবেদন সর্বিভাবে কয়েকশগুন বেশি। আপনারা প্রত্যেকে শুনেছেন আমি নিশ্চিত।

যেমন ধরুন ‘সিতামগার’ ছবির কিশোর-আশার গাওয়া ‘মৌসম পেয়ার কা’ গানটি। স্প্যানিশ গিটার যেন ঝড় তোলে গানটিতে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেজে চলা পারকাশন এবং তবলা উন্মাদ করে দেয় আমাদের। গানটির অভিনবত্ব আগাগোড়া মুগ্ধ করে সমগ্র শ্রোতাদের।

কিশোরের গাওয়া ‘চন্দ্রোজ আউর মেরি জান চন্দ্রোজ’ গানটির তো কোনও কথাই নেই। ঠিক যেন একটি আবেগের সমুদ্র। যে সমুদ্রের গভীরতা অপরিসীম। সুরের ক্ষমতা হয়তো এমনই হয়। সেই সুর যখন পঞ্চমের মস্তিষ্কপ্রসূত, তখন তার আবেদন পৌঁছে যেতে পারে দিকচক্রবাল অতিক্রম করে আরও অনেক অনেক দূরে। এই গানটির ক্ষেত্রে ঠিক তেমনই হয়েছে।

‘আলগ অলাগ’ ছবির ‘দিল মে আগ লাগায়ে শাওন কা মাহিনা’ গানটি কিশোর-লতার যৌথভাবে গাওয়া অগুন্তি যুগান্তকারী গানের মধ্যে একটি বলে গণ্য করা হয়। গুরুপাক না হওয়া সত্বেও গানটির মধ্যে এমন কিছু রয়েছে যেটির আকর্ষণ উপেক্ষা করা বড়ো কঠিন।
আরও পড়ুন:

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস: তোমার ভাষা বোঝার আশা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫১: কচ, দেবযানী ও মহান শুক্রাচার্য— প্রেম, প্রতিহিংসা, উদারতায় অনন্য তিন দৃষ্টান্ত?

একটি ছবিতে কিশোর কুমার এবং আরতি মুখোপাধ্যায় দ্বৈত কণ্ঠে গান গেয়েছেন জানতেন? অনেকে হয়তো জানেন না। সেই ছবিটির নাম ‘রুসভাই’। সেমি ক্লাসিক্যাল এই গানটি আপনাকে মাতোয়ারা করবেই। গানটিতে কিশোর কণ্ঠ একটু অন্যরকম। ‘আরপার’ ছবিতে নিজের সুরে দু’ দুটি গেয়েছেন পঞ্চম স্বয়ং। ‘হো মাঝি তেরি নাইয়া সে’ গানটি যখন গেয়ে ওঠেন তিনি, আমরা পাই এক সম্পূর্ণ অন্য পঞ্চমকে। আমরা পাই একদম মাটির কাছাকাছি থাকা একটি মানুষকে, এক উদাস বাউলকে।

পুরো গানটি জুড়ে তবু যেন একটি দুঃখের আবহ বিরাজ করে। গানটির বাংলা সংস্করণটিও নিশ্চই শুনেছেন আপনারা সবাই। সেটিও গেয়েছিলেন তিনি নিজেই। গানটি হল ‘মন মাঝি রে তোর খেয়া তে তুই দিলি যে পাল তুলে’। ওই একই সুরে হিন্দি গানটি। এই ছবির আরও একটি গান হল ‘ও মাঝি রে, যাইবে কৌন দেশ’। এই গানেও সেই মাটির গন্ধ।

আসলে বাবা শচীন দেব বর্মণের প্রভাব ছিল রাহুল দেব বর্মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও শচীনকর্তার মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তাঁর সেই ধারাই প্রবাহিত হয়েছিল তাঁর পরবর্তী প্রজন্মে। সেহেতু, পঞ্চম যতই নিজের ‘ট্রেন্ড সেট’ করুন না কেন, মাটিকে কখনও ভোলেননি। মাটির সুর, বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ, রাখালের বাঁশি প্রভৃতির প্রতি আকর্ষণের বিষয়টি পঞ্চমের পিতৃসূত্রে প্রাপ্ত।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content